আধুনিক যুগে তৈরীকৃত বিভিন্ন ধরনের ধাতব শিল্পের আগ্রাসনের কবলে পড়ে বাঁশ ও বেত শিল্প ক্রমে মুখ থুবড়ে পড়ছে। সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়া শাহজাদপুরসহ আশপাশে কর্মরত শত শত বাঁশ ও বেত শিল্পীর জীবনে নেমে এসেছে দুর্দিন।
বাঁশ-বেত শিল্পীদের ভাষ্য
সিরাজগঞ্জ সদর উপজেলার চর শেওলাবাড়ী এলাকার নুর ইসলাম শেখ নামের এক বাঁশ-বেত শিল্পী জানান, বর্তমানে রংপুরসহ বিভিন্ন স্থান থেকে বাঁশ আমদানিতে পরিবহন ব্যয় বেড়েছে। এ ছাড়া বাঁশের উৎপাদন হ্রাসের কারণে ছোট একেকটি বাঁশ ১৫০ টাকায় কিনতে হচ্ছে। অতীতে বাঁশ দিয়ে বিভিন্ন ধরনের শৌখিন সামগ্রী তৈরি হলেও বর্তমানে খলপার বেড়া ও চাটাই তৈরি করা হচ্ছে। দিনে যে টাকা আয় হচ্ছে তা দিয়ে পরিবারের ভরণ-পোষণ করতে খুব কষ্ট হচ্ছে।
তিনি আরও জানান, শাহজাদপুর উপজেলাসহ আশপাশের কাজিপুর ,বেলকুচি, কামারখন্দ, চৌহালী এবং পাবনা জেলার বেড়া, সাঁথিয়া, সুজানগর, বনওয়ারীনগর, ফরিদপুর ও ভাঙ্গুড়া এলাকার গ্রামাঞ্চলে উৎপাদিত বাঁশ দিয়ে খলপার বেড়া ও চাটাই তৈরি করা সম্ভব না হওয়ায় এসব এলাকার বাঁশকে ঘরের খুঁটি, দালান তৈরির সময় শার্টারের নিচের খুঁটি হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। উৎপাদিত একেকটি বাঁশ আকার ও প্রকারভেদে ২০০ থেকে ৩৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। দৈনিক আয় খুবই কম হওয়ায় শত শত শিল্পীরা তাদের পরিবারের ভরণ-পোষণ করতে পারছেন না। ফলে বাঁশ ও বেত শিল্পীদের খেয়ে না খেয়ে অতিকষ্টে মানবেতর জীবন যাপন করতে হচ্ছে।
বাঁশ-বেতের কাজ করছে উল্লাপাড়ার ঘাটিনা গ্রামের বাসিন্দা। ছবি: নিউজবাংলা
উল্লাপাড়া ঘাটিনা গ্রামের আবু তালেব জানান, রংপুর থেকে আমদানীকৃত ১৫০ টাকা দরে প্রতিটি বাঁশ ক্রয় করে খলপার বেড়া তৈরি করা হচ্ছে। বাঁশের উপরিভাগের অপেক্ষাকৃত টেকসই অংশ দিয়ে তৈরি খলপা উল্লাপাড়াসহ পাবনা, সিরাজগঞ্জের বাজারে হাত প্রতি প্রায় ৭০ টাকা বিক্রি হচ্ছে। আর বাঁশের ভেতরের অংশ দিয়ে তৈরি অপেক্ষাকৃত কম স্থায়িত্বের খলপা হাতপ্রতি প্রায় ৫০ টাকায় বিক্রি করা হচ্ছে। প্রতিটি বাঁশ কিনে আনার পর দিনভর মেহনত করে খলপার বেড়াসহ অন্যান্য বাঁশজাত সামগ্রী প্রস্তুত করা হলেও উৎপাদন ব্যয়ের সঙ্গে কিছু মুনাফা যোগ করে বাজারে বিক্রি করতে তাদের হিমশিম খেতে হচ্ছে।
তিনি আরও জানান, উল্লাপাড়াসহ আশপাশের বাঁশঝাড় উজাড় করে বসতভিটা তৈরি করায় বাঁশ-বেতের সংকট দিন দিন বাড়ছে । আশানুরূপ লাভ না হওয়ায় এ শিল্পের সঙ্গে সম্পৃক্তদের দিন দিন তীব্র পুঁজি সংকট সৃষ্টি হচ্ছে। পাশাপাশি বাজারে উচ্চ দামে বাঁশ ও বেত ক্রয় করে বিভিন্ন ধরনের দ্রব্যসামগ্রী তৈরি করে বাজারে উপযুক্ত দামে বিক্রি করতে না পেরে তারা মহাবিপাকে পড়েছেন ।
উল্লাপাড়া ঘাটিনা এবং শাহজাদপুর পৌর সদরের পাঠানপাড়া, রূপপুর গ্রামের বাঁশ-বেত শিল্পীরা জানান, প্লেনশিটসহ বিভিন্ন ধরনের ধাতব পদার্থ দিয়ে বর্তমানে বিভিন্ন দ্রব্যসামগ্রী তৈরি করা হচ্ছে। ধাতব পদার্থ দিয়ে তৈরি আসবাবপত্রসহ বিভিন্ন ধরনের দ্রবাদির দীর্ঘ স্থায়িত্বজনিত কারণে বাঁশ ও বেত দিয়ে তৈরি দ্রব্যসামগ্রীর চাহিদা দিনে দিনে কমে যাচ্ছে। প্লেনশিট, লোহাসহ বিভিন্ন ধাতব পদার্থ দিয়ে তৈরি দ্রবসামগ্রীর ব্যবহারের মাত্রা পুরোদমে প্রচলিত থাকায় ঐতিহ্যবাহী এ শিল্পটি বর্তমানে তোপের মুখে রয়েছে।
স্থানীয় বাঁশ-বেত শিল্পীরা জানান, গ্রাম বাংলার ঐতিহ্যবাহী বাঁশ-বেত দিয়ে তৈরি কুলা, চালুন, মোড়া, বই রাখার তাক, চেয়ারসহ বিভিন্ন ধরনের বাঁশ ও বেত সামগ্রী কালের বিবর্তনে হারানোর পথে। এ শিল্প রক্ষায় কাউকে কোনো কার্যকর ব্যবস্থা নিতে দেখা যাচ্ছে না। ফলে বাপ-দাদার আমল থেকে চলে আসা এই ঐতিহ্যবাহী শিল্পটি ধরে রাখতে শিল্পীরা অনেক ত্যাগ, কষ্ট, দুঃখ সহ্য করে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। তবে বাঁশ ও বেতের ঝাড় উজাড় করার ফলে কত দিন এই ঐতিহ্যবাহী শিল্পটি টিকে থাকবে, তা নিয়ে তাদের মধ্যে নানা প্রশ্ন ও সংশয় দেখা দিয়েছে।