বাংলাদেশের রিজার্ভ কমে আসার কারণ ব্যাখ্যা করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, এখানে চুরি বা অপব্যয়ের কোনো অভিযোগ আসে কী করে।
আওয়ামী লীগের এক যুগের শাসনামালে রিজার্ভ ৫ বিলিয়ন থেকে বেড়ে ৪৮ বিলিয়ন ডলার হয়ে যাওয়ার পর আন্তর্জাতিক বাজার পণ্যমূল্য বৃদ্ধির কারণে সেটি কমেছে বলেও জানান সরকারপ্রধান।
সোমবার দুপুরে ঢাকার বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে ৫৯টি জেলা পরিষদের নবনির্বাচিত চেয়ারম্যান ও সদস্যদের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে যোগ দিয়ে এসব কথা বলেন তিনি।
শেখ হাসিনা বলেন, ‘বর্তমানে হঠাৎ একটা কথা এসেছে রিজার্ভ, রিজার্ভ, রিজার্ভ… রিজার্ভের টাকা নাকি সব চুরি হয়ে গেছে। চুরিটা হয় কীভাবে?’
২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ দ্বিতীয় দফায় সরকার গঠনের সময় দেশের রিজার্ভ ৫ বিলিয়ন ডলার ছিল বলে জানান প্রধানমন্ত্রী। বলেন, ‘এই ৫ বিলিয়ন রিজার্ভ থেকে প্রায় আমরা ৪৮ বিলিয়নের কাছাকাছি ওঠাতে পেরেছিলাম।
‘সেটা পেরেছিলাম এই কারণে, রিজার্ভের টাকা তো সব সময় খরচ হতে থাকে। এটা তো রোলিং করে। করোনার সময় যোগাযোগ বন্ধ, আমদানি-রপ্তানি বন্ধ, কেউ যেতেও পারে না, আসতেও পারে না সেই অবস্থা ছিল। কোনো আমদানি হয়নি। এই কারণেই কিন্তু রিজার্ভ জমা হয়।’
রিজার্ভের টাকা কীভাবে ব্যয় হয়েছে, তা-ও স্পষ্ট করেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেন, ‘যখন করোনা শেষ হয়ে যায়, আমাদের যে সমস্ত বিনিয়োগের ক্ষেত্রে, ইন্ডাস্ট্রি তৈরির ক্ষেত্রে, বিভিন্ন ক্ষেত্রে এমনকি চাষবাসের জন্যও যে বিভিন্ন যন্ত্রপাতি কিনে নিয়ে আসা সেগুলোর জন্যও আমাদের টাকা খরচ করতে হয়।’
আগেভাগে করোনা টিকা কিনতেও রিজার্ভের টাকা খরচ হয়েছে বলে জানান প্রধানমন্ত্রী। বলেন, ‘এই টাকা ব্যবহার করেছি মানুষের কল্যাণে। আজকে করোনা যেতে পারেনি, শুরু হলো ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ, স্যাংশন। প্রত্যেকটা জিনিসের দাম সারা বিশ্বে বেড়ে গেছে। আপনি চাল বলেন, গম বলেন, ভোজ্য তেল, জ্বালানি তেল, গ্যাস—সবকিছুর দাম এমনভাবে বেড়ে গেছে। শুধু জিনিসের দাম যে আন্তর্জাতিক বাজারে বেড়ে গেছে তা নয়, সঙ্গে সঙ্গে পরিবহন খরচ।’
তিনি বলেন, ‘দেশের মানুষকে তো কষ্ট দিতে পারি না। যেখানে যত দামই লাগুক, আমরা কিন্তু কিনে নিয়ে আসছি, মানুষকে দিচ্ছি। টিসিবি কার্ডের মাধ্যমে এক কোটি মানুষকে স্বল্পমূল্যে খাদ্য সরবরাহ করছি। ৫০ লাখ মানুষকে ১৫ টাকা কেজি দরে চাল আমরা সরবরাহ করছি। যারা একেবারে অপারগ, তাদের তো বিনে পয়সায় খাবার দিচ্ছি। বিনা মূল্যে ঘর দিচ্ছি। এই ঘরগুলোর দিকে যত্ন নিতে হবে, নজর দিতে হবে।’
বলেন, ‘এখন অতি বেশি মূল্য দিয়ে আমাকে খাদ্য কিনতে হচ্ছে। আমাকে তেল কিনতে হচ্ছে, গ্যাস কিনতে হচ্ছে, ভোজ্য তেল কিনতে হচ্ছে, জ্বালানি তেল কিনতে হচ্ছে, গম, ভুট্টা সবই আনতে হচ্ছে। আমি টাকা নিয়ে বসে থাকলে তো হবে না। আমার দেশের মানুষের জন্য খরচ করতে হবে।’
রিজার্ভের ৮ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করা হয়েছে বলে জানান শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, ‘আমাদের বিমানের সব ঝুরঝুরে অবস্থায় ছিল। সব থেকে আধুনিক বিমান আমরা ক্রয় করেছি কয়েকখানা। এখানে কিন্তু আমরা আমাদের টাকা, রিজার্ভের টাকা দিয়ে করেছি, অন্যের কাছ থেকে টাকা কিন্তু ধার নিইনি। ধার নিলে আমাকে সুদসহ শোধ দিতে হতো। বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে দিয়ে, বিমান এখন টাকা শোধ দিচ্ছে। দুই পার্সেন্ট ইন্টারেস্টসহ আমরা টাকা ফেরত পাচ্ছি।’
বিএনপি নানা রকম অপপ্রচার চালিয়ে যাচ্ছে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আছে বলেই আজকে দেশের উন্নতি হয়েছে। আওয়ামী লীগ আছে বলেই দারিদ্র্যের হার ৪০ ভাগ রেখে গেছিল, আমরা ২০ ভাগে নামিয়ে আনতে পেরেছি।’
‘বিএনপি আবার অর্থ পাচারের কথা বলে কোন মুখে?’
