৯ বছর বয়সী সিয়ামের শৈশবের ছয় মাস কাটবে ইটের ভাটায়। প্রতিদিন সকালে ইটের সারি ঢেকে রাখার পলিথিন সরাতে হয় তাকে। দুপুরে ওই কাঁচা ইট সে উল্টে দেয়। বিকেলে আবারও সেই ইটের সারিতে পলিথিনের চাদরে ঢেকে দেয় সে। তার দৈনিক আয় ৮০ টাকা।
মা জেসমিনের সঙ্গে সিয়াম কাজ করে খুলনার ডুমুরিয়া উপজেলার খর্ণিয়া গ্রামের সেতু ব্রিকস নামের একটি ভাটায়। বাবা না থাকায় তার মাও ওই ভাটায় কাজ করে সংসারের ভরণপোষণ জোগান।
সিয়াম বলে, ‘বছরের ৬ মাস আমার মা এখানে কাজ করেন। তার সাথে আমিও কাজ করি। কাজে তেমন কষ্ট হয় না। তবে বকা শুনতে হয় অনেক। দ্রুত কাজ করতে বলে। ঠিকমতো না করলে মারধর করার হুমকি দেয়।’
সে বলে, ‘ভাটায় মা থাকায় তো আমার স্কুলে যাওয়া হয় না, তাই বাধ্য হয়ে ইট শুকানোর কাজ করি।’
সিয়ামের মতো আরেক শিশু তাফসির ইট পরিবহনের কাজ করে। ভ্যানে ইট তোলা, ভ্যান ঠেলা ও ইট নামানোর কাজ তার। প্রতিদিন বিকেলে শুকানো ইট ভ্যানে তুলে দেয় সে। পরে প্রাপ্তবয়স্কদের সঙ্গে ইটের ভ্যান পরিবহনে সহায়তা করে। গন্তব্যে পৌঁছালে ভ্যান থেকে ইট নামিয়ে দেয়। এতে তার দৈনিক আয় হয় ৯০ টাকা।
শুধু শিশু সিয়াম বা তাফসির নয়। খুলনার প্রায় প্রতিটি ইটের ভাটায় এমন শিশুশ্রমিকের সংখ্যা অগণিত। তাদের অভিভাবকরাও ওই ভাটায় কাজ করেন।
যেসব ভাটার শ্রমিকদের পরিবারে ছোট সন্তান থাকে, দালালরা তাদের ভাটায় কাজ করাতে উৎসাহিত করেন। শিশুদের দিয়ে কম টাকায় বেশি কাজ করানো যায়।
ভাটার একাধিক শ্রমিকের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ভাটার মালিকদের সঙ্গে শ্রমিকদের কোনো চুক্তি থাকে না। মূলত দালালরা মলিকদের সঙ্গে চুক্তিতে ইট তৈরির যাবতীয় কাজ করেন। লোকালয় থেকে নানা কাজের শ্রমিক তারা জোগাড় করে নিয়ে আসেন। মাটি কাটা, ইট তৈরি, পরিবহন ও পোড়ানোর জন্য আলাদা আলাদা শ্রমিকের দরকার পড়ে। এর মধ্যে ইট শুকানো ও পরিবহনের কাজে সহায়তার জন্য দালালরা সাধারণত শিশুদের বেশি পছন্দ করেন।
লুৎফুর নামের এক ভাটাশ্রমিক বলেন, ‘সাধারণ ইট গুনে আমরা দালালদের কাছ থেকে টাকা নিই। তবে শিশুরা টাকা নেয় দিনভিত্তিক। তাই ছোট ছোট কাজগুলি শিশুদের দিয়ে করালে কম টাকায় সম্ভব হয়। এই জন্য দালালরা শিশুশ্রমিকদের ভাটার কাজে উৎসাহিত করেন।’
শরিফুল নামের এক শিশুশ্রমিকের বাবা বলেন, ‘দুই সন্তান ও স্ত্রীকে নিয়ে আমার চারজনের সংসার। মৌসুমের শুরুতে আমি ও আমার স্ত্রী ইট তৈরির চুক্তিতে ভাটাতে এসেছি। এখানে আসার পর আমার ৯ বছরের ছেলে ও ১১ বছরের মেয়েও ভাটায় কাজ করছে। এতে তাদের দৈনিক আয় হচ্ছে ১৬০ টাকা। অন্যদিকে আমার ও আমার স্ত্রীর দৈনিক প্রায় ৮০০ টাকা আয় হয়।’
তিনি বলেন, ‘ছেলেমেয়েদের ভাটার কাজে লাগাতে চাইনি। তবে সারা দিন এখানে খেলাধুলা করে বেড়ায়। তারা এখন কাজ করে বেশ টাকা আয় করছে। তাই তাদের কাজে লাগিয়ে দিয়েছি। এতে আমাদের দালালও খুশি।’
বাংলাদেশ শ্রম আইনে ১৪ বছরের কম বয়সী শিশুদের কোনো রকম কাজে নিয়োগের ওপর নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। তবে ২০১১ সালে ইউনিসেফ কর্তৃক প্রকাশিত ‘চাইল্ড লেবার ফর বাংলাদেশে’ রিপোর্টে বলা হয়েছে, ১৪ বছরের নিছে বাংলাদেশের প্রায় ৪ দশমিক ৭ মিলিয়ন শিশুশ্রমিক রয়েছে। এর মধ্যে ১ দশমিক ৩ মিলিয়ন শিশুকে জোরপূর্বক কাজে নিযুক্ত করা হয়েছে।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে খুলনা বিভাগীয় শ্রম দপ্তরের সহকারী পরিচালক মো. শফিকুল ইসলাম বলেন, ‘শিশুশ্রম রোধে খুলনায় কয়েকটি প্রকল্প চলছে। এর মাধ্যমে অনেক শ্রমিক শিশুকে ফিরেয়ে আনা হয়েছে। তবে ইটের ভাটার শিশুশ্রম বিষয়ে কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তর দেখাশোনা করে। এটা আমাদের আওতাভুক্ত না।’
কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের খুলনা কার্যালয়ের উপমহাপরিদর্শক ডা. নবীন কুমার হাওলাদার বলেন, ‘শিশুশ্রম নিরসনে আমাদের একটি সমন্বিত কমিটি আছে। আমরা অনেকে শিশুকে শ্রম থেকে ফিরিয়ে আনতে পেরেছি। তবে ইটের ভাটায় যে শিশুশ্রমিক আছে, এটা আমাদের জানা ছিল না। আমরা এই বিষয়ে খোঁজ নিব।’
খুলনা জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, খুলনার ৯টি উপজেলায় ১৫৩টি ইটের ভাটাকে লাইসেন্স দেওয়া হয়েছে। যদিও বাস্তবে ভাটারসংখ্যা আরও বেশি।
খুলনা ইটভাটা মালিক সমিতির সভাপতি খুলনা-৫ আসনের সংসদ সদস্য নারায়ণ চন্দ্র চন্দ বলেন, ‘ভাটায় শ্রমিক আমরা নিয়োগ দিই না। দালালের মাধ্যমে শ্রমিকরা এসে কাজ করেন। আমরা সব সময় শিশুদের কাজ করাতে নিরুৎসাহিত করি।’