পুরো ভারতীয় ক্রাইম সিনেমার মতো কাহিনি।
পেশা হিসেবে তেমন কিছু ছিল না। ছিঁচকে চুরিতে বারবার ধরা পড়ার পর একটি নেতিবাচক পরিচিতি গড়ে ওঠে তার। পরে রাজনীতিতে যোগ দিয়েই হয়ে ওঠেন প্রতাপশালী। বিপুল পরিমাণ সম্পদ গড়ার পর ভোটে নেমে হয়ে যান জনপ্রতিনিধিও।
নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জের চনপাড়ার বজলুর রহমান ওরফে বজলুরকে গ্রেপ্তারের পর উঠে আসছে তার মাদক কারবার, সন্ত্রাস আর ভীতির রাজ্যের কথা।
গ্রেপ্তারের পর জানানো হয়েছে, চনপাড়ায় সন্ত্রাসী ও মাদক কারবারিদের গুরু ছিলেন বজলুর। তার বিরুদ্ধে ২৩টি মামলার খোঁজ মিলেছে। তবে এসব মামলা তার ভীতি ছড়ানোর পথে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারেনি।
স্থানীয়রা জানান, যুবক বয়সে এলাকায় চুরির সঙ্গে জড়িত ছিলেন। পরে চাল বিক্রি করতে থাকেন। এরপর যোগ দেন রাজনীতিতে। তারপর পাল্টে যেতে থাকে সবকিছু। টাকার স্রোতে ভাসতে থাকেন তিনি। কিনতে থাকেন একের পর এক জমি আর বাড়ি।
বুয়েট শিক্ষার্থী ফারদিন নূর পরশ হত্যার পর এই চনপাড়া আলোচনায় এসেছে ব্যাপকভাবে। তদন্তে দেখা গেছে, সেই রাতে নারায়ণগঞ্জের এই বস্তিতে গিয়েছিলেন এই তরুণ, যেটি মাদক বিক্রির জন্য কুখ্যাত।
সেখানে মাদক কেনাবেচার নিয়ন্ত্রকদের একজন হিসেবে পরিচিত রাসেদুল ইসলাম শাহিন ওরফে সিটি শাহীন র্যাবের সঙ্গে কথিত বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয়েছেন।
এরপর গ্রেপ্তার হন বজলুর, যাকে চনপাড়া বস্তির মাদক কারবারিদের গুরু হিসেবে বলছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীটি। শুক্রবার ধরার পর তাকে রূপগঞ্জ থানায় দেয়া হয় পরদিন।
র্যাব-১-এর অধিনায়ক কর্নেল আব্দুল্লাহ আল-মোমেন নিউজবাংলাকে জানান, ‘বজলুর দীর্ঘদিন ধরে মাদক কারবারে জড়িত। নারায়ণগঞ্জ ছাড়াও বিভিন্ন জেলাতে তার বেশ কয়েকজন সহযোগী আছে।’
বজলুর কায়েতপাড়া ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) সদস্য ও প্যানেল চেয়ারম্যান।
বজলুরের বিরুদ্ধে যাওয়ায় চনপাড়ার স্বেচ্ছাসেবক লীগের সভাপতি শফিকুল ইসলামকেও নির্যাতনের শিকার হতে হয়েছে।
ক্ষমতাসীন দলের সঙ্গে সম্পৃক্ত এই নেতা বলেন, ‘চলতি মাসের শুরুর দিকে একটি মাইক্রোবাস গাড়ি এসে আমাকে নিয়ে তুলে নিয়ে যায়। তারপর দুই দিন, দুই রাত গাড়িটি বিভিন্ন এলাকায় নিয়ে আমাকে ঘুরাতে থাকে। পরে নামিয়ে দেয় বন্দরের লাঙ্গলবন ব্রিজের নিচে। তারপর সেখান থেকে আমি গিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হই। কিন্তু বজলুর ভয়ে এলাকায় আর যাইনি।’
চনপাড়া এলাকার কয়েকজন স্থানীয় বাসিন্দা নিউজবাংলাকে জানান, বজলুর তার নিরাপত্তার জন্য তিনজন অস্ত্রধারী রেখেছিলেন। গলায় মোটা সোনার চেইন ও পরনে সাদা লুঙ্গি আর ধূতি পাঞ্জাবি পরে চনপাড়ায় গলিতে অফিস বানিয়ে গোটা এলাকা নিয়ন্ত্রণ করতেন তিনি। কেউ তার বিরুদ্ধে গেলে মধ্য রাতে তার বাড়িতে হামলা হতো। এমনকি মামলা দিয়ে পাঠানো হতো। ভয় দেখানো হয় গুম করার।
বজলু গ্রেপ্তার হলেও আতঙ্ক কাটেনি চনপাড়ার বাসিন্দাদের। অলি-গলিতে এখনও তার অনেক লোকজন রয়েছে। তারা বজলুর ফিরে আসবে বলে ভয় দেখাচ্ছে অন্যদের।
