উল্টো পথে চলা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টঙ্গী-গাজীপুর রুটের ‘ক্ষণিকা’ বাসের ধাক্কায় রাজধানীতে এক বেসরকারি চাকরিজীবী নিহত হওয়ার ঘটনায় দায় নিচ্ছে না বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। তারা বলছে, বাসটি বিআরটিসির হওয়ায় তেমন কিছু করণীয় নেই।
দুর্ঘটনার তিন দিন কেটে গেলেও নিহত ব্যক্তির পরিবারের সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ কোনো যোগাযোগ করেনি। বিশ্ববিদ্যালয়ের বাস উল্টো পথে চলাচল পুরোপুরি বন্ধ হয়নি স্বীকার করে কর্তৃপক্ষ বলছে, ভবিষ্যতে এ ধরনের ঘটনা বন্ধে কঠোর নির্দেশনা দেয়া হবে।
এয়ারপোর্ট রোডে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সামনে বৃহস্পতিবার বিকেলে ‘ক্ষণিকা’ বাসের ধাক্কায় গুরুতর আহত হন ২৪ বছর বয়সী আলামিন টুটুল।
বিআরটিসির দোতলা বাসটি ভাড়ায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের বহন করছিল। পুলিশ ও মামলার এজাহার সূত্রে জানা যায়, ওই দিন বিকেল ৪টায় বাসটি কার্জন হল থেকে ছেড়ে আসে। দীর্ঘক্ষণ জ্যামে থাকায় ফার্মগেটের পরে ড্রাইভার উল্টো পথ দিয়ে যেতে শুরু করেন। এরপর প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সামনের সড়কে সেটি আলামিন টুটুলকে ধাক্কা দেয়।
পুলিশ জানায়, দুর্ঘটনার পর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ও টুটুলের সহকর্মীরা তাকে সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে নিয়ে গেলে চিকিৎসক ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে পাঠিয়ে দেন। ঢাকা মেডিক্যালে কিছু পরীক্ষার পর টুটুলকে আইসিইউতে ভর্তির পরামর্শ দেন চিকিৎসক। তবে সেখানে আইসিইউ খালি না থাকায় মালিবাগের সিরাজুল ইসলাম মেডিকেল কলেজে নেয়া হয় টুটুলকে। সেখানে রাত পৌনে ১০টার দিকে তার মৃত্যু হয়।
টুটুলের বাড়ি ঢাকার নবাবগঞ্জ উপজেলায়। ঢাকার রাজাবাজারে ভাড়া বাসায় থাকতেন তিনি। বিজয় সরণির আওলাদ হোসেন মার্কেটের সিএসএল নামে একটি বেসরকারি কোম্পানিতে চেইন ম্যানেজমেন্ট অফিসার হিসেবে কাজ করতেন তিনি। সিএসএল বিভিন্ন কোম্পানির ক্লিনিং বিভাগে পণ্য সরবরাহ করে।
মামলার বাদী ও টুটুলের বড় ভাই আরিফুল আলম রোববার নিউজবাংলাকে বলেন, ‘ঢাকা ইউনিভার্সিটির বাসের ঢাক্কায় আমায় ছোট ভাইয়ের মৃত্যু হয়েছে। এরপর ঢাকা ইউনিভার্সিটির পক্ষ থেকে এখনও কেউ আমাদের পরিবারের সঙ্গে কোনো যোগাযোগ করেনি। আমরা এ ঘটনার সুষ্ঠু বিচার চাই।’
এ বিষয়ে জানতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অধ্যাপক ড. এ কে এম গোলাম রব্বানীর ফোনে রোববার কয়েকবার ফোন করা হলেও তিনি ধরেননি।
অন্যদিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবহন ম্যানেজার কামরুল ইসলাম নিউজবাংলাকে বলেন, ‘সে সময় (বৃহস্পতিবার বিকেল) শিক্ষার্থীদের ক্লাস বা পরীক্ষার কোনো তাড়া ছিল না। তারপরও ড্রাইভার একক স্বেচ্ছাচারিতায় উল্টো পথে গাড়ি চালিয়েছেন।
‘শিক্ষার্থীরা এ ধরনের কোনো অনুরোধ করেননি। গাড়িগুলো যেহেতু আমাদের নয় তাই আমরা তাদের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে পারি না। বিষয়টি আমরা বিআরটিসিকে জানিয়েছি।’
