ক্রীড়া ক্ষেত্রে পুরুষদের চেয়ে নারীরা বেশি সফল বলে মন্তব্য করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
দেশের ক্রীড়াঙ্গনকে আরও এগিয়ে নিতে বাংলাদেশ ক্রীড়া শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের (বিকেএসপি) আদলে প্রতিটি বিভাগে একটি করে ক্রীড়া শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান তৈরি করা হবে বলেও ঘোষণা দিয়েছেন তিনি।
নগরে বেড়ে ওঠা শিশুদের মোবাইল-ট্যাব ছেড়ে খেলাধুলা ও শরীর চর্চায় উৎসাহী করে তুলতে অভিভাবকদের প্রতিও আহ্বান জানিয়েছেন সরকারপ্রধান।
‘সাফ উইমেন্স চ্যাম্পিয়নশিপ-২০২২’ টুর্নামেন্টে অপরাজিত চ্যাম্পিয়ন বাংলাদেশ জাতীয় নারী ফুটবল দলকে সংবর্ধনা ও আর্থিক সম্মাননা প্রদান অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী এসব কথা বলেন।
ঢাকার তেজগাঁওয়ে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের শাপলা হলে বুধবার সকালে সাফজয়ী নারী ফুটবলারদের সংবর্ধনা দেয়া হয়।
অনুষ্ঠানে সরকারপ্রধান বলেন, ‘তাদের (সাফজয়ী নারী ফুটবল দলের সদস্য) আজকে আমি অন্তত দেখতে পেলাম, কাছে পেলাম, সংবর্ধনা দিতে পারলাম। সে জন্য আমি খুবই আনন্দিত। সবাইকে আমি আন্তরিক অভিনন্দন জানাই, শুভেচ্ছা জানাই, দোয়া জানাই। আরও সাফল্য নিয়ে আসবে, সেটাই আশা করি।’
হাসতে হাসতে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘এখানে না বলে পারি না। আমাদের ছেলেরাও যা পারে না, মেয়েরা তার থেকে বেশি পারে। শুনলে আবার ছেলেরা রাগ করবে। রাগ করার কিছু নেই। ছেলেদের প্রতিযোগিতাটাও একটু বেশি…তবুও আমি বলব, মেয়েরা যথেষ্ট ভালো করছে।’
নিজের বক্তব্যের পক্ষে পরিসংখ্যান তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘২০১৮ সালের অক্টোবরে সাফ অনূর্ধ্ব-১৮ ফুটবল প্রতিযোগিতায় চ্যাম্পিয়ন হয়। ২০২১ সালে বাংলাদেশের নারী ক্রিকেট দল টেস্ট স্ট্যাটাস পেয়েছে। তা ছাড়া নারী ক্রিকেট দল বিশ্বকাপে অংশ নিয়ে পাকিস্তানকে পরাজিত করেছে।
‘ছেলেরা কিন্তু পারেনি, মেয়েরা পেয়েছে। ২০২১ সালের ডিসেম্বরে সাফ অনূর্ধ্ব-১৯ ফুটবল প্রতিযোগিতায় বাংলাদেশ নারী ফুটবল দল চ্যাম্পিয়ন হয়েছে।’
বাঙালি বিজয়ী জাতি জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘সবসময় এটা মাথায় রাখতে হবে, খেলার মাঠেও মাথায় রাখতে হবে, যুদ্ধে জয় করেছি, খেলায়ও জয় করব। এই চিন্তা নিয়ে সবাইকে চলতে হবে। তাহলে সাফল্য আসবে। কারণ মনোবল, আত্মবিশ্বাস এটা একান্তভাবে দরকার।
‘সবসময় প্রশিক্ষণ দরকার। এটাকে কোনোমতেই শিথিল করা যাবে না। যত বেশি ট্রেনিং হবে, তত বেশি খেলাধুলা উৎকর্ষতা পাবে।’
