বিএনপির কর্মসূচির সঙ্গে তাল মিলিয়ে জামায়াতে ইসলামীও একই দিন একই কর্মসূচি ঘোষণার পরও যুগপৎ আন্দোলন নিয়ে স্বাধীনতাবিরোধী দলটির সঙ্গে যোগাযোগ ও সম্পর্কের বিষয়ে স্পষ্ট জবাব দিচ্ছে না বিএনপি।
রোববার বিএনপির এক সংবাদ সম্মেলনে এই প্রশ্নে বিষয়টি নিয়ে সরাসরি জবাব দেননি দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান, যিনি বিলুপ্ত করে দেয়া ২০ দলীয় জোটের সমন্বয়ক ছিলেন। এর আগে দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য খন্দকার মোশাররফ হোসেনও ধোঁয়াশায় রাখেন সাংবাদিকদের।
নজরুলের কাছে প্রশ্ন ছিল, বিএনপি যে যুগপৎ আন্দোলনে নামার ঘোষণা দিয়েছে, তাতে জামায়াতও থাকছে কি না। জবাবে দলটির নীতিনির্ধারণী পর্ষদের এই সদস্য বললেন, ‘আমরা কিছু দাবি নিয়ে সব গণতান্ত্রিক ও দল প্রতিষ্ঠান ব্যক্তির প্রতি আহ্বান জানিয়েছি যুগপৎ আন্দোলনের মাধ্যমে। আনুষ্ঠানিকভাবে এখনও আমাদের যুগপৎ আন্দোলন শুরু হয়নি। কাজেই এখন বলা যাবে না কে আছে, কে নেই।’
১৯৯৯ সালে জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে জোট বেঁধে দুই বছরের পরের নির্বাচনে বিএনপি ভূমিধস জয় পেলেও পরে স্বাধীনতাবিরোধী দলটির সঙ্গে সম্পর্ক নিয়ে বিএনপিকে বড় প্রশ্নের মুখে পড়তে হয়।
- আরও পড়ুন: জোট ভাঙল বিএনপি, জানে না শরিকরা
২০০৮ সালের ডিসেম্বরের জাতীয় নির্বাচনে বিএনপির ধপাসের পর দলটির অভ্যন্তরীণ তদন্তে জামায়াত যোগের বিষয়টি উঠে আসার পর এই জোট ভেঙে দেয়ার সুপারিশ করেন দলটির নেতারাই।
তার পরও বিএনপি এই জোট চালিয়ে যায়। তবে ২০১৮ সালের জাতীয় নির্বাচনেই বিএনপি বিষয়টি নিয়ে ভুগেছে। ভোটের আগে আগে ভারতীয় একটি প্রভাবশালী দৈনিককে দেয়া সাক্ষাৎকারে বিএনপির জোট জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের প্রধান নেতা ড. কামাল হোসেন বলেছিলেন, জামায়াত জোটে আছে জানতে পারলে তারা বিএনপির সঙ্গে সম্পর্কই গড়তেন না।
এবারও বৃহত্তর বা যুগপৎ আন্দোলনের ক্ষেত্রে জামায়াত ইস্যু কোনো বাধা হয়ে দাঁড়ায় কি না, এই ভাবনা থেকে দলটির সঙ্গে কোনো প্রকাশ্য আলোচনায় যায়নি দলটি। যদিও গত আগস্টে এই জোট ভেঙে যাওয়ার কথা জানিয়ে কুমিল্লা ইউনিটের রুকন সম্মেলনে জামায়াত আমির শফিকুর রহমান বিএনপির সঙ্গে যুগপৎ আন্দোলনে আপত্তি নেই বলে জানান।
বৃহস্পতিবার সংবাদ সম্মেলনে এসে ১০ ডিসেম্বরের সমাবেশের পাশাপাশি জোটের বিষয়ে প্রশ্নের মুখোমুখি হন মির্জা ফখরুল। ফাইল ছবি
