বঙ্গোপসাগরের বুকে ছোট্ট দ্বীপ সেন্টমার্টিনের আকর্ষণ বলে বোঝানো কঠিন। তবে এবার কোথায় যেন ছন্দপতন। বছরের যে সময়টায় লোকে লোকারণ্য থাকার কথা, সেই সময়টায় সব খাঁ খাঁ।
টেকনাফ থেকে প্রায় ৯ কিলোমিটার দক্ষিণে এই দ্বীপে বসবাস আনুমানিক ৯ হাজার মানুষের। এদের ৯০ শতাংশের আয়ের প্রধান উৎস পর্যটন।
বছরের ১২ মাসের মধ্যে নভেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত চার মাসে পর্যটন খাতের আয়ে ভর করেই দ্বীপবাসীর চলে বাকি আট মাস। কিন্তু এবার নেই পর্যটকদের আনাগোনা, খালি পড়ে আছে হোটেল রিসোর্ট।
সৈকতের পাশের রিসোর্টগুলোতে তাও কিছু লোক আছে, দ্বীপের ভেতরেরগুলো একেবারেই ফাঁকা।
কেন এই চিত্র, পর্যটন ব্যবসায় জড়িতরা বলছেন, টেকনাফ থেকে জাহাজ চলাচল বন্ধ থাকাই এর কারণ। এখন জাহাজ চলছে কক্সবাজার থেকে। কিন্তু এতে সময় লাগছে দ্বিগুণের বেশি। টাকা লাগছে চার গুণ।
টেকনাফ থেকে জাহাজে লাগত আড়াই থেকে তিন ঘণ্টা। সর্বনিম্ন ভাড়া ছিল যাওয়া আসায় ৭৫০ টাকা।
কক্সবাজার থেকে এখন চলছে কেবল কর্ণফুলী এক্সপ্রেস। সর্বনিম্ন ভাড়া তিন হাজার ২০০ টাকা।
ভিড় নেই সেন্ট মার্টিনের রাস্তা ও দোকানপাটে। ছবি: নিউজবাংলা
আবার কক্সবাজার থেকে ছেড়ে যাওয়া জাহাজে ইঞ্জিন ক্রুটির কারণে ভোগান্তিতে পড়তে হচ্ছে যাত্রীদের। গত ১৬ ডিসেম্বর কর্ণফুলী এক্সপ্রেসে ইঞ্জিন ক্রুটির কারণে আরেকটি শিপে করে দুই শিপের যাত্রী এক শিপে আসে কক্সবাজার। ফলে জায়গা স্বল্পতা নিয়ে যাত্রীদের মধ্যে মারামারি ঘটনাও ঘটে।
চার দিন পর ১৯ ডিসেম্বর ঘটে আরেক ঘটনা। সেদিন মঙ্গলবার ভোরে কক্সবাজার থেকে সেন্টমার্টিন যাওয়ার পথে ইঞ্জিন ক্রুটি দেখা দেয় কর্ণফুলী এক্সপ্রেসের। পরে এমবি বে-ওয়ান নামের জাহাজে তাদের নেয়া হয়।
পরদিন বিকেল সাড়ে তিনটার দিকে সেন্টমার্টিন থেকে এমবি বে-ওয়ানের মাধ্যমে এক হাজার তিন শরও বেশি পর্যটক নিয়ে কক্সবাজারের উদ্দেশে রওনা হয় জাহাজ।
কিছুক্ষণ পর সেটিও ইঞ্জিনের ক্রটিতে হয়ে পড়ে বিকল। ১৬ ঘণ্টা সাগরে ভেসে থাকার কারণে নানা বিড়ম্বনা ও দুর্ভোগ পার করেছেন এসব যাত্রী। বুধবার ভোর পাচটার দিকে জাহাজটি কক্সবাজারে পৌঁছায়।
টেকনাফ রুট দিয়ে এবার জাহাজ বন্ধের পেছনে দুটি কারণের কথা উঠে এসেছে এই ব্যবসায় জড়িতদের বয়ানে। মিয়ানমার সীমান্তে কয়েক মাস আগে যে উত্তেজনা দেখা দেয়, তার কারণেই এবার সেই রুট বন্ধের প্রধান কারণ। বাংলাদেশ সীমান্তে যদি কোনো মর্টার শেল উড়ে আসে আর তা জাহাজে পড়ে, তাহলে ভয়াবহ পরিস্থিতি হতে পারে, এই আশঙ্কা থেকে রুটটি বন্ধ রাখা হয়েছে।
নাফ নদীতে নাব্যতা সংকটের বিষয়টিও উঠে এসেছে তাদের বক্তব্যে।
কেমন চলছে সেন্ট মার্টিনের জীবন
গত ১৬ ডিসেম্বর সেন্টমার্টিনে জেটির সামনের দোকানগুলো দেখা যায় ফাঁকা। মালামাল নেই বললেই চলে।
দোকানি সফিউল্লাহ নিউজবাংলাকে বলেন, ‘চার মাসের ব্যবসা আমাদের। ডিসেম্বর মাস চলে যাচ্ছে এখনো সেভাবে টুরিস্ট নাই। এই সময়ে দোকানে লোক দাঁড়ানোর জায়গা দেয়া যেত না। আর এখন মানুষই নাই, ফাঁকা।’
দোকান ভাড়া কীভাবে উঠবে, এটা নিয়েই দুশ্চিন্তায় তিনি বলেন, ‘চার মাসের জন্য আমার দোকান ভাড়া দেড় লাখ। টুরিস্ট কম হওয়ার কারণে কোনো দোকানেই তেমন মালামাল উঠায় নাই। আগামী বছর কীভাবে চলব সেই চিন্তায় আছি।’
জাহাজে সেন্ট মার্টিনে যাচ্ছেন পর্যটকরা। ছবি: নিউজবাংলা
