শুক্রবার দুপুর সোয়া দুইটা থেকে বেলা সোয়া ৩টা। এই এক ঘণ্টা ধরে ফার্মগেটে যাওয়ার জন্য মোহাম্মদপুরের বসিলা বাসস্ট্যান্ডে ঢাকা নগর পরিবহনের ২২ নম্বর রুটের বাসের জন্য অপেক্ষা করছিলেন মো. শাওন, কিন্তু দীর্ঘ এ সময়েও নগর পরিবহনের বাস না পেয়ে অন্য বাসে ভেঙে ভেঙে ফার্মগেট যান তিনি।
‘এটা নিয়মিত চিত্র হয়েছে এই রুটের। দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষা করেও বাস পাওয়া যায় না। অন্য দুই রুটেও দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষা করা লাগে, তবে ২২ নম্বর রুটের অবস্থা সব থেকে খারাপ। তারা তাদের ইচ্ছামতো বাস চালায়’, হতাশামিশ্রিত ক্ষোভ নিয়ে বলেন শাওন।
রাজধানীবাসীকে লক্কড়ঝক্কড় পরিবহনের হয়রানি থেকে মুক্তি দিতে ২০২১ সালের ২৬ ডিসেম্বর চালু হয় ঢাকা নগর পরিবহনের একটি রুট। ধীরে ধীরে সম্পূর্ণ রাজধানীকে একটা কোম্পানির আওতায় আনা হবে।
এ সেবা চালু হওয়ার পর থেকে রাজধানীবাসী ভালো পরিবহন সেবা পাওয়ার আশায় বুক বেঁধেছিলেন, তবে সে আশা এরই মধ্যে হতাশায় রূপ নিতে শুরু করেছে।
নগর পরিবহনের ২২ নম্বর রুট শুরু কেরানীগঞ্জের ঘাটারচরে। সেখান থেকে আসাদগেট, ফার্মগেট, শাহবাগ, কাকরাইলের মতো আরও কিছু রুট হয়ে বাস যায় ডেমরার স্টাফ কোয়ার্টার পর্যন্ত।
এ রুটে হানিফ পরিবহনের ৫০টি বাস চলার কথা থাকলেও শুরু থেকে ৩০টি চলত। এই বাস কমতে কমতে এখন ১৩ থেকে ২০টিতে নেমেছে।
এ রুটের বাস বনভোজন কিংবা এমন বিশেষ কোনো অনুষ্ঠানে ভাড়া দেয়া হয়। শুরু থেকে কাউন্টার থাকলেও এখন তা উঠিয়ে দেয়া হয়েছে।
গত ৭ ফেব্রুয়ারি ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের নগর ভবনের ‘বুড়িগঙ্গা হলে’ বাস রুট র্যাশনালাইজেশনের সভা শেষে সংবাদ সম্মেলনে এ প্রতিবেদক বাস অন্যত্র ভাড়া দেয়া, অনিয়ম ও দুর্নীতির বিষয় তুলে ধরেন ঢাকা মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপসের কাছে।
এর পরিপ্রেক্ষিতে মেয়র বলেছিলেন, ‘টিকিট না কেটে বাসে ওঠার একটা প্রবণতা আমরা লক্ষ করেছি। টিকিটবিহীন যাত্রী নেয়ার জন্য ২২ নম্বর রুটের কর্তৃপক্ষকে কঠোর নির্দেশনা দেব।
‘নগর পরিবহনের বাস নগর পরিবহনই চালাবে। এই বাসগুলো অন্য কোথাও ব্যবহার করা যাবে না।’
মেয়রের কথা তোয়াক্কা না করে এখনও এ বাস দেয়া হচ্ছে রিজার্ভে বা ভাড়ায়। এ ছাড়া ২২ নম্বর রুট থেকে উঠিয়ে দেয়া কাউন্টার এখনও চালু হয়নি।
শাওনের কাছ থেকে তার দুর্ভোগের কথা জানার পর শুক্রবার বিকেল ৩টা ১৯ মিনিটে টিকিটের গায়ে অভিযোগ নম্বরে কল করা হলে তা রিসিভ করেন নবির হোসেন, যিনি নিজেকে পরিচয় দেন ম্যানেজার হিসেবে।
নিউজবাংলাকে নবির বলেন, ‘আজকে ড্রাইভার সংকট। তাই ১০/১২টা বাস বের হইছে। নামাজের আগে মাত্র ৯টা গাড়ি বের হইছে।
‘শুক্র-শনিবারে ড্রাইভাররা গাড়ি চালাতে চায় না। শুক্রবার যাত্রী থাকে না; ট্রিপ উঠতে চায় না। ওদের (ড্রাইভার) তো ট্রিপে বেতন। এই কারণে ঝামেলা। তাই ওরা গাড়ি চালায় না।’
একই দিনের রাত ৯টায় ফার্মগেটে যাত্রী বোঝাই করে আসে ২২ নম্বর রুটের ঢাকা মেট্রো ব-১৫-৯৬৮৭ নম্বর বাস।
