মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনায় খ্যাতিমান চিত্রপরিচালক তারেক মাসুদ এবং শহীদ বুদ্ধিজীবী মুনীর চৌধুরীর ছেলে এটিএন নিউজের সাবেক প্রধান নির্বাহী মিশুক মুনীর নিহত হওয়ার মামলায় বিচারিক আদালতে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড পান বাসচালক জামির হোসেন।
বিচারিক আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে আপিল নিষ্পত্তির আগেই কারাবন্দি অবস্থায় ২০২০ সালের ১ আগস্ট মারা যান জামির। কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগারে থাকার সময়ে ঈদের দিন তিনি হৃদরোগে আক্রান্ত হয়েছিলেন, পরে রাজধানীর একটি হাসপাতালে নেয়ার পর চিকিৎসক তাকে মৃত বলে জানান।
দুর্ঘটনার জন্য বিচারিক আদালতে জামির দোষী সাব্যস্ত হলেও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) দুর্ঘটনা রিসার্চ ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ড. সামছুল হকের অনুসন্ধানে দাবি করা হয়েছে, বাসচালক জামির ছিলেন ‘নির্দোষ’। তিনি মনে করছেন, জামির হোসেন নয়, ওই দুর্ঘটনার মূল দায় ছিল তারেক মাসুদদের বহনকারী মাইক্রোবাসের চালক মোস্তাফিজুর রহমানের। দুর্ঘটনায় মোস্তাফিজও মারা যান।
তবে অধ্যাপক সামছুল হকের গবেষণাকে ‘বিজ্ঞানের দোহাই দেয়া মনগড়া’ আখ্যায়িত করে তা প্রত্যাখ্যান করে বিবৃতি দিয়েছেন ক্যাথরিন মাসুদ, নাহিদ মাসুদ, দিলারা বেগম জলি, ঢালী আল মামুন, মনিস রফিক, মো. সাইদুল ইসলাম সাঈদ ও মঞ্জুলী কাজী।
তাদের অভিযোগ, অধ্যাপক হক বাস মালিক-শ্রমিক নেতাদের মতো ‘স্বার্থান্বেষী মহলের মদতপুষ্ট হয়ে’ এমন কাজ করেছেন।
তারেক মাসুদ (বাঁয়ে) ও মিশুক মুনীরএই বিবৃতির পরিপ্রেক্ষিতে ড. সামছুল হক বলছেন, তিনি মাইক্রোবাসে তারেক মাসুদ ও মিশুক মুনীরদের সহযাত্রী-স্বজনদের ক্ষোভের প্রতি শ্রদ্ধাশীল, তবে তার অনুসন্ধানে পাওয়া তথ্য ‘বিজ্ঞানের রূঢ় বাস্তবতা’।
যা আছে বিবৃতিতে
নাহিদ মাসুদ শুক্রবার সবার পক্ষ থেকে সংবাদমাধ্যমে বিবৃতিটি পাঠান।
এতে বলা হয়, ‘মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনা নিয়ে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষক অধ্যাপক সামছুল হক যে অপপ্রচার চালাচ্ছেন আমরা ওই দুর্ঘটনায় আহত এবং নিহত চলচ্চিত্র কর্মীদের স্বজন ক্ষুব্ধ, আশ্চর্য ও মর্মাহত।
“দুর্ঘটনার এক দশক পরে, এ ব্যাপারে মাননীয় আদালতে একটি মামলার রায় নিষ্পত্তি হওয়ার পর এবং একটি মামলা এখনও বিচারাধীন থাকা অবস্থায় এই শিক্ষক ও তার সহযোগী গোষ্ঠী সুপরিকল্পিতভাবে তার ভাষায় একটি ‘বিজ্ঞানসম্মত’ ব্যাখ্যা দিয়ে বলছেন– বাসের চালক নয়, একটি ভ্যানচালক ও চলচ্চিত্র কর্মীদের গাড়ির চালক ভুল দিকে ছিল বলে সংঘর্ষ হয়েছে।”
বিবৃতিতে বলা হয়, ‘দুই বছর আগেও তিনি এই নিয়ে আলোচনা সভা করেছেন ও অনলাইন মিডিয়াতে তার মতবাদ প্রকাশ করেছেন। আমরা তখন কোনো জবাব দিইনি, কারণ যা সত্য তা অনেক আগেই প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে। সম্প্রতি তিনি একই মতবাদ আবার শুধু নিজে প্রচার নয়, উচ্চপর্যায়ের সরকারি ও সরকারি দলের কর্তা ব্যক্তিদের মাঝে প্রচারণা ও উসকানি ছড়াচ্ছেন।
