ঘূর্ণিঝড় সিত্রাংয়ের প্রভাবে ভারি বৃষ্টিপাতের কারণে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়েছিল খুলনা শহরে। শহরের সব প্রায় এলাকার পানি নেমে গেলেও বাস্তুহারা কলোনি এখনো জলাবদ্ধ।
ঘূর্ণিঝড় সিত্রাংয়ের প্রভাবে খুলনায় ২৪ অক্টোবর সকাল ৬টা থেকে বৃষ্টিপাত শুরু হয়েছিল। মুষলধারে রাত সাড়ে ৮টা পর্যন্ত অব্যাহত থাকে বৃষ্টিপাত।
খুলনা আবহাওয়া অফিসের জ্যেষ্ঠ আবহাওয়াবিদ মো. আমিরুল আজাদ বলেন, ‘ওই দিন খুলনা জেলায় মোট বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছিল ২১৫ মিলিমিটার। এই ভারি বৃষ্টির কারণে শহরের অনেক এলাকায় জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়।’
রোববার দুপুরে শহরের বাস্তুহারা কলোনিতে গিয়ে দেখা যায়, সেখানকার রাস্তা এখনও হাঁটু পানিতে তলিয়ে আছে। বিশেষ করে ১০, ১১ ও ৮ নম্বর সড়ক সব চেয়ে বেশি জলাবদ্ধ।
মূলত এ কলোনিতে শহরের অধিকাংশ দরিদ্র মানুষের বসবাস। তারা অভিযোগ করেন, শহরের অন্যান্য স্থানের তুলনায় বাস্তুহারা কলোনি অপেক্ষাকৃত নিচু। সামান্য বৃষ্টি হলে সেখানে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়। পর্যাপ্ত নিষ্কাশন ব্যবস্থা না থাকায় এই সমস্যায় তারা দীর্ঘদিন ধরে ভুগছেন। জনপ্রতিনিধিরা তাদের বারবার আশ্বাস দিলেও জলাবদ্ধতা নিরসনে কখনও কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি।
কলোনির বাসিন্দা শাহজালাল হাওলাদার বলেন, ‘যখনি বৃষ্টিপাত হয়, তখন এখানটায় আর বসবাসের উপায় থাকে না। সব রাস্তাঘাটে হাঁটু পানি জমা হয়। রাস্তায় আবার খাদ আছে, সেখানে অনেকে পড়ে যায়। ঘর থেকে ছোট ছেলে-মেয়েরা বের হতে চায় না। এমনকি বয়স্কদেরও ঘর থেকে বের হওয়া কষ্টকর হয়ে পড়ে।’
তিনি বলেন, ‘এই সমস্যাটা আমাদের বহু পুরোনো। আমাদের কলোনির ভেতরে তেমন কোনো ড্রেন নেই। পাশ দিয়ে অন্য এলাকার ড্রেন চলে গেছে। এখানে কিছু ছোট ড্রেন নির্মাণ করে ওই বড় ড্রেনটির সাথে সংযুক্ত করে দিলে আমাদের সমস্যার সমাধান হতো।’
কলোনির আরেক বাসিন্দা নাহার বেগম বলেন, ‘একটু বৃষ্টিপাত হলেই রাস্তায় পানি চলে আসে। যাদের ঘর একটু নিচু, তাদের ঘরেও পানি প্রবেশ করে। সিত্রাংয়ের কারণে যে বৃষ্টি হয়েছিল, তাতে আমার ঘরের ভেতরেও পানি প্রবেশ করে। আমার পোশাক ও বিছানা ভিজে যায়।’
তিনি বলেন, ‘দুই বছর আগে আমাদের কলোনির কয়েকটি রাস্তা মেরামত করা হয়েছে। তবে সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে কোনো ড্রেনেজ ব্যবস্থা করা হয়নি।’
লিয়াকত নামের আরেক বাসিন্দা বলেন, ‘এখানে দীর্ঘদিন জলাবদ্ধ থাকার কারণে মশার বংশ বৃদ্ধি পাচ্ছে। এ ছাড়া স্থানীয়দের মাঝে পানিবাহিত রোগ বেশি হচ্ছে।’
তিনি বলেন, ‘ঘর থেকে বাইরে পা রাখলেই পানি। আমি রিকশা চালাই। কয়েকদিন ধরে বাড়িতে রিকশা আনতে পারছি না। ভাড়া করে গ্যারেজে রেখে আসছি, কারণ রাখার জায়গা নেই। এ ছাড়া আমাদের ছেলে-মেয়েরা খেলাধুলা করতে পারছে না।’
শারমিন সুলতানা নামে আরেক বাসিন্দা বলেন, ‘আমরা বারবার মেয়র ও কাউন্সিলরদের কাছে গিয়েছি। তারাও এসে দেখেছেন আমরা কোন অবস্থায় আছি। তবে জলাবদ্ধতা নিরসনের কেউ কোনো ব্যবস্থা নেননি।’
তিনি বলেন, ‘খুলনার উপকূলীয় এলাকায় যারা বসবাস করে, বা যাদের বাড়ি নদীর কিনারায় তারাও আমাদের মতো জলাবদ্ধতার শিকার হন না। আমরা শুধু নামমাত্র শহরে বসবাস করি। গ্রামের মানুষের চেয়েও খারাপভাবে জীবনযাপন করি আমরা।’
বাস্তুহারা কলোনিটি পড়েছে খুলনা সিটি করপোরেশনের (কেসিসি) ৯ নং ওয়ার্ডে। কেসিসি সূত্রে জানা গেছে, সেখানে প্রায় ৫ হাজার মানুষ বাসবাস করেন।
৯ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর মো. মাহফুজুর রহমান বলেন, ‘বাস্তুহারা কলোনিটি নিচু এলাকায় অবস্থিত, সেখানে কোনো রকম ড্রেন আছে। পার্শ্ববর্তী এলাকা থেকে বৃষ্টির পানি কলোনির দিকে চলে আসে। তাই অল্প বৃষ্টিপাত হলেই জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়।’
তিনি আরও বলেন, ‘শহরের বয়রা ও মুজগুন্নি এলাকা থেকে পানি বাস্তুহারা খাল দিয়ে প্রবাহিত হয়। অনেক প্রভাবশালী ব্যক্তি সেখানে অবৈধ স্থাপনা গড়ে তুলেছেন। যার কারণে পানি খালে বাধা পেয়ে বাস্তুহারা কলোনির দিকে চলে যায়।’
তিনি বলেন, ‘আমি খুলনা সিটি করপোরেশনের (কেসিসি) মেয়রের সঙ্গে আলোচনা করেছি। তিনি দ্রুত এই সমস্যা সমাধানের উদ্যোগ নেবেন বলে জানিয়েছেন।’
তবে কেসিসির প্রধান বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কর্মকর্তা মো. আব্দুল আজিজ দাবি করেন, ‘বাস্তুহারা কলোনির কিছু এলাকায় সরু ড্রেন রয়েছে। ওই সব সরু ড্রেনে কলোনির মানুষ নিয়মিত আবর্জনা ফেলে। এ কারনে ড্রেনগুলি সচল থাকতে পারে না। তাই জলাবদ্ধতা দীর্ঘস্থায়ী হয়।’
তিনি বলেন, ‘বর্ষার পরে আমরা ওই এলাকার ড্রেনগুলি পরিষ্কার করেছি। ফলে অনেক স্থানের পানি নেমে গেছে। তবে কিছু এলাকা নিচু হওয়ায় পানি নামেনি।’
কেসিসি সূত্রে জানা গেছে, ২০১৮ সালের জুলাই মাসে ‘খুলনা সিটিতে জলাবদ্ধতা দূর করতে ড্রেনেজ সিস্টেমের উন্নয়ন’ নামে একটি প্রকল্প একনেকে অনুমোদন পায়। এ প্রকল্পে ব্যয় ধরা হয়েছিল ৮২৩ কোটি টাকা। প্রকল্পের প্রথম পর্যায়ের কাজ শুরু হয় ২০২০ সালের অক্টোবরে।
কেসিসির প্যানেল মেয়র-১ আমিনুল ইসলাম মুন্না বলেন, ‘খুলনার জলাবদ্ধতা নিরসনে আমরা ইতোমধ্যে ৫০টির বেশি ড্রেন মেরামত করেছি। ধারাবাহিকভাবে বাস্তুহারা কলোনিতেও ড্রেন মেরামত করা হবে। ড্রেনের কাজ শেষ হলে সেখানের জলাবদ্ধতা নিরসন হবে।’