নগর পরিবহনের ২২ নম্বর রুটের ঢাকা মেট্রো ব-১৫-৯৬৮৭ নম্বর বাস। ছবি: নিউজবাংলা
নিউজবাংলার এ প্রতিবেদক সার্বিক চিত্র দেখার জন্য বাসে ওঠেন। গাড়ির দরজা থেকে শেষ মাথা পর্যন্ত যাত্রীতে ঠাসা এ বাস ফার্মগেট থেকে চলা শুরু করে। কনডাক্টর শাহাবুদ্দিন সবার কাছ থেকে ভাড়া কাটা শুরু করেন, তবে কাউকেই টিকিট দেননি তিনি।
ভাড়া নিয়ে টিকিট না দেয়ার কারণ জানতে চাইলে শাহাবুদ্দিন বলেন, ‘টিকিট দিব কি দিব না, সেটা আপনাকে বলতে হবে? টিকিট দিব না; পারলে কিছু করেন।
‘গাড়ি পিকনিকের রিজার্ভ থেকে আসল। তাই গ্যারেজে যাওয়ার পথে যাত্রী নিচ্ছি। মোট ৩০টা গাড়ি রিজার্ভে গেছিল। শুক্র-শনিবার আমাদের গাড়ি রিজার্ভে যায়।’
পরবর্তী সময়ে সাংবাদিক পরিচয়ে চালক মো. রাজুর কাছে একই কারণ জিজ্ঞাসা করলে তিনি বলেন, ‘যদি কোম্পানি গাড়ি রিজার্ভে ভাড়ায় পাঠায়, তাহলে আমাদের কিছু করার নাই।’
নিয়ম না থাকার পরও বাসটি রিজার্ভে চলে কেন জানতে চাইলে তিনি আগের বক্তব্যের পুনরাবৃত্তি করেন।
শুক্রবার কয়টা বাস রিজার্ভে গেছে জানতে চাইলে রাজু বলেন, ‘আমাদের দুই গাড়ি গেছে। শাহবাগ থেকে গেছিলাম লোক নিয়ে।’
চালকের সঙ্গে কথোপকথনের সময় পাশেই দাঁড়িয়ে থাকা বৃষ্টি নামের এক যাত্রী নিউজবাংলাকে বলেন, ‘২২ নম্বর রুটের হানিফের একটি বাস রাজধানী উচ্চ বিদ্যালয়ের সামনে থেকে সকালে রিজার্ভে লোক নিয়েছে। এ ছাড়া তিনটা বাসকে দেখেছি মোহাম্মদপুর বেড়িবাঁধ থেকে রিজার্ভে লোক ওঠাতে।’
পাশে থাকা আরেক যাত্রী আয়েশা বলেন, “বসিলা ব্রিজ থেকে ২২ নম্বর রুটে পাঁচটা বাস একসঙ্গে রিজার্ভে গেছে। সকালে এই বাসে উঠতে গেলে তারা বলেন, ‘এগুলো রিজার্ভের বাস।’”
কথোপকথনের একপর্যায়ে সুমন নামে একজন মোহাম্মদপুর নামার সময় এ প্রতিবেদককে বলেন, ‘ভাই, এই রুটে কি নতুন নাকি আজ? নতুন না হলে তো এগুলো জানার কথা। যা তা অবস্থা নগর পরিবহনের। প্রতিদিন মোহাম্মদপুর থেকে ফার্মগেট যেতে যুদ্ধ করা লাগে ভাই, যুদ্ধ।’
বাস থেকে নেমে ক্ষোভ প্রকাশ করে তিনি জোর গলায় বলেন, ‘ভাই, ঢাকা নগর পরিবহন ভুয়া। ভুয়া ভাই, ভুয়া।’
ম্যানেজার নবির হোসেন শুক্রবার জানিয়েছিলেন চালক সংকটের কথা। পরবর্তী সময়ে চালক সংকট থাকার কথা বলে গাড়ি অন্যত্র ভাড়া দেয়ার বিষয়ে জানতে চেয়ে শনিবার নবির হোসেনের মোবাইল ফোনে একাধিকবার কল ও এসএমএস করেও সাড়া মেলেনি।
সার্বিক বিষয় জানার পরে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ও প্রতিষ্ঠানটির দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক, পরিবহন বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. সামছুল হক নিউজবাংলাকে বলেন, ‘পুরা পৃথিবীতে বাস রুট ফ্র্যাঞ্চাইজি সগৌরবে চলছে। মেয়র কী জানেন বাস রুট ফ্র্যাঞ্চাইজির? তার আশপাশের কিছু ধার করা লোক তারাই বা কী জানেন? এত বড় বৈজ্ঞানিক পেশায় কিছু অবৈজ্ঞানিক লোক নিয়ে কাজ করতেছে।
‘বাস রুট ফ্র্যাঞ্চাইজি হাতিরঝিলে সফল। ওখানে (নগর পরিবহনে) সফল না মানে অযোগ্য লোকের হাতে পড়েছে। মেয়ররা প্রজেক্ট করার জন্য ধার করা কিছু লোককে দিয়ে কী শ্রমটাই না দিচ্ছেন!’