‘কর্তা ব্যক্তিদের একজন এমন মন্তব্য করেছেন যা শুধু আমাদের কেন, আইনের শাসনব্যবস্থার প্রতি বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শন। আমরা মনে করি, এহেন একজন ব্যক্তিবিশেষের মতবাদকে সত্য বলে প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা উদ্দেশ্যপ্রণোদিত এবং বাস মালিক শ্রমিক নেতাদের মতো স্বার্থান্বেষী মহলের মদদপুষ্ট।’
তারেক মাসুদ ও ক্যাথরিন মাসুদঘটনাস্থলের যেসব ছবি, ভিডিও এবং অডিও দিয়ে অধ্যাপক হক তার মতবাদ জোরালো করেছেন তা দুর্ঘটনার দিন থেকে জনগণের কাছে উন্মুক্ত ছিল বলেও উল্লেখ করা হয় বিবৃতিতে।
এতে বলা হয়, ‘দুর্ঘটনাস্থলে কোনো সিসিটিভি ছিল না, কাজেই ঘটনাস্থলের প্রত্যক্ষদর্শী এবং গাড়ির জীবিত যাত্রীরা প্রকৃত ঘটনার সবচেয়ে সুনির্দিষ্ট বর্ণনা দিতে পারবেন। অধ্যাপক হকের তথাকথিত বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ, তার প্রাপ্ত তথ্যের ওপর ভিত্তি করে তৈরি একটি ধারণামাত্র। তার কাছে যদি তথ্য থেকেও থাকে তবে তা বড়জোর আংশিক, কারণ তিনি গাড়ির জীবিত কোনো যাত্রীর সঙ্গে কথা বলেননি।
‘মামলা চলাকালীন আদালতে সাক্ষ্য দেয়ার কথাও ভাবেননি আর মামলার বিবাদী পক্ষও তাকে সাক্ষী তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করেনি। অন্যদিকে জীবিত সাক্ষীরা আদালতে জবানবন্দিতে আমরা যা দেখেছি তাই বলেছি– মাইক্রোবাস বাঁ লেনেই ছিল। ওই ভয়ানক মুহূর্তটি আমরা কখনও ভুলব না।’
মানিকগঞ্জে সেই ভয়াবহ দুর্ঘটনার পর প্রশস্ত করা হয়েছে রাস্তার বাঁক, বসানো হয়েছে ডিভাইডারবিবৃতিতে বলা হয়, ‘আমাদের আশঙ্কা বাস মালিক-শ্রমিক নেতাদের স্বার্থ রক্ষার্থে এই অপপ্রচার করা হচ্ছে। আমরা আহ্বান জানাব, এ ধরনের অপপ্রচারের মাধ্যমে বাংলাদেশে সড়ক দুর্ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্ত পরিবার সবাইকে আর অপমানিত করা হবে না।
‘এই সড়ক দুর্ঘটনার মীমাংসিত ও চলমান মামলাগুলোকে বাংলাদেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় একটি যুগান্তকারী মাইলফলক, তাকে অযথা প্রশ্নবিদ্ধ করলে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত যাত্রী ও চালকদের পরিবার ন্যায়বিচার প্রত্যাশা করার বিশ্বাস হারিয়ে ফেলবে। এর চেয়ে দুঃখজনক আর কিছু হতে পারে না।’
বিজ্ঞান রূঢ়, কিন্তু বিজ্ঞান দিয়েই বিশ্লেষণ করেছি: ড. সামছুল হক
এই বিবৃতির পরিপ্রেক্ষিতে পরিবহন বিশেষজ্ঞ ও বুয়েটের অধ্যাপক ড. সামছুল হক নিউজবাংলাকে বলেন, ‘ওনারা যেহেতু ভিকটিমের ফ্যামিলি, আমি তাদের শ্রদ্ধা জানাই। প্রতিক্রিয়া স্বাভাবিকভাবেই তারা তাদের মতো করে দেবেন। তবে আমরা যারা গবেষণা করি তারা কোনো পক্ষে-বিপক্ষে নয়, বরং বিজ্ঞানের মাধ্যমে সত্যটাকে অনুধাবনের জন্য করি।’
তিনি জানান, নিজের গবেষণাটি তিনি আইনমন্ত্রী আনিসুল হককে ও মামলার বাদীপক্ষের আইনজীবী সারা হোসেনকে অনেক আগেই দেখিয়েছেন।
তিনি বলেন, ‘আইনমন্ত্রী নিজেও বলেছেন, সড়কের দুর্ঘটনা রিপোর্টগুলো আমাদের প্রচলিত পদ্ধতিতে দেয়া উচিত নয়।’