অবশেষে গত ৮ ডিসেম্বরের সংবাদ সম্মেলনে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর জানান, তাদের জোট আর নেই। তারা যুগপৎ আন্দোলন করবেন।
তার পরদিন বিএনপির পক্ষ থেকে সংবাদ সম্মেলনে এসে ‘যুগপতের সঙ্গীদের’ ১০ ডিসেম্বরের বিভাগীয় সমাবেশে যোগ দেয়ার আহ্বান জানান স্থায়ী কমিটির সদস্য খন্দকার মোশাররফ হোসেন। তবে কোনো দলের কোনো নেতা যাননি সেখানে।
তবে সেই সমাবেশে বিএনপি যে ১০ দফা দাবি ঘোষণা করে এবং তা আদায়ে ২৪ ডিসেম্বর যে গণমিছিলের ডাক দেয়, তার সমর্থনে বিলোপ করে দেয়া ২০ দলের শরিকরাই আগে সাড়া দেয়।
গণমাধ্যমে পাঠানো বিজ্ঞপ্তিতে জামায়াতে ইসলামী জানায়, বিএনপির তোলা দাবি নিয়ে তারাও ২৪ ডিসেম্বর একই ধরনের কর্মসূচি নিয়ে মাঠে নামবে।
তবে সেই কর্মসূচির দিন ঢাকায় আওয়ামী লীগের জাতীয় সম্মেলন থাকায় দলটি বিএনপিকে ভর্ৎসনা করে। বলে, বিএনপি সংঘাতের উসকানি দিচ্ছে। এরপর বিএনপি ১৩ ডিসেম্বর জানায়, তাদের কর্মসূচি স্থগিত। পর দিন এক বিজ্ঞপ্তিতে নিজেদের কর্মসূচি স্থগিত করে বিএনপি।
চার দিন পর বিএনপির পক্ষ থেকে ঘোষণা আসে, তাদের গণমিছিল হবে ৩০ ডিসেম্বর। তার দুই দিন পর আরেক বিজ্ঞপ্তিতে জামায়াতও তাদের মিছিল পিছিয়ে ৩০ ডিসেম্বর নিয়ে যায়।
কুমিল্লার রুকন সম্মেলনে জামায়াত আমির শফিকুর রহমান বিএনপির সঙ্গে জোটে না থাকার পেছনে তিনটি কারণের কথা তুলে ধরেন। ফাইল ছবি
জামায়াত ও বিএনপি যোগাযোগ করেই কর্মসূচি দিচ্ছে- এই ইঙ্গিতটি স্পষ্ট হলেও ১৬ ডিসেম্বর জাতীয় স্মৃতিসৌধে গিয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য খন্দকার মোশাররফ হোসেন তা স্বীকার করতে চাননি।
সেদিন তিনি বলেন, ‘আমরা যুগপৎ আন্দোলনের কথা ঘোষণা করেছি। এই আন্দোলনে কে আসবে না আসবে সেটা তাদের বিষয়। যারা এই সরকারের বিদায় চায়, যারা দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা চায়, তারা একমত হয়ে তাদের অবস্থান থেকে আন্দোলন করলে আমরা তো নিষেধ করতে পারব না।’
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সাবেক স্পিকার জমিরউদ্দিন সরকার নিউজবাংলাকে বলেন, ‘দেখুন যুগপৎ-এর একটা যথার্থ মানে আছে। স্ব-স্ব অবস্থান। এখন এই সরকারের পতন নিয়ে যারা ভাবছে তারা একত্র হবে এটাই স্বাভাবিক। জামায়াত বলে কথা না, সরকারবিরোধী আন্দোলন নিয়ে আরও যেসব সমমনা দল আছে সবাই এই যুগপৎ আন্দোলনের অংশীদার।
