শালবনের সরু রাস্তা। একসময় এখান দিয়ে চলাফেরা করত বন্য পশুপাখি, কিন্তু দীর্ঘ বছর ধরে সংরক্ষণের অভাবে এ রাস্তা এখন মাদকসেবী ও কারবারিদের দখলে।
এ নিয়ে দায়িত্বপ্রাপ্ত বন কর্মকর্তারা জানান, লোকবলের অভাবে তাদের কার্যক্রম হচ্ছে ব্যাহত।
কুমিল্লা বিভাগীয় বন দপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, কুমিল্লায় ১ হাজার ৬০০ একর জায়গা বনাঞ্চল, যার মধ্যে প্রাকৃতিকভাবে গড়ে ওঠা শালগাছের বন রয়েছে ৯০০ একর। স্বাধীনতার পরে সামাজিক বনাঞ্চল বাড়লেও বাড়েনি প্রাকৃতিক বনের পরিধি।
কুমিল্লা সদর দক্ষিণ উপজেলায় ৫৮৭.২৯ একর জায়গাজুড়ে রাজেশপুর ইকোপার্ক। শালগাছের এই বনভূমি ২০০৬-০৭ সালে ইকোপার্ক হিসেবে গড়ে তোলা হয়। জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণের পাশাপাশি প্রকৃতি পর্যটনের লক্ষ্য নিয়ে গঠিত বনটির এখন রুগ্নদশা।
স্থানীয় অন্তত ২০ বাসিন্দা নাম না প্রকাশ করার শর্তে বলেন, ১৫ বছর আগেও এ বনে এত গাছ ছিল যে, দিনে-দুপুরে সেখানে প্রবেশ করতে ভয় লাগত। বনে ছিল চিতাবাঘ, মেছোবাঘ, গুইসাপ, ঈগল, বনবিড়াল, বনমোরগ, অজগর, গোখরা সাপসহ নানা প্রজাতির প্রাণী। দলে দলে বানর খেলা করত।
টিয়া, ময়না, তোতা ও ভিংরাজ পাখিও ছিল, তবে এখন বনে গাছপালা কমেছে। প্রাণীদের দেখা মেলে না বললেই চলে। বিকেল হলে কিছু টিয়ার দেখা পাওয়া যায়।
বন বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, গত এক বছর এ বনে একটি লজ্জাবতী বানর, একটি ময়না, চারটি টিয়া, চারটি শালিক, একটি বাজ, একটি চিল, একটি মেছোবাঘ, একটা শেয়াল, ৫২টি কচ্ছপ, তিনটি তক্ষক, একটি ফিশিংক্যাট, একটি গ্রিফন শুকুন, একটি অজগর, একটি বনবিড়াল, দুটি বানর, একটি গুইসাপ, দুটি দেশি ও একটি হিমালয়ন শুকুন অবমুক্ত করা হয়।
অবমুক্ত করার পর প্রাণীগুলোকে দ্বিতীয়বার দেখা যায়নি বলে জানিয়েছেন স্থানীয়রা। কেন বনে পশুপাখি নেই, তার সদুত্তর দিতে পারেননি বন বিভাগের কর্মকর্তারা।
স্থানীয়দের দাবি, বনের পরিধি কমে আসছে। সেই সঙ্গে বনে অহেতুক মানুষের পদচারণা বাড়ছে। বিভিন্ন অজুহাতে বনের মধ্যে যানবাহন চলাচল করে। পাশাপাশি খাবার সংকটে বণ্যপ্রানী সংখ্যা শূন্যের কোটায় চলে এসেছে।
স্থানীয়রা আরও জানান, রাজেশপুর ইকোপার্ক এখন মাদকসেবী ও মাদক কারবারিদের কারণে ভয়ংকর হয়ে ওঠে। দিনে-রাতে সমানতালে বনের মধ্যে চলে মাদকসেবন ও মাদক পাচার।
মাদক কারবারিদের দাপটে বনে পশুপাখি নেই। তাদের ধরতে আসা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর এক কর্মকর্তা নাম না প্রকাশ করার শর্তে বলেন, ‘এই বনে পশুপাখি নাই; আছে শুধু মাদক কারবারি।’
রাজেশপুর শালবনের অফিসার ইনচার্জ হুমায়ুন কবির বলেন, ‘রাজেশপুর শালবন রক্ষণাবেক্ষণে অন্তত ১০ জন বনরক্ষী দরকার। আমাদের আছে মাত্র তিনজন। এত কম জনবল দিয়ে এত বড় বন পাহারা দেয়া কিংবা বন ও বন্যপ্রাণীর যত্নআত্তি করা সম্ভব কীভাবে? এ ছাড়াও আমাদের লজিস্টিক সাপোর্ট নেই। তবুও আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করছি বনের গাছপালা ও পশুপাখিদের নিরাপত্তা ঠিক রাখতে।’
কী অবস্থা জামবাড়ি শালবনের
জেলার আদর্শ সদর উপজেলার সীমান্তবর্তী জামবাড়ি শালবনে গিয়ে দেখা যায়, বনের চারপাশের লতাগুল্ম কেটে ফেলা হয়েছে। বনের বিভিন্ন স্থানে বসতি বাড়ছে।
দায়িত্বরত বনরক্ষীরা জানান, জামবাড়ি শালবনের মাটি অনেক রুক্ষ, যে কারণে এ বনের গাছপালার সংখ্যা বাড়েনি। সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়া নির্মাণের ফলে ওই পাশ থেকে বন্যপ্রাণীর যাতায়াত নেই বললে চলে। বছর দুয়েক আগেও জামবাড়ী শালবনের আশেপাশে সজারু ও বানর দেখা যেত। এখন তাও নেই।