গবেষণাটি করার পেছনে দুটি লক্ষ্য রয়েছে অধ্যাপক সামছুল হকের। প্রথমটি হলো, বিচারিক আদালতে এ ধরনের মামলার বিচারের ক্ষেত্রে যেন একটি বিশেষ কারিগরি কমিটি গঠন করা যায়। অন্যটি হলো, এ ধরনের অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা যেন আর না ঘটে।
তিনি বলেন, ‘দুর্ঘটনার পেছনে গাড়ির ত্রুটি দায়ী থাকতে পারে, অপারেশনে ত্রুটি থাকতে পারে, এনফোর্সমেন্ট ত্রুটি থাকতে পারে এগুলো বেশ জটিল। বাইরের দেশে ইনস্যুরেন্স ক্লেইম দিতে হয়ে এবং তদন্ত প্রক্রিয়া শেষ করার জন্য বিজ্ঞানভিত্তিক একটি আলাদা তদন্ত হয়। তবে বাংলাদেশে এমন ব্যবস্থা বা তদন্তের কোনো সুযোগ রাখা হয়নি।’
পরিবহন বিশেষজ্ঞ ও বুয়েটের অধ্যাপক ড. সামছুল হকড. হক নিউজবাংলাকে বলেন, ‘এই মেসেজটা দেয়াই ছিল আমার মূল উদ্দেশ্য, যাতে করে আমরা এ ধরনের বিচারগুলো বিশেষ দৃষ্টিতে দেখি এবং এ ধরনের ঘটনার যাতে পুনরাবৃত্তি না হয়।’
তিনি বলেন, ‘আমার পূর্ণাঙ্গ রিপোর্টে দুর্ঘটনাটির প্রথম দায় দিয়েছি সড়ক বিভাগকে। আমার কমিউনিটি, আমার শিক্ষার্থীরা এতে রাগ করবেন কি না, আমি সেটা বিবেচনায় নিইনি। তথ্য-উপাত্ত নির্দেশ করছিল, ওই রাস্তার যথেষ্ট ত্রুটি ছিল। এর দায় তারা এড়াতে পারে না।
‘সেই সঙ্গে বিআরটিএ দায় এড়াতে পারে না। গাড়িটি দুই বছর ধরে ফিটনেসবিহীন, রুট পারমিটবিহীন চলছিল। পুলিশও এর দায় এড়াতে পারে না।’
তিনি বলেন, ‘তারপর আমি এসেছি বিচার-বিশ্লেষণে। এতে দেখেছি যেভাবে তথ্য-উপাত্ত উপস্থাপন করে বাসচালকের দায় নির্ধারণ করা হয়েছে, সেই প্রক্রিয়াটি বিশুদ্ধ ছিল না। আমার দৃষ্টিতে এখানে একটা নিরপেক্ষ বিচার হয়নি। আমি সেই বার্তাটি দিতে চেয়েছি। আমি যদি ভিকটিম পরিবারের হতাম, হয়তো আমিও এতে ক্ষুব্ধ হতাম।’
ড. সামছুল হকের মতে, বিজ্ঞান হলো এমন একটা বিষয় যা সব সময় সত্যকে তুলে ধরে।
তিনি বলেন, ‘আমি তাদের (বিবৃতি দানকারীদের) অনুভূতিকে শ্রদ্ধা জানাই। সেখানে তথাকথিত বা এ ধরনের অন্য কিছু তারা বলে থাকলেও, আমি মনে করি এটা অনুভূতির একটি বহিঃপ্রকাশ। তবে বিজ্ঞান রূঢ়। এই বিজ্ঞানের সাহায্যে আমি ঘটনাটিকে বিশ্লেষণ করেছি।
‘আমার মোদ্দা কথা হলো, কোথাও আগুন ধরার ঘটনা পরে বিচারিক আদালতে গড়ালে, সেখানে কিন্তু বৈদ্যুতিক শর্টসার্কিট বা ইলেকট্রিক ম্যালফাংশনের বিষয়গুলো চিহ্নিত করতে একটা বিশেষজ্ঞ টিম থাকে। এটা হলো টেকনিক্যাল ব্যাপার। পুরো পৃথিবীতে দুর্ঘটনার ক্ষেত্রে যে তদন্তটি হয় সেটি সবচেয়ে জটিল।’
মাইক্রোবাস আরোহীদের সঙ্গে কথা না বলা, সিসিটিভি ফুটেজ না থাকার যে বিষয়গুলো বিবৃতিতে এসেছে তা নিয়েও কথা বলেন ড. সামছুল হক।
তিনি বলেন, ‘বিশ্লেষণ যদি পুরোটা দেখা হয়, তাহলে দেখা যাবে কী পরিমাণ তথ্য-উপাত্ত সেখানে রয়েছে। তারা বললেন, এই দুর্ঘটনার ছবি সবার কাছে আছে। কিন্তু তারা যদি এটার বিশ্লেষণটা দেখতেন, আমার ধারণা তারা এভাবে কথা বলতেন না।’