রিজার্ভ নিয়ে এই দীর্ঘ বক্তব্য দেয়ার পরে প্রধানমন্ত্রী কথা তোলেন বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া ও তার ছেলে তারেক রহমানের সাজা নিয়ে।
তিনি কথাটি শুরু করেন এভাবে: ‘কিন্তু আজকে যারা এটা নিয়ে কথা বলে যে রিজার্ভ গেল কোথায়? তাদের জন্য একটু বলতে চাই।’
তারেক রহমান এবং আরাফাত রহমান কোকোর পাচার করা অর্থ দেশে ফিরিয়ে আনার উদাহরণ তুলে ধরে পরে তিনি বলেন, ‘বিএনপি আবার অর্থ পাচারের কথা বলে কোন মুখে?’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘দেখা যাচ্ছে যে (অর্থ) তারাই পাচার করে, কোকো তা মারা গেছে। তারেক রহমান সাজা পেয়েছে। তারা আবার অর্থ পাচারের কথা বলে কোন মুখে? সাজাপ্রাপ্ত আসামিদের দল, তারাও গাল ভরে বলতে পারে?’
বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সাজা নিয়েও কথা বলেন আওয়ামী লীগপ্রধান। বলেন, ‘তার সাজা হয়েছে কেন? কারণ, অর্থ পাচার। অর্থ পাচার মামলা কিন্তু আমাদের আবিষ্কার না। এটা করেছে কিন্তু আমেরিকা। আমেরিকার গোয়েন্দা এফবিআইয়ের লোক এসে বাংলাদেশে তার বিরুদ্ধে সাক্ষী দিয়ে গেছে। সেই মানি লন্ডারিং কেসে তার ৭ বছরের সাজা ও ২০ কোটি টাকা জরিমানা হয়েছে।’
১০ ট্রাক অস্ত্র চোরাচালানের ঘটনা একজন পুলিশ সদস্য খুঁজে বের করার কারণে তার ওপর ‘অকথ্য অত্যাচার’ হয়েছিল বলে জানান প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেন, ‘সেই মামলাতেও তার সাজা হয়েছে।’
২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলার ভয়াবহতার কথা স্মরণ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ’২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলারও সাজাপ্রাপ্ত আসামি এবং পলাতক আসামি, ফিউজিটিভ তারেক জিয়া। সাজাপ্রাপ্ত আসামি একটা দলের নেতা হয় কীভাবে। তাদের গঠনতন্ত্রে আছে সাজাপ্রাপ্ত আসামি দলের চেয়ারম্যান হতে পারবে না। তারা নিজেদের গঠনতন্ত্র নিজেরা ভঙ্গ করে চেয়ারম্যান করে রেখে দিয়েছে।’
খালেদা জিয়া প্রসঙ্গেও কথা বলেন সরকারপ্রধান। জিয়া চ্যারিটিবল ট্রাস্ট ও জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট নামে গঠন করে বিদেশ থেকে অর্থ আনা হয় বলে জানান তিনি।
শেখ হাসিনা বলেন, ‘একটা টাকাও কোনো এতিমও পায়নি, কেউ পায়নি। সব টাকা তার ব্যাংকে জমা হয়েছে। সেই কারণে তার বিরুদ্ধে মামলা, সেই মামলায় সে সাজাপ্রাপ্ত। তারপরও তার বোন আসছে আমার কাছে, ভাই আসছে, বোনের স্বামী আসছে, তাদের অনুরোধে তার সাজাটা স্থগিত করে খালেদা জিয়াকে আমি তার বাসায় থাকতে দিয়েছি।’
আওয়ামী লীগ সরকার প্রতিশোধপরায়ণ নয় জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আপনাদের বলে রাখি, আমার বাবা-মা-ভাই হত্যার সঙ্গে জিয়া জড়িত, এটা তো স্পষ্ট। গ্রেনেড হামলায় আমাদের আইভি রহমানসহ আমাদের নেতা-কর্মী হত্যায় খালেদা জিয়া, তারেক জিয়া জড়িত। তারপরও আমরা কিন্তু মানুষের ওপর প্রতিশোধ নিতে যাইনি। ২০০১-এর নির্বাচনের পর যেভাবে আমাদের নেতা-কর্মীরা নির্যাতিত হয়েছে, আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর কিন্তু ওভাবে নির্যাতন কখনও কারও ওপরেই আমরা করিনি। আমরা দেশ গড়ার কাজেই মনোনিবেশ করেছি।’
কোকোর মৃত্যুর পর সন্তানহারা মা খালেদা জিয়াকে সমবেদনা জানাতে গিয়ে বাসায় ঢুকতে না দেয়ার কথাও ওঠে আসে বঙ্গবন্ধুকন্যার বক্তব্যে। তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের কন্যা আমাকে কতটা অপমান করেছে আপনারা ভেবে দেখেন।
‘তারপরও আমি তার প্রতি দয়া দেখিয়েছি। তারপরও আমি তাকে তার বাড়িতে থাকতে দিয়েছি। কারণ, আমরা তো তাদের মতো ছোট মন নিয়ে আসিনি। আমরা জনগণের জন্য কাজ করতে এসেছি।’