বজলুরের গ্রেপ্তারের পর মিলাদ মাহফিল করে স্থানীয়রা
কে এই বজলুর, কীভাবে উত্থান
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারি বাহিনী ও স্থানীয়দের তথ্য বলছে, বরিশালের মুলাদি এলাকার নাদের বক্সের বখাটে ছেলে বজলুর। বয়স যখন ১০, তখনই বাবা-মার সঙ্গে আসেন চনপাড়ায়। পড়াশোনায় ছিল না আগ্রহ। একপর্যায়ে চুরিতে জড়িয়ে পড়েন।
এলাকায় ছিঁচকে চোর হিসেবে তার পরিচিতি ছিল। ১৯৮৯ সালে ডেমরার মীরপাড়া এলাকায় চুরি করতে গিয়ে পিটুনি খান। তার বিরুদ্ধে এখনও একাধিক চুরির মামলা রয়েছে। এরপর চুরির পেশা ছেড়ে চনপাড়া বস্তির ৬ নং ওয়ার্ডে খুচরা মূল্যে চাল বিক্রি শুরু করেন।
এমন একজন মানুষের এলাকায় ত্রাস হয়ে ওঠা আর একের পর এক জমি ও বাড়ি কিনে নেয়ার নেপথ্যে কী, এ নিয়ে মাদক কারবারের পাশাপাশি তার রাজনৈতিক প্রভাবের বিষয়টিও সামনে এসেছে।
আওয়ামী লীগের নেতারা বলছেন, চনপাড়ার প্রয়াত আওয়ামী লীগ নেতা আবু তাহেরের মাধ্যমে যোগ দেন স্থানীয় স্বেচ্ছাসেবক লীগে। বিগত ২০০৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর তিনি বেপরোয়া হয়ে ওঠেন। শুরু করেন মাদক কারবার।
এরপর উপজেলা আওয়ামী লীগের কার্যকরী সদস্যও হয়ে যান তিনি। ক্ষমতাসীন দলের রাজনীতি, জনপ্রতিনিধি আর মাদক ও সন্ত্রাসে সম্পৃক্ততা, সব মিলিয়ে বজলুরকে আটকানোর মতো আর কিছু ছিল না।
তবে আধিপত্যের শুরু মূলত স্বেচ্ছাসেবক লীগে আসার পর থেকে। তিনি সাহসী এবং যাকে তাকে যা খুশি করতে পারেন, এই বিষয়টি সামনে আসার পর এলাকায় আধিপত্য বিস্তারে অন্যদের হয়ে কাজে লাগতে থাকেন। পরে নিজেই বনে যান দণ্ডমুণ্ডের কর্তা। ভয়ভীতি দেখিয়ে সেখানে স্থানীয়দের বিচার সালিশ করতেন। এরপর ২০১১ সালের ইউপি নির্বাচনে সদস্য হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন।
কায়েতপাড়া ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি ও ইউপি চেয়ারম্যান জায়েদ আলী বলেন, ‘২০০৩ সালে তৎকালীন চনপাড়া আঞ্চলিক ইউনিয়ন কমিটির সভাপতি তাহেরের মাধ্যমে সাধারণ সম্পাদক হয় বজলুর। কয়েক বছর পর তাহের মারা যান। এরপর থেকে বজলুর কমিটির নিয়ন্ত্রণ নেয়।
‘সে তিনবার ইউপি সদস্য হয়েছে, এবার প্যানেল চেয়ারম্যান। চনপাড়ায় মূলত দুইটি গ্রুপ। আরেকটি হলো মহিলা ইউপি সদস্যের। সেখানে ঝামেলা লেগেই থাকে। এ কারণে আমি সেখানে যাই না। চেয়ারম্যান হওয়া সত্ত্বেও আমার চলাচল সেখানে নেই।’
তিনি জানান, সালে ২০১৭ সালে বজলুর তার ওপর হামলা করেন। এ ঘটনায় করা মামলা এখনও নিষ্পত্তি হয়নি।
চনপাড়ার নারী ইউপি সদস্য ও যুব মহিলা লীগের সাধারণ সম্পাদক রিতা আক্তার বলেন, ‘বজলুরের নেতা কে, তা আমি জানি না। তবে তিনি নেতা হয়ে চনপাড়া নিয়ন্ত্রণ করতেন। তার কথার বাইরে গেলে সমস্যা হতো চনপাড়ায়। এর বাইরে কিছু বলতে চাই না।’
ওই ইউনিয়নের সাবেক একাধিক ইউপি সদস্য জানান, বজলুর একজন পাট ও বস্ত্রমন্ত্রীর ব্যক্তিগত সহকারী (পিএস) এমদাদুল হকের ঘনিষ্ঠ। বজলুরের আপদ-বিপদ সব তিনিই দেখেন। তার কথামতো চলতেন বজলুর।
এমদাদ সিরাজগঞ্জের শাহাজাদপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের সদস্য। থাকেন ঢাকা।