ড. সামছুল হকের অনুসন্ধানের ভিত্তিতে নির্মিত ডক্যুফিল্ম ‘সোশ্যাল ক্রসফায়ার’-এর একটি দৃশ্যঅনুভূতি বা প্রতিক্রিয়া এবং বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধানকে আলাদা রাখতে চান অধ্যাপক হক। তিনি বলেন, ‘ছবি-তথ্য সবার কাছে আছে, কিন্তু একজনও রিড করতে পারেননি। দুর্ঘটনা বড় গাড়ি ও ছোট গাড়ির মধ্যে হলে কে কাকে ঠেলে সরিয়ে দেয়? প্রথমটি হলো সংঘর্ষ ঘটার অবস্থান, অপরটি সর্বশেষ অবস্থান। সর্বশেষ অবস্থানটা কিন্তু দুর্ঘটনার স্থান নয়।
‘ওনারা সত্যিকার অর্থে আমার প্রেজেন্টশনটা দেখলে হয়তো এটা বলতেন না। তখন তারা বিষয়টি জানতেন, তখন এমন কথা বলতে গেলে দ্বিধা হতো।’
সবার জন্য তার গবেষণাটি উন্মুক্ত জানিয়ে সামছুল হক বলেন, ‘আমি ওপেন মাইন্ডেড। যে কেউ যদি ব্যাখ্যা চায়, আমি আছি। দ্বিমত থাকতে পারে, কিন্তু আমি প্রচুর সময় দিয়ে বিশ্লেষণটি করেছি। যাতে বিজ্ঞানকে আমার মতো করে ব্যাখ্যা না করি।
‘দ্রুত ও বেপরোয়া গতির গতানুগতিক ধারণার বাইরেও যে বিজ্ঞান আছে, এর বাইরেও যে অন্য কোনো পক্ষের দায় থাকতে পারে, এই সিদ্ধান্তে আসতে গেলে উদারদৃষ্টি থাকতে হয়। উদার দৃষ্টি তৈরি হয় বিশ্লেষণগুলো দেখার পর। আমার কাজটি ছিল সেই বিশ্লেষণ তুলে ধরা। কেউ যদি স্বতঃস্ফূর্ত হয়ে ব্যাখ্যা চায় আমি দিতে প্রস্তুত। কারণ জ্ঞান সমাজের জন্য, দেশের জন্য, উন্নয়নের জন্য।’
কী আছে ড. সামছুল হকের অনুসন্ধানে
মর্মান্তিক ওই সড়ক দুর্ঘটনাটি নিয়ে নিউজবাংলাকে এর আগে নিজের পর্যবেক্ষণ তুলে ধরেছিলেন অধ্যাপক সামছুল হক। সে সময় তিনি বলেন, ‘তারেক মাসুদ ও মিশুক মুনীরের মৃত্যু অত্যন্ত হৃদয়বিদারক একটি ঘটনা। ওই দুর্ঘটনার পর পরই আমি এর কারণ গভীরভাবে খতিয়ে দেখতে শুরু করি। অনুসন্ধানের একদম শুরুতে কয়েকজন ঘনিষ্ঠ সাংবাদিক আমাকে ব্যাপক সহযোগিতা করেছিলেন।
‘তারা প্রথম দিনে ঘটনাস্থলের বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ ছবি আমাকে পাঠিয়েছিলেন। কিছু ছবি তোলা হয়েছিল উঁচু গাছ থেকে, যেগুলো আমার কাছে ছিল সারকামসটেন্সিয়াল এভিডেন্সের মতো। সেসব ছবি দেখে আমি বুঝেছিলাম, এখানে অনেক কিছু বলার মতো বিষয় লুকিয়ে আছে।’
তিনি বলেন, ‘সাংবাদিকদের কাছ থেকে আরও বেশ কিছু কনটেন্ট পেয়েছিলাম। এর মধ্যে একটি ভিডিও ছিল, যেখানে বাসের উইন্ডশিল্ডের কাছে বসা একজন নারীর কথা ছিল। তার সাবলীল বিবরণ থেকে আমি বুঝতে পেরেছিলাম, দুর্ঘটনাস্থল থেকে অনেক নতুন কিছু পাওয়ার আছে।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে রাখা সেই মাইক্রোবাসটির সামনে ক্যাথরিন মাসুদড. সামছুল হক নিজেও পরদিন দুর্ঘটনাস্থলে যান। বিভিন্ন আলামত নিবিড় পর্যবেক্ষণ করার পাশাপাশি কথা বলেন স্থানীয় লোকজন ও তদন্তসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে।
তিনি বলেন, ‘একে একে বিভিন্ন বিষয় আমার কাছে স্পষ্ট হচ্ছিল, সেই সঙ্গে সাধারণ বিবরণের মধ্যে গোঁজামিলগুলোও ধরা পড়ছিল। তখনও আমি দুর্ঘটনাকবলিত মাইক্রোবাসটি ভালোভাবে দেখতে পারিনি। ওটা একদম চ্যাপ্টা হয়ে গিয়েছিল। মাইক্রোবাসে কে কার পাশে বসেছিলেন, সেটা তখনও আমি জানতাম না।’
