বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

১৫ বছরেও কাটেনি সিডরের ক্ষত

  •    
  • ১৫ নভেম্বর, ২০২২ ০৯:২০

‘দুই থেকে তিন বছর পর পর আমাদের ঘর সরাতে হচ্ছে। সিডরের পর থেকে এ পর্যন্ত ৫ বার আমাদের ঘর সরাতে হয়েছে। কারণ ওই ঝড়ের পর থেকে আর কখনও নদী ভাঙন থামেনি।’

খুলনার দাকোপ উপজেলার কালাবগি গ্রামে এক সময় ১০০ বিঘার বেশি জমি ছিল তালেব গাজীর। প্রত্যন্ত ওই এলাকায় যানবহন না থাকায় তিনি চলাচল করতেন ঘোড়ায় চড়ে। বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে ক্রমাগত ঝড়, জলোচ্ছ্বাস ও ঘূর্ণিঝড়ের কবলে পড়ে তিনি এখন নিঃস্ব।

২০০৭ সালে ১৫ নভেম্বর বাংলাদেশের উপকূলে আঘাত হানা প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড় সিডরের তাণ্ডব একেবারেই তছনছ করে দিয়েছে তালেব গাজীর জীবন। তিনি হারিয়েছেন জীবনের সব সম্বল। এখন অন্যের জমি বর্গা নিয়ে পাঁচ হাত দৈর্ঘ্য ও ১০ হাত প্রস্থের একটি গোলপাতা ও কাঠপাটের ঘরে জীবন কাটছে তার।

ওই ঘরের তার সাথে বসবাস করেন স্ত্রী আছিয়া বেগম। একমাত্র ছেলে আসলাম গাজী চলে গেছেন খুলনা শহরে কাজে সন্ধানে।

তালেব গাজী বলেন, ‘শিবসা ও সুতারখালী নদীর মোহনায় পৈত্রিক সূত্রে পাওয়া আমার প্রায় ১০০ বিঘা জমি ছিল। তখন পানির লবণাক্ততা এত বেশি ছিল না। জমিতে প্রচুর ধান ফলত। এখানের সব থেকে ধনি পরিবার ছিল আমাদেরটি। তবে গত ৮০ বছর ধরে শুধু দেখছি হারাচ্ছে।’

কথাগুলি বলার সময়ে তালেব গাজীর চোখ ছিল অশ্রুসিক্ত। হাত দিয়ে নদীর দিকে দেখিয়ে বলছিলেন, ‘এক সময়ে সুতারখালি নদীর প্রস্থ এত বেশি ছিল না। জমি ভাঙতে ভাঙতে নদীর প্রস্থ বড় হয়েছে। ছোট বেলায় যেখানে হেসে-খেলে বড় হয়েছি, সেখানে এখন নৌকা ছাড়া যাওয়া যায় না।’

তিনি বলেন, ‘এই কালাবগীতে থেকে জীবনে কত ঝড়-জলোচ্ছ্বাস দেখেছি, তার হিসাব নাই। দুটি ঝড় আমাদের পরিবারকে বেশি নিঃস্ব করেছে। এর মধ্যে একটি হয়েছিল ১৯৮৮ সালে, পরেরটি হয়েছে ২০০৭ সালে সিডরে।’

সিডরের দিনের বর্ণনা দিয়ে তিনি বলেন, ‘ঝড়ের দিন সকালে আমরা পরিবারের সকলেকে নিয়ে গিয়েছিলাম সাইক্লোন শেল্টারে। রাতে প্রচণ্ড বাতাস বয়ে গেল। নদীতে পানিও বেড়ে যায়। পরের দিন গ্রামে ফিরে আর বাড়িটি খুঁজে পেলেম না। বাড়ি তো পরের কথা, ঘরের একটি পরিত্যক্ত কাপড়ও খুঁজে পাইনি। ঝড়ের সময়ে বুঝতে পারিনি আমার সব সম্পদ হারিয়ে যাবে। যদি জানতাম আমার এই দশা হবে, তবে ঝড়ের দিন আশ্রয় কেন্দ্রে না গিয়ে পানির সাথেই মিশে যেতাম।’

সিডরে ঝড় ও জলোচ্ছ্বাসে তালেব গাজীর বসতঘরের জমি চলে যায় নদী গর্ভে। একইভাবে সিডরে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল মো. নাসের মোড়লের পরিবার। ঝড়ের কবলে পড়ে ভিটে মাটি হারিয়ে তারাও বর্গা নিয়ে অন্যের জমিতে বসবাস করছেন।

মো. নাসের মোড়ল বলেন, ‘সিডরের ঝড়ে ঘরবাড়ি হারালাম। পরে জমি বর্গা নিয়ে প্রায় ৫০০ মিটার দূরের একটি স্থানে নতুন করে ঘর বানালাম। ৩ বছর পরে সেই ঘরও নদীতে বিলিন হয়ে যায়। এভাবেই প্রত্যেক দিই থেকে তিন বছর পর পর আমাদের ঘর সরাতে হচ্ছে। সিডরের পর থেকে এ পর্যন্ত পাঁচ বার আমাদের ঘর সরাতে হয়েছে। কারণ ওই ঝড়ের পর থেকে আর কখনও নদী ভাঙন থামেনি।’

