ঢাকায় যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত পিটার ডি হাস বিএনপির নিখোঁজ এক নেতার বাসভবনে যাওয়ার পর যা যা হয়েছে তার মধ্য দিয়ে এই কূটনীতিককে হেনস্তা করা হয়েছে বলে অভিযোগ করেছে বিরোধী দলটি। এই ঘটনায় দেশের ভাবমূর্তি ব্যাপকভাবে নষ্ট হবে বলে মনে করছে তারা।
বুধবারের ঘটনাপ্রবাহের পরদিন বৃহস্পতিবার দুপুরে নয়াপল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলনে এক প্রশ্নের জবাবে এসব কথা বলেন দলটির ভারপ্রাপ্ত দপ্তর সম্পাদক এমরান সালেহ প্রিন্স।
তিনি বলেন, ‘রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে ঘটে যাওয়া ঘটনার আমরা তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানাচ্ছি। এই ঘটনার মধ্য দিয়ে বিদেশে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ব্যাপকভাবে ক্ষুণ্ণ হবে। বাংলাদেশে যে আজ গণতন্ত্র নেই, আইনের শাসন নেই, মানবাধিকার নেই, এখানে যে অপশাসন চলছে সেটা আরও ফুটে উঠবে।’
২০১৩ সালে বিএনপি-জামায়াত জোটের আন্দোলনের সময় যানবাহনে একের পর এক পেট্রল বোমা হামলার মধ্যে নিখোঁজ হন ঢাকা দক্ষিণ বিএনপির নেতা সাজেদুল ইসলাম সুমন।
তার বোন গড়ে তুলেছেন মায়ের ডাক নামে একটি সংগঠন। গত কয়েক বছরে নিখোঁজ ব্যক্তিদের স্বজনরা এই সংগঠনে আছেন। তারা প্রায়ই নানা কর্মসূচি পালন করে সরকারের বিরুদ্ধে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ আনেন।
শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবসের সকালে হঠাৎ করেই রাজধানীর শাহীনবাগে সুমনের বাসায় যান পিটার হাস। সেখানে অবস্থান করেন ২৫ থেকে ৩০ মিনিট। তবে তিনি বা বিএনপি নেতার পরিবারের পক্ষ থেকে এ বিষয়ে কিছু জানানো হয়নি।
সুমনের বাড়িতে যাওয়ার পর সেখানে যান ‘মায়ের কান্না’ নামের আরেক সংগঠনের সদস্যরা। ১৯৭৭ সালে জিয়াউর রহমানের শাসনামলে সেনা ও বিমান বাহিনীতে হত্যাযজ্ঞের ঘটনায় নিহতদের স্বজনরা গড়ে তুলেছেন এই সংগঠন। তারা জিয়াউর রহমানের মরণোত্তর বিচার এবং তাদের স্বজনদের সঙ্গে হয়ে যাওয়া অন্যায়ের ক্ষতিপূরণ দাবি করছেন।
পিটার হাসকে এই সংগঠনের সদস্যরা একটি স্মারকলিপি দেয়ার চেষ্টা করেন। এতে ৪৫ বছর আগের গুমের ঘটনার আন্তর্জাতিক তদন্ত চাওয়ার পাশাপাশি সামরিক শাসনামলে মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র সরকারের সহযোগিতা চাওয়া হয়।
- আরও পড়ুন: নিখোঁজ বিএনপি নেতা সুমনের বাসায় যুক্তরাষ্ট্রের দূত
- আরও পড়ুন: জিয়াউর রহমানের বিরুদ্ধে হাসের কাছে স্মারকলিপি
কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূতের প্রটোকল অফিসাররা তাদেরকে কাছে ঘেঁষতে দেয়নি। তারা হাসকে নিয়ে দ্রুত ঘটনাস্থল ত্যাগ করেন।
পিটার ডি হাস সুমনের বাসায় যাওয়ার পর সেখানে হাজির হন মায়ের কান্না নামের সংগঠনের সদস্যরা। তারা জিয়াউর রহমানের শাসনামলে মানবাধিকার লঙ্ঘন নিয়ে একটি স্মারকলিপি দেয়ার চেষ্টা করেন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূতের কাছে। ফাইল ছবি
এরপর যুক্তরাষ্ট্রের দূত সোজা চলে যান পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে। মন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেনের কাছে গিয়ে নিজের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ জানান তিনি।
মোমেন তখন তার কাছে জানতে চান, কোনো হামলা হয়েছে কি না। ‘না’ জবাব আসার পর তিনি প্রস্তাব দেন নিরাপত্তা বাড়াতে। তবে এটি জানিয়ে দেন, কোনো সংগঠনের কর্মসূচি তারা আটকাতে পারেন না।
হাসের এই পদক্ষেপে সরকার যে অসন্তুষ্ট তা গোপন করার চেষ্টা হয়নি এতটুকু।