তিনি বলেন, ‘অনুসন্ধানের পাশাপাশি তদন্ত কমিটির রিপোর্টের অপেক্ষা করছিলাম। তিন সদস্যের এ কমিটির সঙ্গে আমার একজন সাবেক ছাত্রও যুক্ত ছিলেন। তিনি আমাকে অনেক সহযোগিতা করেছেন। একই সঙ্গে আমার কাছে যেসব তথ্য-প্রমাণ ছিল, সেগুলো একসূত্রে গাঁথার চেষ্টা করছিলাম। তবে এর মধ্যে খণ্ড খণ্ড বেশ কিছু মিসিং লিংক ছিল।
‘এর মধ্যেই ডেইলি স্টারে তারেক মাসুদের সহকারী মনিস রফিকের একটি সাক্ষাৎকার ছাপা হয়। মনিস ছিলেন মাইক্রোবাসচালকের ঠিক পাশের আসনে; দুর্ঘটনায় তিনিও সামান্য আহত হন। মনিসের বক্তব্য থেকে এমন কিছু বিষয় পাই, যেটি আমার প্রাথমিক অনুসন্ধানকে একটি কাঠামোর মধ্যে নিয়ে আসতে সাহায্য করে।’
ড. সামছুল হক বলেন, ‘সাধারণভাবে যেকোনো দুর্ঘটনা ঘটার আগে গাড়ির হার্ড ব্রেক কষার কথা। হার্ড ব্রেক অ্যাপ্লাই করলে রাস্তায় একটি স্কিড মার্ক পাওয়া যায়। আর সেই স্কিড মার্ক পেলে গাড়ির আসল অবস্থান চিহ্নিত করা যায়। অথচ আমি রাস্তায় কোনো স্কিড মার্ক পাইনি।
‘আমরা যারা দুর্ঘটনা বিষয়ে কাজ করি, তাদের কাছে বিষয়টি গোলমেলে। আমি তখন ভাবার চেষ্টা করছিলাম, বৃষ্টির কারণেই রাস্তায় হয়তো স্কিড মার্ক নেই। তবে সেটা মিলছিল না। স্কিড মার্ক এমন একটি বিষয় যার কোনো না কোনো চিহ্ন থাকবেই। কারণ এ সময় চাকার প্রচণ্ড ঘর্ষণে রাস্তার পাথরকুচি উঠে যায়।’
মানিকগঞ্জ থেকে ঢাকায় ফেরার পথে তারেক মাসুদ, মিশুক মুনীরদের দুর্ঘটনাকবলিত মাইক্রোবাসতিনি বলেন, ‘তাহলে কেন এ ধরনের চিহ্ন নেই- সেটি নিয়ে ঘুরপাক খাচ্ছিলাম। অবশেষে সেই প্রশ্নের জবাব পাওয়া গেল মনিস রফিকের সাক্ষাৎকারে। তিনি বলেছিলেন, সেদিন মুষলধারে বৃষ্টি হচ্ছিল। মাইক্রোবাসের পেছন দিকে যাত্রীরা মুখোমুখি বসে তুমুল আড্ডায় মেতেছিলেন। তার কথার প্রতিটি বিষয় আমার সামনে একেকটি চিত্র তৈরি করছিল। মাইক্রোবাসে মুখোমুখি কী করে বসা যায়! তার মানে সেটির আসনে পরিবর্তন আনা হয়েছিল। মনিস আরও বলেন, হঠাৎ একটি বাস দৈত্যের মতো তাদের মাইক্রোবাসে আঘাত করে।’
এই ‘হঠাৎ’ শব্দটি অনেক প্রশ্নের জবাব পাইয়ে দেয় ড. শামছুল হককে। তিনি বলেন, ‘হঠাৎ হলেই তো গাড়ির স্কিড মার্ক পাওয়া যায় না! কিছু দূর আগে থেকে দেখতে পেলেও হার্ড ব্রেক কষা সম্ভব, কিন্তু কী এমন পরিস্থিতি সেখানে তৈরি হয়েছিল যে কারণে বাসটিকে তারা হঠাৎ দেখতে পেলেন!’
এরপর আবার দুর্ঘটনাস্থলে যান ড. সামছুল হক। এ সময় স্থানীয় একজনের বক্তব্য পাওয়া যায়। এ ছাড়া পত্রিকায় প্রত্যক্ষদর্শী কয়েকজনের বক্তব্য ছাপা হয়।
এসব থেকে পরিষ্কার হয়, দুর্ঘটনার ঠিক কিছু আগে একটি বড় বাস রাস্তার বাঁকে দাঁড়িয়ে থাকা একটি অটোরিকশাকে ওভারটেক করে। ওই বাসটির পিছু পিছু একই দিকে যাচ্ছিল তারেক মাসুদদের মাইক্রোবাস। ওই বাসটির পিছু নিয়ে তারেক মাসুদদের মাইক্রোবাসটি অটোরিকশাকে একইভাবে ওভারটেক করতে বাঁকের মুখে নিজের ডান লেনে চলে গিয়েছিল। এ সময়েই বাঁকের বিপরীত দিক থেকে আসা জামির হোসেনের বাসের সঙ্গে মাইক্রোবাসটির সংঘর্ষ হয়।
