চট্টগ্রামে কর্ণফুলী নদীর তলদেশে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেলের উত্তর টিউবের নির্মাণকাজও শিগগিরই শেষ হবে বলে আশা প্রকাশ করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
চট্টগ্রামে এক অনুষ্ঠানে গণভবন থেকে ভার্চুয়ালি যুক্ত হয়ে শনিবার টানেলের দক্ষিণ টিউবের পূর্তকাজের সমাপনী উদযাপন করেন প্রধানমন্ত্রী।
তিনি বলেন, ‘একটি টিউব শেষ হয়েছে বলে আজ উদ্বোধন করছি না। আমার আগ্রহ ছিল যে, এটা আমি একটু দেখতে চাই যে কেমন হলো। আমার কাছে এটা একটা বিস্ময়। নদীর তলদেশে এ ধরনের টানেল বিদেশে দেখেছি, কিন্তু আমাদের অঞ্চলে, দক্ষিণ এশিয়ায় এটাই প্রথম। কাজেই এটা দেখার একটা আগ্রহ ছিল।
‘যেহেতু আগামী ৪ ডিসেম্বর চট্টগ্রামে জনসভা করব, একবার যেতে হবে। তা ছাড়া আজ বিকেলে কর্মসূচি আছে মহিলা আওয়ামী লীগের সম্মেলন। এ জন্য সরাসরি আসতে পারলাম না, তবে মনটা পড়ে আছে চট্টগ্রামে। যদি গিয়ে দেখে আসতে পারতাম? দ্বিতীয় টিউবের কাজটাও শেষ হয়ে গিয়েছে, সামান্য কিছু কাজ বাকি। সেটাও সম্পন্ন হবে। আল্লাহর কাছে দোয়া করি, যাতে সুস্থ থাকি। এই টানেলটা যাতে দেখে যেতে পারি। সেটা যেন উপস্থিত হয়ে দেখতে পারি বা এটা দিয়ে যাতায়াত করতে পারি।’
সরকারপ্রধান বলেন, “এটা আমাদের জন্য বিরাট কাজ মনে করি। এটি নির্মাণে যারা জড়িত, তাদের সবাইকে ধন্যবাদ। কর্ণফুলীর এপার ওপারে গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় যেখানে আমরা বঙ্গবন্ধু বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তুলছি। আবার ওপারে আনোয়ারা ইন্ডাস্ট্রিয়াল বেল্ট আমাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। এই টানেল হওয়ায় দুই পাশই সমানভাবে উন্নত হবে। এটাকে বলা হচ্ছে ‘ওয়ান সিটি টু টাউন’। এটা সেভাবেই গড়ে উঠবে। টানেলের মাধ্যমে সে সংযোগটা তৈরি হবে।
“পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে বিনিয়োগ আসছে। আমাদের সেই সুযোগটা তৈরি হয়েছে। সেই সঙ্গে কক্সবাজারের যোগাযোগটাও দ্রুত হবে। আমরা মনে করি এই টানেল শুধু বাংলাদেশের জন্য না, দক্ষিণ এশিয়ার জন্য একটা পাওয়া। এর ফলে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হবে। অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড আরও গতিশীলতা পাবে। দেশের অর্থনীতিতে আরও বেশি অবদান রাখবে।”
টানেল নির্মাণ শুরুর অভিজ্ঞতা তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, “আওয়ামী লীগ সবসময় আলাদা চিন্তা করে। টানেল করতে আমরা পদক্ষেপ নিই। আমি বলেছিলাম, আমাদের কাগজ যেন সব রেডি থাকে; আমরা চীন যাচ্ছি সেখানে গিয়ে আলাপ করব। তারা যেন এই টানেলটা তৈরি করে দিতে আমাদের সহযোগিতা করে। প্রস্তাবটা প্রথম দিকে তারা গ্রহণ করতে চায়নি।
‘চীন সফরে ডিনারে বসেই চীনা প্রধানমন্ত্রীকে আমি এ প্রস্তাবটা দিই। তখন তিনি রাজি হয়ে যান। পরের দিনই আমাদের যাত্রা শেষ হওয়ার কথা। উনি রাজি হওয়ার পরপরই আমি বললাম, ‘আমাদের অফিসাররা কিন্তু প্রস্তুত আছে, আপনারা প্রস্তুত থাকলে তারা আলোচনায় বসতে পারে। আমরা আজকেই এটা সই করতে পারি।”
তিনি বলেন, ‘আমাদের কর্মকর্তা যারা ছিলেন, তারা কিন্তু খাবার শেষ করেননি। কেবল শুরু হয়েছে। সেগুলো বাদ দিয়েই তারা উঠে যান। তারা সব প্রস্তুত করে। আমি অপেক্ষা করি। পরে রাত ১২টায় আমরা যেখানে ছিলাম, সেখানে বসেই সই হয়।
‘আমাদের নিজস্ব অর্থে সমীক্ষা আমরা করি, যাতে সময় বেশি না লাগে। সমীক্ষা শেষের সঙ্গে সঙ্গে প্রকল্প প্রস্তুত করা, ডিজাইন করা সব কাজগুলো একই সাথে চলতে থাকে। এর ফলে আমরা আজকে কাজটা শেষ করতে সক্ষম হয়েছি।’