জামবাড়ী এলাকার প্রবীণ আবদুল হক বলেন, ‘স্বাধীনতার পরেও এই বনে চিতাবাঘ, হরিণ, বনগাই, বনমোরগ, বাগডাশ, খাটাশ, লজ্জাবতী বানর ছিল। হাজার হাজার শুকুন বসে থাকত শালবনে। এখন বনে আর কোনো প্রাণী নেই। গাছও কমে আসছে।
‘আমরা এই বনে এদিক দিয়া প্রবেশ করলে রাস্তা হারাইয়া ফেলতাম। এত ঘন বন আছিল। এখন তো সব শেষ।’
ধ্বংসের পথে উডলট বন
বুড়িচংয়ের আনন্দপুরে উডলট বন ধ্বংসের পথে। এখানে পাহাড় কেটে বন উজাড় করা হয়েছে। কেউ কেউ পাহাড় কেটে ফিশারি তৈরি করছেন। গত কয়েক বছর উপজেলা প্রশাসন বেশ কয়েকটি অভিযানে ড্রেজার ও মাটি বহনকারী ট্রাক্টর ধ্বংস করলেও রাতের আঁধারে চলে পাহাড় কাটা ও বন উজাড়।
কী বলছেন পরিবেশকর্মী, গবেষক ও বন কর্মকর্তা
বাংলাদেশ পরিবেশ অধিদপ্তর কুমিল্লা জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক আলী আকবর মাসুম বলেন, ‘একটি দেশে তার আয়তনের ২৫ ভাগ বনাঞ্চল থাকা জরুরি। সেখানে আমাদের দেশে ৯ ভাগ কিংবা তার চেয়ে কম আছে। কুমিল্লার বেলায় তা আরও শোচনীয়। এখানে বন উজাড়ের পাশাপাশি বন্যপ্রাণীও বিপন্ন। এসব কারণে প্রাকৃতিক ভারসাম্য নেই, যার ফলে বন্যা খরাসহ প্রাকৃতিক দুর্যোগ লেগেই আছে।
‘আমরা বিভিন্ন সময় আন্দোলন করি। সভা-সেমিনার করি, তবে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ যদি বন বাড়ানোর উদ্যোগ না নেন এবং বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ না হয়, তাহলে অদূর ভবিষ্যতে আমাদের চরম ক্ষতির মুখে পড়তে হবে।’
ইতিহাস গবেষক আহসানুল কবীর বলেন, ‘এই অঞ্চলে ত্রিপুরা রাজ পরিবার যখন রাজত্ব করত, তখন তারা ময়নামতি লালমাই পাহাড়ের বন, রাজেশপুর বন কিংবা জামবাড়ি ও আশেপাশের এলাকা থেকে মোগলদের জন্য বন্যহাতি কিংবা বাঘ ধরে উপহার দিত। এসব বনে ঈগল, বাজপাখি, শকুনের আধিক্য ছিল। কালক্রমে কুমিল্লায় বন কমেছে। বন্যপ্রাণী নেই বললেই চলে।’
এসব বিষয় নিয়ে কুমিল্লা বিভাগীয় বন কর্মকর্তা মোহাম্মদ আলী বলেন, ‘যেখানেই বন্যপ্রাণী আটক হচ্ছে সেখানে থেকে উদ্ধার করে আমরা বিভিন্ন সময়ে বনে সেসব প্রাণী অবমুক্ত করছি, তবে বন্যপ্রাণী সীমানা পেরিয়ে ভারতে চলে যায়। তাই অবমুক্ত করা প্রাণীগুলো খুব একটা দেখা যায় না। এ ছাড়াও এখন আগের মতো চট্টগ্রাম অঞ্চলে বন নেই। তবুও আমরা চেষ্টা করছি যেন বন্যপ্রাণীকে সংরক্ষণ করা যায়।’
কেন বন্যপ্রাণী সংকটাপন্ন এবং কীভাবে বন্যপ্রাণী বাড়ানো যায়, সে বিষয়ে কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া সরকারি কলেজের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক রইছ উদ্দিন বলেন, ‘বিভিন্ন সময়ে বনের পাশে বিভিন্ন উন্নয়ন কর্মকাণ্ড চলে। এতে করে বন্যপ্রাণীর মনে সংশয় তৈরি হয়। বন্যপ্রাণী ভয় পেয়ে যাওয়ার কারণে তাদের শরীরের স্বাভাবিক বৃদ্ধিসহ প্রজনন ক্ষমতা নষ্ট হয়। পাশাপাশি বন উজাড় হওয়ার কারণে খাবারের খোঁজে বন্যপ্রাণী লোকালয়ে চলে এসে নির্মম মৃত্যুর শিকার হচ্ছে। এতে করে ধীরে ধীরে বন্যপ্রাণী বিপন্ন হচ্ছে।
‘তাই বন্যপ্রাণী বৃদ্ধির জন্য বনাঞ্চলকে সম্পূর্ণ নিরাপদ করতে হবে বন্যপ্রাণীর জন্য। বনে কিংবা বনের পাশে স্থাপনা নির্মাণ করা যাবে না। বিদেশি গাছ রোপণ বন্ধ করতে হবে। কারণ দেশীয় গাছপালায় অভ্যস্ত দেশীয় বন্যপ্রাণী বিদেশি গাছে বাসা তৈরি করতে পারে না। এ ছাড়াও কিছু বিদেশি গাছ বিষ ছড়ায়। এ কারণে অনেক প্রাণীর মৃত্যু হয়। তাই এ বিষয়ে সর্তক থাকতে হবে।’