ড. সামছুল হকের বিশ্লেষণ অনুযায়ী, দুর্ঘটনার ঠিক আগমুহূর্তে মাইক্রোবাস ও বাসের অবস্থানড. সামছুল হক বলেন, ‘অটোরিকশাকে ওভারটেক করা বাসটির চালক কিন্তু বাঁকের অন্য প্রান্তে বিপরীত দিক থেকে আসা চুয়াডাঙ্গা ডিলাক্সের বাসটিকে দেখতে পেয়েছিলেন। এর পরও তিনি ক্যালকুলেটেড (হিসাব করা) ঝুঁকি নিয়ে অটোরিকশাকে ওভারটেক করে আবার নির্ধারিত বাঁ লেনে বাসটিকে ফিরিয়ে নিয়ে যান। মহাসড়কে চলাচলকারী বাস-ট্রাক সাধারণত এ ধরনের হিসাবি ঝুঁকি নিতে অভ্যস্ত।
‘তারেক মাসুদদের মাইক্রোবাসটিও সামনের বাসটিকে অনুসরণ করে ডান লেনে চলে যায়। তবে একজন শহুরে চালকের জন্য কাজটি ছিল মারাত্মক ভুল। সামনের বাসের মতো তিনি আর মাইক্রোবাসকে আবার বাঁ লেনে নিতে পারেননি। আর এই ভুলের কারণেই বিপরীত দিক থেকে আসা চুয়াডাঙ্গা ডিলাক্সের বাসটির সঙ্গে মাইক্রোবাসের সংঘর্ষ হয়।’
বিপরীত দিকের বাসের চালক জামির বাঁকের মুখে নিজের সঠিক বাঁ লেনেই ছিলেন বলে মনে করছেন ড. সামছুল হক।
তিনি বলেন, ‘উল্টো দিকে আকস্মিকভাবে ভুল লেনে চলে আসা মাইক্রোবাসের বিষয়ে চুয়াডাঙ্গা ডিলাক্সের বাসচালক জামির হোসেনের কোনো প্রস্তুতি ছিল না। কারণ বাঁকের উল্টো দিক থেকে তিনি মাইক্রোবাসটিকে দেখতেই পাননি। আর এ জন্যই সেই হঠাৎ দুর্ঘটনা, যেখানে বাসচালক ব্রেক কষারও সময় পাননি।’
মাইক্রোবাসের সঙ্গে যেভাবে বাসের সংঘর্ষদুর্ঘটনার পর মাইক্রোবাসটিকে বিধ্বস্ত অবস্থায় রাস্তায় এর বাঁ দিকের লেনে পাওয়া যায়। ফলে মামলার রায়ে বিচারিক আদালতের বিচারক বিষয়টির উল্লেখ করে বলেন, ‘অবস্থাদৃষ্টে প্রতীয়মান হয় যে মাইক্রোবাসটি তার সঠিক লেনেই ছিল।’
তবে ড. সামছুল হক বলেন, এখানে বোঝার ভুল আছে। বিষয়টির বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে সড়ক দুর্ঘটনা নিয়ে দীর্ঘদিন কাজ করা ড. সামছুল হক নিউজবাংলাকে বলেন, “সাংবাদিক বন্ধুদের কাছ থেকে আমি দুর্ঘটনাকবলিত মাইক্রোবাসটির টার্মিনাল পজিশনের বেশ কিছু ছবি পেয়েছিলাম। একটি দুর্ঘটনাকে বিশ্লেষণের জন্য ‘টার্মিনাল পজিশন’ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এটা হলো দুর্ঘটনার পর মাইক্রোবাসটির চূড়ান্ত অবস্থান।”
মাইক্রোবাসে যাত্রীদের অবস্থান এবং যেভাবে আঘাততিনি বলেন, “এখানে লক্ষ করার বিষয় হলো, একটি বাসের সঙ্গে সংঘর্ষের পর কোনো মাইক্রোবাস যদি তার ‘সঠিক’ লেনে থাকে (যদিও সে অবস্থানটিও ছিল রাস্তার মাঝ বরাবর), তাহলে ধরে নিতে হবে দুর্ঘটনার আগের চিত্র ছিল অন্যরকম। কারণ একটি বাসের যে ভর ও গতি, তাতে সংঘর্ষের পর মূল অবস্থান থেকে মাইক্রোবাসটির বেশ কিছুটা দূরে সরে যাওয়ার কথা। মাইক্রোবাসের জীবিত আরোহীদের বক্তব্যেও সেটি জানা গেছে। ফলে দুর্ঘটনার পর মাইক্রোবাসটিকে রাস্তার মাঝ বরাবর পাওয়ার অর্থ হলো, প্রকৃতপক্ষে সেটি রং সাইডে ছিল। ধাক্কা খাওয়ার পর এর টার্মিনাল পজিশনটি পাওয়া গিয়েছিল মধ্যরাস্তায়।
“আর দুর্ঘটনার আগে মাইক্রোবাসটি সত্যিই নিজের বাঁ লেনে থাকলে ধাক্কা খাওয়ার পর সেটির রাস্তার কিনারায় বা রাস্তার পাশে চলে যাওয়ার কথা ছিল। এটাই হলো বিজ্ঞান। অথচ বিচারপ্রক্রিয়ায় এই বিজ্ঞানকে বিবেচনায় নেয়া হয়নি।”