টানেল নির্মাণে সহযোগিতার জন্য চীনের প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রীকেও ধন্যবাদ জানিয়ে সরকারপ্রধান বলেন, ‘আজকে সবচেয়ে আনন্দের একটি দিন। কারণ যোগাযোগ ব্যবস্থায় ব্যাপক উন্নতি আমরা করতে পেরেছি। আমরা যে নতুন প্রযুক্তিগুলো ব্যবহার করেছি, কিছু দিন আগেই আমরা পদ্মা সেতু উদ্বোধন করলাম। যে পদ্মা সেতু নিয়ে এত বাধা অতিক্রম করতে হয়েছিলো আমাদের।
‘অনেক অপবাদ দিয়েছিল আমাদের। আমরা চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়েছিলাম, নিজেদের অর্থায়নে করব; কারও সাহায্যে না। বাংলাদেশ যে পারে, সেটা আমরা প্রমাণ করেছি পদ্মা সেতু নির্মাণের মধ্য দিয়ে। সম্পূর্ণ বাংলাদেশের অর্থে পদ্মা সেতু নির্মিত এবং এ নির্মাণকাজে আমাদের সহযোগী ছিল চীন। তাদের আমরা ধন্যবাদ জানাই।’
টানেলটি নির্মাণের ফলে ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম হয়ে কক্সবাজারের দূরত্ব ৪০ কিলোমিটার ও সময় প্রায় এক ঘণ্টা কমে আসবে। দুটি টিউব ও চার লেনের সড়কে নদীর তলদেশ দিয়ে পাঁচ মিনিটে চট্টগ্রামের পতেঙ্গা থেকে যাওয়া যাবে আনোয়ারায়।
পদ্মা সেতুর পর সরকারের মেগা প্রজেক্টগুলোর অন্যতম বঙ্গবন্ধু টানেল। ৩ দশমিক ৩২ কিলোমিটার এ টানেল নির্মাণব্যয় ধরা হয়েছে ১০ হাজার ৫৩৭ কোটি টাকা। আগামী জানুয়ারিতে যানবাহনের জন্য খুলে দেয়া হবে এটি।
এক নগরের দুই শহর সংযুক্ত করার ভাবনা থেকেই কর্ণফুলী টানেল নির্মাণের পরিকল্পনা করে সরকার।
সেতু বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে বাংলাদেশেই প্রথম নদীর তলদেশে চলবে যানবাহন।
চীনের সাংহাই শহরের আদলে ‘ওয়ান সিটি টু টাউন’ গড়ে তোলার লক্ষ্যে চট্টগ্রামের পতেঙ্গা ও আনোয়ারাকে যুক্ত করবে এ টানেল। এতে নগরের অংশ বাড়বে। সেই সঙ্গে নদীর তলদেশ দিয়ে কম সময়ে যাতায়াত সুবিধা নেবে দুটি আলাদা শহর। অন্যদিকে ঢাকা থেকে কক্সবাজারের দূরত্ব কমে আসবে।
রাজধানী থেকে কক্সবাজারগামী গাড়িগুলো ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে ফৌজদারহাট দিয়ে বন্দর টোল রোডের সঙ্গে নির্মিত আউটার রিং রোড-পতেঙ্গা হয়ে কর্ণফুলী টানেল ব্যবহার করলে চট্টগ্রামের দিকে পথ কমবে প্রায় ১৫ কিলোমিটার। এতে করে চট্টগ্রাম শহরে প্রবেশ না করেই সময় বাঁচাতে পারবেন চালকরা।
কর্ণফুলী টানেল দিয়ে আনোয়ারা উপজেলার সিইউএফএল ঘাট-চাতরি চৌমুহনী-বাঁশখালী-পেকুয়ার মগনামা হয়ে সরাসরি কক্সবাজার সদরে যুক্ত হলে সৈকত নগরীর দূরত্ব কমবে প্রায় ৩০ কিলোমিটারের মতো।
সেতু বিভাগ জানায়, উত্তর ও দক্ষিণ নামে দুটি টানেলের দৈর্ঘ্য ৩ দশমিক ৩২ কিলোমিটার। প্রতি টানেলে রয়েছে দুই লেনের প্রশস্ত রাস্তা।
এ দুই টিউব তিনটি সংযোগপথের (ক্রস প্যাসেজ) মাধ্যমে যুক্ত থাকবে। বিপদকালে অন্য টিউবে যাওয়ার জন্য ক্রস প্যাসেজগুলো ব্যবহার হবে।
২০১৬ সালের ১৪ অক্টোবর বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও চীনের প্রেসিডেন্ট শি চিন পিং টানেল প্রকল্পের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। ২০১৯ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রথম টানেল টিউবের বোরিং কাজ উদ্বোধন করেন।
২০২০ সালের ১২ ডিসেম্বর সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের দ্বিতীয় টিউবের বোরিং কাজ উদ্বোধন করেন।
৩ দশমিক ৩২ কিলোমিটার টানেলটি কর্ণফুলী নদীর মোহনার কাছে পশ্চিম প্রান্তে পতেঙ্গা নেভাল একাডেমির কাছ থেকে শুরু হয়ে পূর্ব প্রান্তে চট্টগ্রাম ইউরিয়া সার কারখানা (সিইউএফএল) ও কর্ণফুলী সার কারখানার (কাফকো) মাঝখান দিয়ে আনোয়ারা প্রান্তে পৌঁছেছে।