সিডরে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন কালাবগিতে এমন মানুষের সংখ্যা কম নয়। ঝড়ের পরে সাজানো সংসার আবার গড়ে তুলতে না পেরে অনেকেই ছেড়েছেন ওই এলাকাটি।

সুতারখালি ইউনিয়ন পরিষদের ৮ ও ৯ নং ওয়ার্ড নিয়ে কালাবগি গ্রাম। ওই ইউনিয়নের চেয়্যারম্যান মো. মাসুম আলী ফকির বলেন, ‘এখন ৮ ও ৯ নং ওয়ার্ডে সরকারি হিসেব মতে প্রায় ১০ হাজার মানুষ বাসবাস করে। তবে এই এলাকার তালিকাভুক্ত ভোটার হলেও অনেকে গ্রাম ছেড়ে অন্যত্র পাড়ি জমিয়েছেন। সেই হিসেব আমাদের কাছে নেই। ২০০৭ সালে সিডরের পর থেকে মানুষ এলাকা ছাড়া শুরু করেছে। কারণ তখন থেকে এ পর্যন্ত কখনও নদী ভাঙন থামেনি। বসতির জায়গা না থাকলে মানুষ থাকবে কী করে? সেখানে বসবাসের জন্য তেমন কোনো সুবিধা নেই।’

তিনি আরও বলেন, ‘বেশিরভাগ মানুষ চলে গেছে খুলনা শহরে। কেউ কেউ চালনা এলাকায়। যাদের সামর্থ্য আছে, তারা চলে গেছে। যাদের নেই তারা রয়ে গেছে।’

আবহাওয়া অফিসের তথ্য মতে, গত ১৫ বছরে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি ঝড় ও জলোচ্ছ্বাস আঘাত হানে উপকূলে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে সিডর ঝড়ে।

খুলনা আবহাওয়া অফিসের সিনিয়র আবহাওয়াবিদ আমিরুল আজাদ বলেন, ‘বাংলাদেশের ইতিহাসে অন্যতম পাঁচটি বড় ঝড়ের মধ্যে হল একটি সিডর। এ ঝড়ে বাংলাদেশের খুলনা ও বরিশাল বিভাগ সব থেকে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। এর মধ্যে খুলনার দাকোপ উপজেলার কালাবগি এলাকা ও বাগেরহাটের শরণখোলা উপজেলার সাউথখালী এলাকা সব থেকে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। এছাড়া সুন্দরবনের বেশ ক্ষতি হয়েছিল। আঘাতের সময় সিডরের গতিবেগ ছিল ঘণ্টায় ২৬০ কিলোমিটার। এর প্রভাবে উপকূলে ১০ থেকে ১৫ ফুট উচ্চতার জলোচ্ছ্বাসের সৃষ্টি হয়েছিল।’

খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্স ডিসিপ্লিনের অধ্যাপক দিলীপ কুমার দত্ত বলেন, ‘কালাবগী গ্রামটি হচ্ছে বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকার একটি বাস্তব উদাহরণ। সেখানে প্রতিনিয়ত প্রাকৃতিক দুর্যোগ হচ্ছে, নদীভাঙনের তীব্রতা বেড়েছে। যে কারণে সম্পদ হারিয়ে ওই এলাকার মানুষের অন্যত্র গিয়ে আশ্রয় নিচ্ছে। এর জন্য দায়ি বিশ্বের ধনী দেশগুলির কার্বন নিঃসরণ।’

মিশরের শারম-আল-শেখে চলছে ২৭তম জলবায়ু সম্মেলন (কপ-২৭)। তবে জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে কালাবগির বাস্তুচ্যুতির খবর সেখানে পৌঁছাবে কিনা তা ওই এলাকার মানুষের জানা নেই। শুধু কালাবগিই নয়, বাংলাদেশের উপকূলের মানুষ ক্রমাগত বাস্তুহারা হচ্ছে।

বিশ্বব্যাংকের ২০২২ সালের অক্টোবরে প্রকাশিত ‘কান্ট্রি ক্লাইমেট অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট রিপোর্ট ফর বাংলাদেশে’ বলা হয়েছে, বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে ক্ষতিগ্রস্ত দেশের তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান সপ্তম। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বাংলাদেশের দরিদ্র ও দুর্বল মানুষদের উপর সবচেয়ে বেশি আঘাত পড়ছে। গ্রীষ্মমণ্ডলীয় ঘূর্ণিঝড়ের কারণে বাংলাদেশে বছরে প্রায় এক বিলিয়ন ডলার ক্ষতি হয়। ২০৫০ সালের মধ্যে কৃষি জিডিপির এক-তৃতীয়াংশ হারিয়ে যেতে পারে এবং ১৩ মিলিয়ন মানুষ অভ্যন্তরীণ জলবায়ু বাস্তুচ্যুত হতে পারে।

এ বিভাগের আরো খবর