দুর্ঘটনার পর মাইক্রোবাস ও বাসটির অবস্থানতিনি বলেন, ‘দুর্ঘটনার পর মাইক্রোবাসের অবস্থা দেখে পরিষ্কার বোঝা গেছে, বাসের সঙ্গে এর আংশিক মুখোমুখি সংঘর্ষ হয়েছিল। ডিভাইডারবিহীন একটি সড়কে এ ধরনের আংশিক মুখোমুখি সংঘর্ষ হতে হলে দুটি যানের যেকোনো একটিকে রং সাইডে থাকতে হয়। এ ক্ষেত্রে মাইক্রোবাস ও বাসের অবস্থান এবং সংঘর্ষে সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত অংশ দেখে পরিষ্কার বোঝা যায়, মাইক্রোবাসটিই ওভারটেক করতে গিয়ে রং সাইডে ছিল। দুর্ঘটনার পর সরকারের গঠিত তদন্ত কমিটি ও মানিকগঞ্জ জেলা পুলিশের প্রতিবেদনেও বিষয়টির উল্লেখ রয়েছে। তবে মামলার বিচারের ক্ষেত্রে সেটি বিবেচনায় নেয়া হয়নি।’
দুর্ঘটনার জন্য সে সময় রাস্তার ‘অবৈজ্ঞানিক’ বাঁককেও দায়ী করছেন ড. সামছুল হক।
তিনি বলেন, ‘১১ ফুট প্রশস্ত ওই রাস্তায় কোনো বাঁক থাকলে রাস্তার বক্রতার ধরন অনুসারে অংশটি অন্তত ১৩ ফুট চওড়া হওয়ার কথা ছিল। তবে বাস্তবে তা ছিল না। একই সঙ্গে বাঁকটিতে গাছপালা থাকায় দৃষ্টিসীমা ছিল একদম কম।
‘ঢাকা-আরিচা মহাসড়কে যেসব ব্ল্যাকস্পট ছিল, এই বাঁকটি তার একটি। মানিকগঞ্জের জোকায় তখন প্রতিবছর তিনটির বেশি করে দুর্ঘটনা ঘটছিল। এখন সেখানে ডিভাইডার করা হয়েছে, রাস্তা চওড়া হয়েছে, ফলে এখন আর দুর্ঘটনা হচ্ছে না।’
সারা দেশকে নাড়া দেয়া ২০১১ সালের ওই সড়ক দুর্ঘটনায় তারেক মাসুদ ও মিশুক মুনীর ছাড়াও তাদের মাইক্রোবাসচালক মোস্তাফিজুর রহমান, প্রডাকশন সহকারী মোতাহার হোসেন ওয়াসিম ও জামাল হোসেন মারা যান। তারেক মাসুদের স্ত্রী ক্যাথরিন মাসুদ, শিল্পী ঢালী আল-মামুনসহ আহত হন পাঁচজন।
২০১১ সালের ১৩ আগস্ট মর্মান্তিক দুর্ঘটনার কয়েক দিন পরই জামির হোসেন মেহেরপুর গাংনীর চৌগাছা থেকে গ্রেপ্তার হন। তবে কয়েক মাস পরই জামিনে মুক্তি পান তিনি। এরপর ২০১৭ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি যাবজ্জীবন কারাদণ্ড পাওয়ার দিন থেকে মৃত্যুর আগপর্যন্ত তিনি কারাগারে ছিলেন।
রায় ঘোষণা নিয়ে বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদনে জানানো হয়, বিচারক দণ্ড ঘোষণার সময় আদালতের কাঠগড়ায় ‘নির্লিপ্ত’ দেখা যাচ্ছিল জামিরকে। রায়ের পর পুলিশ তাকে হাতকড়া পরিয়ে কারাগারে পাঠায়।
রায় ঘোষণার পর পুলিশ হেফাজতে বাসচালক জামির হোসেনবিচারক আদেশে বলেন, ‘জামির হোসেনের বিরুদ্ধে দণ্ডবিধির ৩০৪ ও ৪২৭ ধারার অভিযোগ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়েছে। তাকে ৩০৪ ধারায় দোষী সাব্যস্ত করে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড ও ৫ হাজার টাকা জরিমানা, অনাদায়ে আরও তিন মাস বিনাশ্রম কারাদণ্ড দেয়া হলো। আর দণ্ডবিধির ৪২৭ ধারার অপরাধে দোষী সাব্যস্ত করে দুই বছরের সশ্রম কারাদণ্ড ও ২ হাজার টাকা জরিমানা এবং অনাদায়ে আরও এক মাসের বিনাশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত করা হলো।’
আসামির উভয় দণ্ড একসঙ্গে চলবে বলেও আদেশ দেন বিচারক।
আরও পড়ুন: সেই বাসচালক জামিরের মৃত্যুর ২ বছরেও ঘূর্ণিজাল, জীবন সংশয়ে স্ত্রী
বিচার চলার সময় ৩২ জনের সাক্ষ্য নেয়া হয়। এর মধ্যে ছিলেন প্রত্যক্ষদর্শী ও বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) কর্মকর্তা। আসামির পক্ষে দুজন সাফাই সাক্ষ্য দেন।
