বাবুই পাখি কবিতার সেই কাহিনি ঘটে গেছে বিখ্যাত কবি রজনীকান্ত সেনের বাড়িতেই। তার বাড়িঘরে বাসা বেঁধেছে ‘চড়াই’। পরে সে চড়াই বাড়িটি ভেঙেও ফেলেছেন। দখল করে নিয়েছেন পুকুর।
সিরাজগঞ্জ বেলকুচি উপজেলার সেন-ভাঙ্গাবাড়ী এলাকায় পৈতৃক ভিটা এই কবির। গুপ্তধন লুকায়িত আছে এমন গুজবে বাড়িটি ভেঙে ফেলেছে স্থানীয় কয়েকজন।
স্বাধীনতার পর মোয়াজ্জেম হোসেন নামে একজন বিয়ে করেন গ্রামটিতে। তিনি ও তার স্ত্রীর বড় ভাই মোতাহার হোসেন প্রামাণিক মিলে কবির বাড়ির সামনের বড় পুকুরটি দখল করে নিয়েছেন। দাবি করেছেন, এর দলিল আছে তাদের।
কবির বাড়িটি স্থানীয় প্রভাবশালী নবী প্রামাণিক ও আলম হোসেন দখল করে ভেঙে ফেলেছেন দেয়াল। ফলে কবির শেষ চিহ্ন বলতে আর কিছুই রইল না।
মোতাহার হোসেন প্রামাণিকের ছেলে আনোয়ার হোসেন প্রামাণিক দাবি করেছেন, তার পূর্ব পুরুষরা জমি কিনে মালিক হয়েছেন।
নিউজবাংলাকে তিনি বলেন, ‘আমার ফুপা মোয়াজ্জেম হোসেন এই জায়গাগুলো রজনীকান্ত সেনের বংশধরদের কাছ থেকে কিনেছিল বলে জানতে পেরেছি। তবে আমার বাবা ও ফুপা সব জায়গা আবু সাঈদ নামে একজনের কাছে বিক্রি করে দিয়েছে।’
আবু সাঈদ বলেন, ‘আমি কাগজপত্র দেখে ১৮ বিঘা পুকুর আর জায়গা কিনেছি। আমি খাজনা খারিজ করেছি। আমার দখলেই রয়েছে সব জায়গা।’
বাড়ি দখলকারী নবী প্রামাণিক বলেন, ‘আমরা জায়গা কিনেছি।’
দলিল দেখতে চাইলে বলেন, দলিল দেখাবেন না।
তবে বেলকুচি উপজেলা সহকারী কমিশনার ভূমি শিবানী সরকার নিশ্চিত করেছেন, এসব জায়গা দখল করা হয়েছে। তিনি বলেন, ‘বেশ কিছু জায়গা দখলমুক্ত করে কাঁটাতারের বেড়া দিয়েছি। বাকি জায়গাগুলো উদ্ধারের জন্য কাজ করে যাচ্ছি। কোনো প্রভাবশালী ব্যক্তিই কবির জায়গা দখল করে রাখতে পারবে না।’
এই সেন-ভাঙ্গাবাড়িতে ১৯৩৮ সালে রজনী সংসদ ও স্মৃতি পাঠাগার নামে একটি ক্লাব স্থাপন করা হয়। তারা কবির স্মরণে বিভিন্ন খেলাধুলা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়ে থাকে।
পাঠাগারের সভাপতি সানোয়ার হোসেন তালুকদার নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আমরা অনেক চেষ্টা করে একটি প্রতিষ্ঠান স্থাপন করেছি। তার স্মৃতি ধরে রাখতে প্রত্নতত্ত্ব বিভাগসহ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে বারবার আবেদন করেছি, কিন্তু কোনো সাড়া পাইনি।
‘আজ কবির শেষ চিহ্নটুকু হারিয়ে যাচ্ছে দখলদারদের হাতে। আমরা কান্ত কবির স্মৃতি ধরে রাখতে চাই আগামী প্রজন্মের জন্য।’
বিভিন্ন সময় জনপ্রতিনিধিরা নানা প্রতিশ্রুতি দিলেও কবির স্মৃতি ধরে রাখতে যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়নি।
স্থানীয়রা জানান, একজন সচিব সেখানে একটি মিলনায়তন ও শিল্পকলা নির্মাণ করার কথা বলার পর কর্মকর্তারা এসে স্থান নির্বাচনের জন্য পরিদর্শন করে যান। কিন্তু সেটি আর নির্মাণ করা হয়নি। এ নিয়ে বেলকুচিতে সংস্কৃতি অঙ্গনে হতাশা আছে।
রজনীকান্ত সেনের জন্ম ১৮৬৫ সালের ২৬ জুলাই। গীতিকার ও সুরকার হিসেবেও তার পরিচিতি আছে। তিনি ‘কান্ত কবি’ নামেও পরিচিত। ভক্তিমূলক ও স্বদেশ প্রেমই তার গানের প্রধান উপজীব্য। ১৯১০ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর তিনি মারা যান। হাস্যরসপ্রধান গানের সংখ্যাও কম নয়। তিনি কীর্তন, বাউল ও টপ্পার যথাযথ সংমিশ্রণ ঘটাতে সক্ষমতা দেখিয়ে উপমহাদেশে অগুনতি শ্রোতা ও লেখকের মন জয় করেন।
স্বদেশি আন্দোলনে তার গান অসীম প্রেরণার উৎস ছিল।
রজনীকান্ত বোয়ালিয়া জিলা স্কুলে (বর্তমান রাজশাহী কলেজিয়েট স্কুল) ও পরে কোচবিহার জেনকিন্স স্কুল থেকে এন্ট্রান্স পাস করেন। পরে রাজশাহী কলেজে পড়াশোনা করেন। এরপর রাজশাহীতে আইন পেশায় নিয়োজিত হন। আইন পেশার পাশাপাশি সাহিত্য-সাংস্কৃতিক অঙ্গনে বিচরণের কারণে তার পরিচিতি বাড়ে।