তিনি বলেন, ‘টেকনাফ ঘাটে হাসিল ও লেবারের হাসিল দেয়া লাগে। আমার মাল আমি আনতে পারব না। লেবার দিয়ে আনতে হবে এটা তাদের নিয়ম। আমার সেন্টমার্টিন এসে একই হাসিল দেয়া লাগে। অর্থাৎ টেকনাফ থেকে সেন্টমার্টিন আমাদের মাল আনতে চারটা হাসিল দেয়া লাগে। এই কারণে মালের খরচও বেশি পড়ে। সব মিলিয়ে ভালো নেই আমরা।’
খাবার হোটেল ব্যবসায়ী রশিদ আহমেদ বলেন, ‘বিপদে আছি। এখন জাহাজ আসে একটা। গত বছরের তিন ভাগের এক ভাগও নাই টুরিস্ট এবার। দেখেন হোটেল ফাঁকা।’
কেউ আসবে, এমন আশায় দিনভর তাকিয়ে থাকেন আবাসিক হোটেলের ব্যবসায়ীরা।
সেন্টমার্টিনের ভিআইপি হোটেলগুলোর মধ্যে ব্লু মেরিন রিসোর্ট একটি। এই রিসোর্টের সুপারভাইজার মো. জসিম বলেন, ‘টেকনাফ থেকে শিপ চালু না হলে আমাদের ব্যবসা হবে না এবার। গত কয়েক দিনে আমাদের এত বড় রিসোর্টে বুকিং হয় এক থেকে পাঁচটা। আমাদের স্টাফ আছে ৩০ জনের উপরে।’
সি ভিউ রিসোর্টের ম্যানেজার মো. মনির বলেন, ‘আগে ডিসেম্বর মাসে রুমই খালি থাকত না। আমাদের হোটেলের ৩০টি রুমের ৫-১০ রুমে গেস্ট হয় এখন। সেন্টমার্টিনে ১০০ প্লাস হোটেল আছে। এর মধ্যে বেশিরভাগ হোটেলই এখন বন্ধ। বিচের পাশের হোটেলগুলো কিছুটা চলছে। ভেতরের হোটেলগুলো বেশিরভাগ এখনও বন্ধ। শুধু হোটেল না গেস্টের ওভাবে সেন্টমার্টিনের সকল ব্যবসায়ীদের মাথায় হাত এবার।’
সেন্টমার্টিনের শুঁটকি ব্যবসায়ীরও মাথায় হাত। আব্দুর রহমানের দোকানে কোনোদিন বেচাকেনা হয়ই না। তার মন ভার। বলেন, ‘দোকানভাড়া, দোকানের খরচ, স্টাফ বিল সব মিলিয়ে প্রতিদিন এক থেকে দেড় হাজার টাকা লোকসান হচ্ছে।
‘গত বছরগুলোতে প্রতিদিন ৬০-৭০ হাজার টাকা বিক্রি ছিল। এবছর তিন-চার দিনের মাথায় পাঁচ হাজার টাকা হয় না। আজকে সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত ২০০ টাকা বিক্রি করছি। কোনো ক্রেতাই নাই।’
টেকনাফ রুট বন্ধ জেনে সে পথে মানুষ কম, তাই ট্রলারও পাচ্ছে না যাত্রী।
ট্রলার মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীর আলম নিউজবাংলাকে বলেন, ‘টেকনাফে প্রতিদিন ১০টার বেশি বোট যেত। এখন একটাও যায় না। শুধু তিনটা বোট যায় খাবার আনতে। আমাদের একেবারে নাজেহাল অবস্থা।’
‘গত বছর ৪০০ থেকে ৫০০ লোক টেকনাফ থেকে ট্রলারে আসত। এবার একজনও আসছে না। আবার সেন্টমার্টিনে থেকে ছেড়াদ্বীপেও মানুষ যাচ্ছে কম। প্রতিদিন ৫০টা বোট ছেড়াদ্বীপে যেত। এবার যায় দুই-তিনটা।’
ভিড় নেই, বিক্রি নেই দোকানে। ছবি: নিউজবাংলা
সার্বিক বিষয় নিয়ে সেন্টমার্টিন ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান মুজিবুর রহমান বলেন, ‘সবাই আগামী বছর নিয়ে খুব শঙ্কায় আছেন।’
টেকনাফ-সেন্টমার্টিন রুট বন্ধ থাকার কারণ জানতে চাইলে কক্সবাজারের অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিষ্ট্রেট আবু সুফিয়ান বলেন, ‘সীমান্তে উত্তেজনার কারণে সাম্প্রতিক সময়ে প্রতিবেশী দেশ মিয়ানমারের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্কে কিছুটা ফাটল ধরেছে। মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ সংঘাতের সময় বাংলাদেশেও কয়েক দফায় এসে পড়েছে মর্টার শেল, আকাশসীমা লঙ্ঘনের ঘটনাও ঘটেছে কয়েক দফায়।
‘এর সঙ্গে যোগ হয়েছে নাব্যতা সংকট। এতে চলতি বছর টেকনাফ-সেন্টমার্টিন রুটে পর্যটন জাহাজ চলাচল বন্ধ রেখেছে সরকার। সেন্টমার্টিনে পর্যটক যাতায়াত স্বাভাবিক রাখতে এজন্য বিকল্প রুট খোঁজা হচ্ছে।’