বিচারক রায়ে বলেন, ‘এজাহার, অভিযোগপত্র, খসড়া মানচিত্র, বিআরটিএর চিঠি, জব্দ করা ভুয়া ও মেয়াদোত্তীর্ণ লাইসেন্স, নিশ্চিত মৃত্যু থেকে বেঁচে যাওয়া প্রত্যক্ষদর্শীর অভিন্ন ও অকাট্য সাক্ষ্যের ভিত্তিতে বলা যায়, আসামি বাসটিকে বৃষ্টি ও বাঁকের মধ্যে অবহেলার সঙ্গে বেপরোয়া গতিতে চালিয়ে একটি মিনিবাসকে ওভারটেক করে মাইক্রোবাসটিকে নির্মমভাবে আঘাত করেন। ফলে তারেক মাসুদ ও মিশুক মুনীরসহ পাঁচটি তরতাজা প্রাণ ঝরে যায়। আসামির বেপরোয়া আচরণ ও অবহেলার কারণেই পাঁচজনের মৃত্যু হয়।’
আসামির পক্ষে আদালতে সাফাই সাক্ষ্য দেন চুয়াডাঙ্গা ডিলাক্সের বাসটির যাত্রী শাহনেওয়াজ রয়েল ও অধ্যাপক নাসরিন আশরাফী।
তবে বিচারক রায়ে বলেন, ‘তাদের কেউই ওই বাসের যাত্রী হওয়ার প্রমাণ হিসেবে বাসের টিকিট আনেননি। এ দুজন সারা জীবনে এবং ঘটনার পর থেকে অসংখ্যবার বাসে ওঠার কথা। একটি নির্দিষ্ট দিনে কোন বাসে উঠেছিলেন তা মনে রাখা দুঃসাধ্য। তারা যদি ঘটনার পর কোনো ম্যাজিস্ট্রেট কিংবা তদন্তকারী কর্মকর্তার কাছে সাক্ষ্য দিতেন, তাহলে অনেকটাই বিশ্বাসযোগ্য হতো।
‘এ ছাড়া শাহনেওয়াজ সাক্ষ্য দেয়ার সময় বলেছেন, দুর্ঘটনাস্থলে কোনো বাঁক নেই। আর তিনি ছিলেন বাসের বাঁ দিকে চার আসন পেছনে। ফলে ডান দিকের বিষয় দেখা সম্ভবপর নয়। আর নাসরিন আশরাফীও বলেছেন, সেখানে বাঁক ছিল না। তার চশমার পাওয়ার ৩.৫০। ক্ষীণ দৃষ্টিশক্তির একজন বয়স্ক মহিলার পক্ষে দীর্ঘদিনের আগের বৃষ্টির মধ্যে সংঘটিত কোনো ঘটনার সঠিক বিবরণ দেয়া আদৌ সম্ভবপর নয়।’
বাসচালক জামির হোসেনদুর্ঘটনার দুই বছর পর ২০১৩ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি নিহতদের পরিবারের সদস্যরা মানিকগঞ্জে মোটরযান অর্ডিন্যান্সের ১২৮ ধারায় বাসমালিক, চালক ও ইনস্যুরেন্স কোম্পানির কাছ থেকে ক্ষতিপূরণ চেয়ে দুটি মামলা করেন।
পরে সংবিধানের ১১০ অনুচ্ছেদ অনুসারে জনস্বার্থে হাইকোর্টে বদলির নির্দেশনা চেয়ে আবেদন করলে ক্ষতিপূরণের মামলা দুটি হাইকোর্টে চলে আসে।
দীর্ঘ শুনানি শেষে ২০১৭ সালের ৩ ডিসেম্বর তারেক মাসুদের পরিবারকে ৪ কোটি ৬১ লাখ ৪৫২ টাকা ক্ষতিপূরণ দিতে বাসমালিক, চালক ও সংশ্লিষ্ট ইনস্যুরেন্স কোম্পানিকে নির্দেশ দেয় বিচারপতি জিনাত আরা ও বিচারপতি কাজী ইজারুল হক আকন্দের হাইকোর্ট বেঞ্চ। রায়ের কপি পাওয়ার তিন মাসের মধ্যে টাকা পরিশোধ করতে বলা হয়।
ক্ষতিপূরণের অর্থের মধ্যে বাসের (চুয়াডাঙ্গা ডিলাক্স) তিন মালিকের ৪ কোটি ৩০ লাখ ৮৫ হাজার ৪৫২ টাকা, বাসচালক জামির হোসেনের ৩০ লাখ টাকা এবং রিলায়েন্স ইনস্যুরেন্স কোম্পানির ৮০ হাজার টাকা দেয়ার কথা। এ টাকা ক্যাথরিন মাসুদ, তারেক মাসুদের ছেলে নিষাদ মাসুদ ও বৃদ্ধ মা নুরুন নাহার পাবেন বলে রায়ে বলা হয়।
হাইকোর্টের এই রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করে বাস মালিকপক্ষ, সেটি এখন আপিলে চূড়ান্ত নিষ্পত্তির অপেক্ষায়। অন্যদিকে মিশুক মুনীরের পরিবারের ক্ষতিপূরণ চেয়ে করা মামলাটি হাইকোর্টে শুনানির অপেক্ষায় রয়েছে।