প্রতিটি উপজেলায় মিনি স্টেডিয়াম নির্মাণের পাশাপাশি জেলা ও বিভাগীয় পর্যায়ের স্টেডিয়ামের উন্নয়নে কাজ চলমান রয়েছে বলে জানান সরকারপ্রধান।
তিনি বলেন, ‘প্রতিটি জেলায় ইনডোর স্টেডিয়াম নির্মাণ করব। বিকেএসপির উন্নয়নে বিভিন্ন প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে। আমরা প্রতিটি বিভাগে, আমাদের ৮টি বিভাগ, প্রতিটি বিভাগে একটা করে আমরা বিকেএসপি করে দেব, যাতে করে খেলাধুলার ট্রেনিং, চর্চাটা হয়। আমরা ইতোমধ্যে সিদ্ধান্ত নিয়েছি।’
ক্রীড়া খাতে সরকারের নেয়া নানা পদক্ষেপের কথা তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘প্রত্যেক ব্যবসায়ী, ইন্ডাস্ট্রির মালিক বা অন্যান্য ব্যবসায়ী, তাদেরকেও আমি আহ্বান করি যে, প্রত্যেকে আমাদের খেলোয়াড়দের যেন চাকরি দেয়, কাজ দেয়। ট্রান্সজেন্ডারদের যদি তারা চাকরি দেয়, তাহলে একটা ট্যাক্স রিবেট পায়। প্রতিবন্ধীদের চাকরি দিলেও তারা ট্যাক্স রিবেট পায়। সেই সঙ্গে আমি বলব, খেলোয়াড়দেরও কোনো একটি কাজ দিয়ে উৎসাহিত রাখা যে, তারা খেলবে।’
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ নিজেদের পরিবারের সদস্যদের খেলাধুলার প্রতি অনুরাগের কথা স্মরণ করেন প্রধানমন্ত্রী।
তিনি বলেন, ‘আমি এটা মনে করি যে, আমাদের ছেলেমেয়েরা যত বেশি খেলাধুলার সঙ্গে সম্পৃক্ত হতে পারবে, সংস্কৃতি চর্চার সঙ্গে সম্পৃক্ত হতে পারবে, সাহিত্য চর্চা করবে, লেখাপড়ার পাশাপাশি এগুলো একান্তভাবে দরকার। শারীরিক, মানসিক সব দিক থেকেই আমাদের তরুণদের আলাদা মানসিকতা, দেশপ্রেম গড়ে ওঠবে।’
যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ গঠনের দায়িত্ব নিয়ে জাতির পিতা খেলাধুলার সুযোগ তৈরিতে অবকাঠামো উন্নয়ন ও আইন প্রণয়নের কাজ করে গেছেন বলে জানান সরকারপ্রধান। আওয়ামী লীগ সরকারের টানা তিন মেয়াদে ক্রীড়া খাতে যথেষ্ট উন্নতির পাশাপাশি সফলতা এসেছে বলেও জানান তিনি।
শারীরিক প্রতিবন্ধীদেরও ক্রীড়া ক্ষেত্রে উৎসাহিত করা হচ্ছে জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘সবার জন্য ক্রীড়া। স্পোর্টস ফর অল—আমরা এই নীতিতে বিশ্বাস করি। তারা পিছিয়ে থাকবে কেন?’
তিনি বলেন, ‘আমরা প্রতিবন্ধীদের জন্য জাতীয় সংসদ ভবনের পাশে যে জায়গা আছে, সেখানে প্রায় সাড়ে ৪ একরের মতো জায়গা। ওখানে বিশেষ ট্রেনিংয়ের জন্য একটা মিনি স্টেডিয়ামের মতো করে দিচ্ছি। ওটা তাদেরই জায়গা। আসলে এটা সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের জায়গা।
‘একসময় ওখানে মূক ও বধির স্কুল ছিল। ওই জায়গায়টায় যেন তারা সার্বক্ষণিক ট্রেনিং নিতে পারে, সে ব্যবস্থা করে দিচ্ছি। প্রতিবন্ধী ও অটিস্টিকদের জন্য একটা অ্যাকাডেমিও করে দিচ্ছি।’
কান্ট্রি গেমস অ্যাসোসিয়েশনের মাধ্যমে গ্রামীণ খেলাধুলা ফিরিয়ে আনতে সরকারের নেয়া উদ্যোগের কথা তুলে ধরেন সরকারপ্রধান।
তিনি বলেন, ‘আমাদের গ্রামে অনেক ছোটখাটো খেলাধুলা ছিল। আজকাল বাচ্চারা সবাই, বিশেষ করে ঢাকার বাচ্চারা তো ফ্ল্যাটে থেকে ফার্মের মুরগির মতো হয়ে যাচ্ছে। খেলাধুলায় যায় না। এটা হলো বাস্তব কথা। আর এখন তো ডিজিটাল বাংলাদেশ করে দিয়েছি, সারাক্ষণ হয় মোবাইল ফোন বা ট্যাব নিয়ে বসে থাকে।
‘কাজেই ফিজিক্যালি যে চর্চাটা, সেটা আর হচ্ছে না, কিন্তু এটা খুবই দরকার। প্রত্যেক অভিভাবককে আমি অনুরোধ করব, অন্তত কিছুক্ষণ হলেও আপনারা আপনাদের বাচ্চাদের খেলাধুলার দিকে নজর দেন, তাদেরকে নিয়ে যান, খেলান।’
ওই সময় নিজ পরিবারের উদাহরণ টেনে সরকারপ্রধান বলেন, ‘আমাদের পরিবারে কিন্তু খেলাধুলা আছে। জয়ের মেয়ে কিন্তু সে ছোটবেলা থেকে খুব ফুটবল খেলত। রেহেনার ছেলে ববি, তার ছেলে ফুটবল খেলে। ববিও নিজেও খেলে, এখনও খেলে। আমাদের পরিবারের সবার মধ্যে একটু ফুটবল খেলার দিকে ঝোঁকটা বেশি। এটা বোধ হয় দাদার থেকে আসছে আমাদের।’
তিনি বলেন, ‘লেখাপড়া করবে, স্কুল আছে, ঠিক আছে। তার সঙ্গে সঙ্গে খেলাধুলা। তারপর স্কুলগুলোতেও খেলাধুলার ব্যবস্থা থাকা উচিত। প্রতি বছরই তো বার্ষিক স্পোর্টস অনুষ্ঠিত হতো। আমি অন্য স্পোর্টস পারি না, কিন্তু একবার স্কুলে যেমন খুশি তেমন সাজো সেজে প্রাইজ পেয়েছিলাম, কিন্তু আমরা খেলতাম সেখানে। বেসবল খেলতাম, যা যা খেলা ছিল, আমরা খেলতাম।
‘আমার ইমিডিয়েট ছোটভাই কামাল। কামাল যা যা খেলত, কামালের সঙ্গে সাইকেল চালানো, ফুটবল খেলা, ক্রিকেট খেলা—সবকিছুতেই অংশগ্রহণ করতাম।’
প্রত্যেক খেলোয়াড় পেলেন ৫ লাখ টাকা
সাফজয়ী নারী ফুটবল দলের ২৩ খেলোয়াড়ের প্রত্যেককে দেয়া হয় ৫ লাখ টাকা করে আর্থিক সম্মাননা। সবার হাতে সম্মাননার চেক তুলে দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
খেলোয়াড়দের মধ্যে সবার আগে সরকারপ্রধানের হাত থেকে এই সম্মাননা বুঝে নেন অধিনায়ক সাবিনা খাতুন। তারপর একে একে এগিয়ে আসেন দলের অন্য ২২ সদস্য।
এ ছাড়াও দলের প্রধান প্রশিক্ষক গোলাম রাব্বানীসহ প্রশিক্ষক ও কর্মকর্তাদের ১১ জনের প্রত্যেককে দেয়া হয় ২ লাখ টাকা করে আর্থিক সম্মাননা। তাদের হাতেও সম্মাননার চেক তুলে দেন সরকারপ্রধান।
সম্মাননা গ্রহণ শেষে প্রত্যেক খেলোয়াড়, প্রশিক্ষক ও কর্মকর্তা দাঁড়িয়ে প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ জানান। এরপর নারী ফুটবল দলের অধিনায়ক সাবিনা খাতুন ও প্রধান প্রশিক্ষক গোলাম রাব্বানী সাফ চ্যাম্পিয়নশিপ ট্রফি প্রধানমন্ত্রীর হাতে তুলে দিতে গেলে সব খেলোয়াড়কে ডেকে নেন বঙ্গবন্ধুকন্যা।
পরে মূল মঞ্চে সবাইকে নিয়ে দাঁড়িয়ে সাবিনা খাতুনের হাত থেকে সাফ ট্রফি গ্রহণ করেন প্রধানমন্ত্রী।