নিহত টুটুলের পরিবারের সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ কোনো যোগাযোগ করেনি স্বীকার করেন তিনি। তবে কামরুল ইসলাম বলেন, ‘যে ব্যক্তিটি মারা গেছেন তার পরিবারের কাছে আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিক সমবেদনা জানাব।’
বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে কোনো সহায়তা দেয়া হবে কি না, জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এ বিষয়ে আমাদের এখনও কোনো চিন্তা নেই। যেহেতু এটি বিআরটিসির, শুনেছি তারা এ বিষয়ে পদক্ষেপ নিচ্ছে। আর বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে সহায়তা দেয়ার বিষয়টি নিয়ে আমরা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের সঙ্গে আলোচনা করব।’
বৃহস্পতিবারের দুর্ঘটনার পর উল্টো পথে বাস চালানো বন্ধে নতুন করে কোনো নির্দেশনা দেয়া হয়নি জানিয়ে তিনি বলেন, ‘অনেক আগে থেকেই শিক্ষার্থী এবং ড্রাইভারের সঙ্গে মিটিং করে গাড়ি যেন উল্টো পথে না চালায় সেই নির্দেশনা দেয়া আছে। নির্দেশনাটা অনেকাংশে প্রতিপালিত হচ্ছে। উল্টো পথে গাড়ি চালানোর প্রবণতা আগের চেয়ে অনেক কমে এসেছে।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য (প্রশাসন) অধ্যাপক ড. মো. সামাদ রোববার বিকেলে নিউজবাংলার প্রশ্নের পরিপ্রেক্ষিতে জানান, তিনি ঘটনার বিস্তারিত জানিয়ে সংশ্লিষ্টদের রিপোর্ট দেয়ার নির্দেশ দিচ্ছেন।
অধ্যাপক সামাদ বলেন, ‘বিষয়টি আমি শুনেছি। এটা নিয়ে কিছু করার সময় পাইনি। এখনই আমি এ ঘটনায় বিস্তারিত রিপোর্ট দিতে বলে দিচ্ছি। রিপোর্ট পাওয়ার পর আমাদের করণীয় নিয়ে সিদ্ধান্ত নেব।’
তিনি বলেন, ‘উল্টো পথে গাড়ি চালানো তো বেআইনি। অপরাধী যে-ই হোক আমরা কোনো ছাড় দেব না। বিশ্ববিদ্যালয় বলে কোনো সহানুভূতি পেতে হবে সেটাও আমরা হতে দেব না। আইন সবার জন্য সমান।’
আর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. আখতারুজ্জামান বলছেন, বিআরটিসির বাস হওয়ায় তাদের তেমন কিছু করণীয় নেই।
উপাচার্য বলেন, ‘এটি আমাদের গাড়ি নয়। এটি বিআরটিসির গাড়ি, আমরা শুধু ভাড়া নিয়ে চালাই। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব কোনো গাড়ি এ রকম উল্টো পথে চালানোর কথাই নয়। যদি কোনো ড্রাইভার এটি করত আমরা সরাসরি তাকে বাদ দিয়ে দিতাম।’
নিহত ব্যক্তির পরিবারের সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে যোগাযোগ বা কোনো সহায়তা দেয়া হবে কি না, জানতে চাইলে তিনি ‘ঠিক আছে, ভালো থেকো’ বলে ফোন রেখে দেন।
তেজগাঁও থানার পরিদর্শক (তদন্ত) শাহ আলম নিউজবাংলাকে বলেন, ‘এ ঘটনায় তাৎক্ষণিক বাসের চালক বজলুর রহমানকে তেজগাঁও থানা পুলিশ আটক করে। ঘটনার পরদিন সকালে ভুক্তভোগীর পরিবার ২০১৮ সালের সড়ক ও পরিবহন আইনে মামলা করেছে। পরে ওই মামলায় চালককে গ্রেপ্তার দেখিয়ে কোর্টে পাঠিয়েছি। তিনি এখন জেলহাজতে।
‘দুর্ঘটনা ঘটার পরপরই ট্রাফিক পুলিশ বাসটি আটক করে। পরে ছাত্ররা অন্য চালক এনে বাসটি নিয়ে যান।’
জিজ্ঞাসাবাদে চালকের কাছ থেকে পাওয়া তথ্যের বরাত দিয়ে পুলিশের এই কর্মকর্তা বলেন, ‘চালক আমাদের বলেছেন যানজটের কারণে ছাত্রদের চাপে পড়ে তিনি রং রুটে গিয়েছিলেন। এ কারণেই দুর্ঘটনাটি ঘটে।’