সেদিনই বুদ্ধিজীবী দিবসের আলোচনায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘আমেরিকা খুনিদের মানবাধিকার নিয়ে ব্যস্ত।’
একই আলোচনায় আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের পিটার হাসকে উদ্দেশ করে জানতে চান- আমেরিকায় মাসে কত গুম, খুন ও ধর্ষণ হয়।
- আরও পড়ুন: খুনিদের মানবাধিকার নিয়ে ব্যস্ত আমেরিকা: প্রধানমন্ত্রী
- আরও পড়ুন: সুমনের বাড়ি গেছেন, আমেরিকায় মাসে কত গুম: হাসকে কাদের
পরদিন তথ্যমন্ত্রী হাছান মাহমুদ সাংবাদিকদের জানান, তিনি মনে করেন, হাসের সেই বাড়িতে যাওয়া উচিত হয়নি।
তিনি বলেন, ‘আমি জানি না তাকে কে পরামর্শ দিয়েছে সেই দিনে মায়ের ডাক নামের সংগঠনের কো-অর্ডিনেটরের বাসায় যেতে। যারাই এ পরামর্শ দিয়েছে, তারা সঠিক পরামর্শ দেয়নি। আমি মনে করি, যেই পরামর্শ দিক, সিদ্ধান্ত তো নিজের। কাজেই উনারও আসলে দিবসের দিকে লক্ষ্য রাখা দরকার ছিল।’
হাসের পাশে বিএনপি
সরকারের পক্ষ থেকে হাসের পদক্ষেপের সমালোচনা হলেও বিএনপি সমর্থন করছে যুক্তরাষ্ট্রের দূতকে। তাদের অভিযোগ, যুক্তরাষ্ট্রের দূতের গাড়িতে হামলা হয়েছে।
এমরান সালেহ প্রিন্স বলেন, ‘পিটার হাসের সঙ্গে রাজধানীর শাহীনবাগে যে ঘটনা ঘটেছে সেটা দুঃখজনক। আওয়ামী দুঃশাসনের কবল থেকে শুধু দেশের জনগণ নয়, বিদেশিরাও নিরাপদ নয়। রাষ্ট্রদূত পিটার হাসের গাড়িতে হামলা তারই প্রমাণ।
‘আওয়ামী লীগের নির্দেশেই এটি হয়েছে। এর মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হবে।’
বিএনপির নয়াপল্টন কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলনে দলের ভারপ্রাপ্ত দপ্তর সম্পাদক এমরান সালেহ প্রিন্স। ছবি: নিউজবাংলা
এই ঘটনার পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন যে ভাষায় বক্তব্য দিয়েছেন, তারও সমালোচনা করেন এই বিএনপি নেতা।'
তিনি বলেন, ‘এসব বক্তব্যই প্রমাণ করে যে এর সঙ্গে তারা জড়িত। তারাই উসকানি দিয়ে, সেখানে লোক পাঠিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের পতাকাবাহী গাড়িতে আঘাত করিয়েছে। রাষ্ট্রদূতকে হেনস্তা করা হয়েছে। এর আগেও রাষ্ট্রদূতের গাড়িতে এই সরকারের নির্দেশে হামলা করা হয়েছে। এই কথা কেউ ভুলে যায়নি।’
‘সংঘাত এড়াতে গণমিছিল স্থগিত’
সংঘাত এড়াতে আগামী ২৪ ডিসেম্বর রাজধানীতে বিএনপির গণমিছিল কর্মসূচি স্থগিত করার কথা জানান প্রিন্স।
১০ ডিসেম্বর ঢাকায় বিএনপির বিভাগীয় সমাবেশ থেকে ঘোষণা করা ১০ দফা দাবি আদায়ে ২৪ ডিসেম্বর ঢাকায় গণমিছিলের ডাক দেয়া হয়।
পরে বিএনপি যাদেরকে নিয়ে যুগপৎ আন্দোলনের কথা বলছে, তারাও একই দিনে একই কর্মসূচির ডাক দেয়।
কিন্তু সেদিন ঢাকায় আওয়ামী লীগের ২২তম জাতীয় সম্মেলন। একই দিনে বিএনপি ও সমমনা দলগুলোর এই কর্মসূচি ঘোষণা নিয়ে রাজনৈতিক উত্তেজনার আশঙ্কা তৈরি হয়।
আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে বিএনপির এই কর্মসূচিকে ‘সরাসরি সংঘাতের উসকানি’ বলে সমালোচনা করা হয়। পরে বিএনপি সেই কর্মসূচি স্থগিত করে।
প্রিন্স বলেন, সংঘাত এড়াতে ২৪ ডিসেম্বরের কর্মসূচি স্থগিত করা হয়েছে।‘
সেই মিছিল কবে হবে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘পরবর্তী সিদ্ধান্ত হলে জানিয়ে দেয়া হবে।’
বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা আবুল খায়ের ভুইয়া, দলের সহ-দপ্তর সম্পাদক তাইফুল ইসলাম টিপু, ঢাকা বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক আব্দুস সালাম আজাদ, ঢাকা মহানগর দক্ষিণ বিএনপির সাবেক সাধারণ সম্পাদক কাজী আবুল বাশার সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন।