স্বাধীনতার ৫০ বছরে দেশে কৃষি খাতে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জিত হলেও নিরাপদ খাদ্য নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। তবে কৃষি সংশ্লিষ্ট বিভাগ বলছে, সরকারের নজর এখন খাদ্য নিরাপত্তায়। এ নিয়ে পদক্ষেপও নেয়া হচ্ছে।
দেশে এখন একফসলি জমিতেও আবাদ হচ্ছে গড়ে দুটি ফসল। এলাকাভেদে এ চাষাবাদ গড়িয়েছে তিন থেকে চার ফসলেও। এতে বিশ্বের গড় উৎপাদন হারকে পেছনে ফেলে জনসংখ্যার হিসেবে নবম স্থানে থাকা বাংলাদেশ খাদ্যে হয়ে উঠেছে স্বনির্ভর।
প্রধান খাদ্যশস্য ধান উৎপাদনে বিশ্বে এখন তৃতীয় থেকে চতুর্থ অবস্থানে ওঠানামা করছে বাংলাদেশ। স্বাধীনতার আগে বেশি পরিমাণ জমি চাষাবাদে ফসল মিলত কম।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য মতে, ধানের পাশাপাশি সবজি উৎপাদনেও বাংলাদেশ এখন সারা বিশ্বে তৃতীয়। আম ও আলু উৎপাদনে সপ্তম এবং পেয়ারা উৎপাদনে অষ্টম স্থানে।
কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগ বলছে, বিশ্বজুড়ে প্রতি হেক্টরে শস্যের গড় উৎপাদন হার যেখানে প্রায় তিন টন, সেখানে বাংলাদেশে তা সোয়া চার টনে উন্নীত হয়েছে। ৫০ বছরে বাংলাদেশে গমের উৎপাদন দ্বিগুণ হয়েছে। সবজি উৎপাদন বেড়েছে পাঁচ গুণ। ভুট্টার উৎপাদন বেড়েছে ১০ গুণ।
১৯৭১ সালে দেশে যেখানে মোট দানাদার খাদ্যশস্য উৎপাদনের পরিমাণ ছিল ১ কোটি ১৮ লাখ টন, সেখানে ২০২১ সালে ৪ কোটি ৬৫ লাখ ৮২ হাজার টন খাদ্যশস্য উৎপাদন হয়েছে। ২০২০ সালে খাদ্যশস্য উৎপাদন হয়েছে প্রায় সোয়া ৪ কোটি টন। তবে দেশে সর্বোচ্চ উৎপাদনের রেকর্ড হয় ২০১৭ সালে। সে বছর দেশে খাদ্যশস্যের উৎপাদন হয় ৫ কোটি ৪২ লাখ ৬২ হাজার টন।
একই সঙ্গে ঘটছে কৃষির যান্ত্রিকীকরণ। গত ১০ বছরে সরকারি হিসেবেই প্রায় ৬৯ হাজার কৃষিযন্ত্র গ্রহণ করেছে কৃষক। এসব যন্ত্রে বড় অঙ্কের ভর্তুকি দিচ্ছে সরকার।
কৃষির যান্ত্রিকীকরণের জন্য সরকার ৩ হাজার ২০ কোটি টাকার একটি বড় প্রকল্প নেয়, যেটির তৃতীয় ধাপ ২০২০ সালে শুরু হয়। শেষ হবে ২০২৪ সালে।
দানাদার খাদ্যশস্যের সঙ্গে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদেও সমৃদ্ধির স্বাক্ষর রেখেছে বাংলাদেশ। সবজি ও মাছ উৎপাদনে বাংলাদেশের অবস্থান এখন বিশ্বে তৃতীয়। ইলিশ উৎপাদনে বাংলাদেশ বিশ্বে প্রথম। বিশ্বে ইলিশ উৎপাদনের ৮৬ শতাংশই হয় এ দেশে।
মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের তথ্য মতে, ২০০৮ থেকে ২০০৯ অর্থবছরে দেশে ইলিশের উৎপাদন ছিল ২ লাখ ৯৯ হাজার মেট্রিক টন। ২০১৯ থেকে ২০২১ অর্থবছরে তা বৃদ্ধি পেয়ে হয়েছে ৫ লাখ ৮৯ হাজার মেট্রিক টন। এ সময় উৎপাদন বেড়েছে ২ লাখ ৮০ হাজার মেট্রিক টন বা দ্বিগুণের কাছাকাছি।
পাট উৎপাদনে বাংলাদেশের অবস্থান দ্বিতীয়। তবে পাট রপ্তানিতে বিশ্বে বাংলাদেশই প্রথম। ছাগল উৎপাদনেও অবস্থান চতুর্থ। আর ছাগলের মাংস উৎপাদনে পঞ্চম। আলু ও আম উৎপাদনে সপ্তম অবস্থানে রয়েছে বাংলাদেশ। চা উৎপাদনে অবস্থান নবমে। সার্বিক ফল উৎপাদনে রয়েছে দশম অবস্থানে। গবাদি পশু পালনে বাংলাদেশ এখন বিশ্বে দ্বাদশ অবস্থানে রয়েছে।
কৃষি তথ্য সার্ভিসের উপপরিচালক (গণযোগাযোগ) ড. শামীম আহমেদ নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আমরা এখন কৃষিতে স্বয়ংসম্পূর্ণ। আমাদের এখন প্রধান লক্ষ্য নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিত করা। আমাদের প্রধান বার্তা হচ্ছে নিরাপদ কৃষি। সবজি, মাছ, পোলট্রি– এসবের উৎপাদন নিরাপদ করতে হবে।’
তিনি বলেন, ‘সরকার এখন কৃষকদের ভর্তুকি দিচ্ছে, যাতে উৎপাদন ঠিক থাকে। এটা আমাদের প্রায়োরিটি প্রজেক্ট। আগে আমরা খাদ্য চাহিদা পূরণের জন্য কৃষির প্রতি গুরুত্ব দিয়েছি, তবে এখন নিরাপদ কৃষির দিকে যাচ্ছি।’
শামীম আহমেদ বলেন, ‘এখন আমরা অনাবাদি জমিগুলোকে আবাদি করে তুলছি। আমাদের ধানের উৎপাদন বেড়েছে। আগে ছিল ২৯ আর এখন সেটা ৮৯ হয়েছে। আমাদের ধান গবেষণা ইউস্টিটিউটের বিজ্ঞানীরা কিন্তু এই বিষয়ে কাজ করে যাচ্ছে। আর কৃষক সেটাকে গ্রহণ করেছে।’
বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের শস্যমান ও পুষ্টি বিভাগের সিএসও ড. মোহাম্মদ আলী সিদ্দিকী নিউজবাংলাকে বলেন, ‘বাংলাদেশ এখন ধানে স্বয়ংসস্পূর্ণ বলা যাবে। অনেক প্রজাতির ধান অবমুক্ত করা হচ্ছে এখন। এখন আমাদের মূল লক্ষ্য পুষ্টি ও নিরাপদ খাদ্য ও কৃষি।’
মোহাম্মদ আলী সিদ্দিকী বলনে, ‘আমরা কিন্তু ডায়াবেটিক রোগীর জন্যেও বাজারে চাল এনেছি। এটার নাম বিআর১৬, বিআর৪৬ ও বিআর৬৯। এ ছাড়া জিংকসমৃদ্ধ চালও বাজারে অবমুক্ত করা হয়েছে। এগুলোর নাম বিআর৬৪, বিআর৮৪ ও বিআর৭৪।’
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মো. বেনজীর আলম নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আমাদের খাদ্য উৎপাদন আরও বাড়াতে হবে। প্রতি বছর ২২ থেকে ২৫ লাখ শিশু জন্ম নিচ্ছে। তাদের বেড়ে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে খাদ্যের চাহিদাও বাড়ছে।’
তিনি পশুশিল্পের কথা উল্লেখ করে বলেন, ‘বছরে প্রায় ১ কোটি ২০ লাখ গরুর খাবারের প্রয়োজন হয়। যদি এক কেজি করেও খাওয়ানো হয়, তবে বছরে সাড়ে ৩৬ মেট্রিক টন লাগবে। এ ছাড়া পোলট্রি ও মাছেও খাবার লাগছে। এর জন্য তো আমাদের খাদ্য উৎপাদন বাড়াতে হবে।’
তিনি বলনে, ‘আমরা এখন নিরাপদ খাদ্য নিয়েও কাজ করে যাচ্ছি। আমাদের পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে এই বিষয়ে।’