‘এখন জামায়াত যদি আমাদের ১০ দফা দাবিতে সহমত জানান, সেটাতে হাইলাইটের কিছু নেই। বাকি দলগুলোর মতোই তারাও একটা অংশ এই সরকারবিরোধী কর্মসূচির।’
জামায়াতের সঙ্গে বৈঠক কবে
সরকারবিরোধী দলগুলোকে এক সুতায় দাঁড় করিয়ে একই দিন একই কর্মসূচিতে উদ্বুদ্ধ করতে বিএনপির এই চেষ্টার শুরু গত ২৪ মে। সেদিন মাহমুদুর রহমান মান্নার নাগরিক ঐক্যের সঙ্গে বৈঠকের মধ্য দিয়ে প্রথম দফার সংলাপ শুরু হয়। যা ৩ আগস্ট গণ অধিকার পরিষদের সঙ্গে বৈঠকের মাধ্যমে শেষ হয়।
প্রতিটি দলের সঙ্গে আলোচনা শেষে দুই পক্ষ থেকেই ঘোষণা আসে, যুগপৎ আন্দোলনে নামবে তারা।
আগেভাগে গণমাধ্যমকর্মীদের সময় জানিয়ে আলোচনার স্থলে উপস্থিত থাকতেও বলা হয়।
তবে সে সময় ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বাধীন গণফোরামের সঙ্গে আলোচনায় বসেনি বিএনপি। আর জামায়াতের সঙ্গে আলোচনা হয়েছে কি না, সেই বিষয়টিও জানানো হয়নি।
তবে আলোচনা যে হয়েছে, সেটি জানা গেছে জামায়াতের তরফ থেকে। ২৭ আগস্ট কুমিল্লার একটি ইউনিটের রুকন সম্মেলনে জামায়াতের আমির শফিকুর রহমান জানান, বিএনপির সঙ্গে তাদের জোট আর নেই। তবে তারা যুগপৎ আন্দোলনে বিএনপির সঙ্গেই থাকবেন।
সেদিন তিনি বলেন, ‘এখন বাস্তবতা হচ্ছে, নিজস্ব অবস্থান থেকে আল্লাহর ওপর ভর করে পথচলা। তবে হ্যাঁ, জাতীয় স্বার্থে একই দাবিতে যুগপৎ কর্মসূচি বাস্তবায়ন করব ইনশাআল্লাহ।’
গত ২ অক্টোবর দ্বিতীয় দফা সংলাপ শুরু করে বিএনপি। এবারও জামায়াতের সঙ্গে কবে কোথায় বসা হয়েছে, সে বিষয়টি জানানো হয়নি।
তবে বিএনপির একাধিক নেতা নিশ্চিত করেছেন, জামায়াতের সঙ্গে বৈঠক করেছেন স্বয়ং বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, যিনি দলটির সঙ্গে তাদের জোট ভেঙে যাওয়ার বিষয়ে সাড়ে তিন মাস কিছুই বলেননি। তবে ১০ ডিসেম্বর ঢাকায় সমাবেশের আগে উদ্ভূত পরিস্থিতিতে সংবাদ সম্মেলনে একটি বিদেশি সংবাদ সংস্থার প্রতিনিধির প্রশ্নে বিষয়টি স্বীকার করেন।
এএফপির প্রতিনিধির প্রশ্নে সেদিন তিনি বলেন, ‘আমাদের কোনো জোট নেই। আমরা বলেছি, অন্য দলগুলো গণতন্ত্রের জন্য তাদের নিজস্ব কর্মসূচি পালন করবে। এসব কর্মসূচি পালিত হবে একই সঙ্গে, যাকে আমরা যুগপৎ বলে থাকি। সবাই নিজের পছন্দের এলাকা বা অফিসে কর্মসূচি পালন করবে।’
জামায়াতের সঙ্গে বৈঠকের প্রশ্নে স্থায়ী কমিটির সদস্য জমিরউদ্দিন সরকার বলেন, ‘আমার জানা মতে হয়নি।’
বিএনপির মিডিয়া সেলের দায়িত্বে থাকা একজন একই প্রশ্নে বলেন, ‘এটা আমি বলতে পারব না।’