তবে নিউজবাংলার কাছে এই অভিযোগ অস্বীকার করেছেন এমদাদুল। তিনি বলেন, ‘বজলুর আমার নির্দেশনায় চলত, এগুলো ভুয়া কথা। সে রাজনীতি করে, রাজনীতির স্বার্থে যেটুকু যোগাযোগ থাকা দরকার, সেটুকু ছিল৷ এর বাইরে আমার সঙ্গে কোনো যোগাযোগ ছিল না।’
বজলু মাদক কারবারি জানতে কি না, জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘সে ব্যাপারে আপনারা তদন্ত করে রিপোর্ট করেন।…আমার আসার আগে থেকেই সে চনপাড়ার সাধারণ সম্পাদক।’
শূন্য থেকে বিপুল সম্পদ
ছিঁচকে চোর থেকে ধনকুবের বনে যেতে সময় লেগেছে কেবল একটি যুগ। পুলিশের তথ্য বলছে, ডেমরা সারুলিয়া ইউনিয়ন পরিষদের পাশে ৬ তলা বাড়ি আছে তার। হাজীনগরে ১০ তলা আরেকটি বাড়ির কাজ চলছে। সেখানে একটি টিনশেডে বাড়িও আছে।
পশ্চিমগাঁও ও পূর্বগ্রামেও আছে টিনশেডের বাড়ি। সেখানে চারতলা এবং তিনতলার একটি করে এবং দুইতলা বড়ি আছে আরও দুইটি। একতলা বাড়ি আছে অন্তত চারটি। রাজধানীর বনশ্রীতে আছে ফ্ল্যাট।
রূপগঞ্জের পূর্বগ্রাম, পশ্চিমগাঁও, বরাব ও গাজীপুরের কালীগঞ্জে প্রায় এক শ বিঘা জমির মালিকও তিনি। চনপাড়াতে রয়েছে অর্ধশতাধিক প্লট। সেখানে পানি ব্যবসা, বিদ্যুৎ-সংযোগ ব্যবসা, রাস্তার কাজ, প্লট বিক্রি সবই ছিল তার নিয়ন্ত্রণে।
এক যুগে এমন উত্থানের নেপথ্যে অপরাধে সম্পৃক্ততার যে তথ্য, তা মুখে মুখে ঘুরলেও এতদিন কেন তাকে ধরা হয়নি, জানতে চাইলে নারায়ণগঞ্জের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (অপরাধ) আমির খসুরু নিউজবাংলাকে বলেন, ‘বজলুর বিরুদ্ধে অনেক মামলা আছে। কিন্তু যদি তিনি জামিনে থাকেন, তাহলে তাকে কীভাবে গ্রেপ্তার করব?
‘আমার জানামতে গত এক বছরে তাকে পুলিশ ধরেনি। আর তিনি যেহেতু জনপ্রতিনিধি সেহেতু তার প্রভাব তো সেখানে রয়েছে। আমরা তার নানা বিষয় নিয়ে তদন্ত করছি।’
কী কী অভিযোগ
র্যাব-১-এর অধিনায়ক নিউজবাংলাকে বলেন, ‘চনপাড়া এলাকার মাদকের প্রায় ২০০টি স্পট কয়েকটি সিন্ডিকেটের মাধ্যমে চালাতেন বজলুর। এর মধ্যে শীর্ষ ৫ থেকে ৬টি মাদক কারবারীর প্রধান সমন্বয়ক ও গডফাদার ছিলেন তিনি।’
তিনি জানান, মাদক বেচাকেনা ছাড়াও, চাঁদাবাজি, ভয়ভীতি, কিশোর সন্ত্রাসীদের নিয়ন্ত্রণ, ধর্ষণ, যৌন হয়রানি এমনকি হত্যার অভিযোগ আছে বজলুরের বিরুদ্ধে। কেউ চাঁদা না দিলে করা হতো নির্যাতন। গত এক-দেড় বছরে ওই এলাকায় এসব আধিপত্য বিস্তার নিয়ে নিহত হয়েছেন ছয়জন।
র্যাবের দাবি, প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে বজলুর স্বীকার করেছেন তিনি চনপাড়া বস্তিসহ আশেপাশের এলাকার মাদক বিক্রেতাদের কাছ কাছ থেকে মাসিক ভিত্তিতে টাকা তুলতেন।
গত ২৭ সেপ্টেম্বর চনপাড়া এলাকায় অভিযানে গেলে বজলুর নির্দেশেই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ওপর হামলা হয় বলেও জানিয়েছেন র্যাব-১ অধিনায়ক। জানান, জিজ্ঞাসাবাদে এই বিষয়টিও স্বীকার করেছেন তিনি।
নারায়ণগঞ্জের সিনিয়র সহকারী পুলিশ সুপার (রূপগঞ্জ) আবির হোসেন বলেন, ‘চনপাড়ায় বজলুর বিশাল এক নারী বাহিনীও আছে। তারা সেখানে শৃঙ্খলা সৃষ্টি করে। তবে অভিযান করলে অপরাধীদের নিয়েই বের হতো।’