রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ হবিবুর রহমান হলের সামনে টিউবয়েলের পাশে জায়গাটি জুড়ে জমাটবদ্ধ রক্ত; যেটিকে ঢেকে দেয়া হয়েছে। তার পাশেই পড়ে আছে একটি স্যান্ডেল, আরেকটি স্যান্ডেল হলের দ্বিতীয় তলার মসজিদের সামনে।
বুধবার রাত ৮টার দিকে এই হলের তৃতীয় তলার বারান্দা থেকে পড়ে যান মার্কেটিং বিভাগের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী মো. শাহরিয়ার। উদ্ধার করে রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নেয়ার পর ৮ নম্বর ওয়ার্ডে তার মৃত্যু হয়।
শাহরিয়ারকে যেখান থেকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নেয়া হয়, সে জায়গাটি ও তার আশপাশের কিছু জায়গা জুড়ে এরকম রক্তের ছোপ ছোপ দাগ লেগে আছে, পড়ে আছে তার জুতোজোড়া।
সেদিন রাতে শাহরিয়ারের মৃত্যুর খবরে ক্ষুব্ধ হয়ে উঠেন রাবির ছাত্ররা। চিকিৎসার অবহেলায় মৃত্যু হয়েছে- এমন অভিযোগ তুলে হাসপাতালে ব্যাপক ভাঙচুর চালান শিক্ষার্থীরা। হাসপাতাল পরিচালকের কক্ষের সামনে গিয়েও ভাঙচুর চালান বিক্ষুব্ধ ছাত্ররা।
কিন্তু শাহরিয়ার ঠিক কীভাবে ছাদ থেকে কেন পড়ে গেলেন, তা নিশ্চিত করে কেউই কিছু বলতে পারেননি। এটি শুধুই দুর্ঘটনা নাকি ভিন্ন কিছু- এসব প্রশ্নের নির্দিষ্ট কোনো তথ্য মিলছে না।
এই ঘটনার কোনো প্রত্যক্ষদর্শী পাওয়া যায়নি। অধিকাংশই ধারণা করছেন, তৃতীয় তলার বারান্দা থেকে দ্বিতীয় তলার মসজিদের ছাদে যেতে গিয়েই এ ঘটনা ঘটেছে।
যেভাবে ছাদে যেতে হয়
শহীদ হবিবুর রহমান হলের তিন তলা ভবনে ছাত্রদের বসবাস। পাশের দুই তলা ভবনটিতে চলে দাপ্তরিক কাজকর্ম। এর দ্বিতীয় তলায় মসজিদ। একেবারেই লাগোয়া এই দুটি ভবনের তৃতীয় তলার হলের বারান্দা আর দোতলার ছাদের উচ্চতা একই। তৃতীয় তলার এই বারান্দাটি লোহার গ্রিল দিয়ে ঘেরা।
দ্বিতীয় তলার উন্মুক্ত ছাদের কোনো ব্যবহার নেই। তবে অনেক ছাত্রই সেখানে গিয়ে বসে আড্ডা দেন। ভবনের তৃতীয় তলার বারান্দা থেকে সেখানে যাওয়ার খোলা কোনো পথ নেই। তাই সেখানে যেতে এক পা বারান্দার কার্নিশে রেখে আরেক পা দিতে হয় দ্বিতীয় তলার ছাদের কার্নিশে; এ সময় দুই হাত দিয়ে দুই ভবনের কোনার পিলারটি ধরে রাখতে হয়। কোনোভাবে হাত ফসকে গেলে পায়ের ভারসাম্য রাখার সুযোগ নেই। অর্থাৎ ঘটতে পারে হতাহতের ঘটনা।
কী বলছেন শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা
শাহরিয়ার পড়ে যাওয়ার পর ছুটে যান শহীদ হবিবুর রহমান হলের নিচ তলার ১৩৯ নম্বর কক্ষের শিক্ষার্থী আমিরুল ইসলাম। নিউজবাংলাকে তিনি বলেন, ‘আমি খেতে যাওয়ার জন্য বাইরে এসে দাঁড়িয়ে ছিলাম। তখন এক চাচা মসজিদে নামাজের জন্য যাচ্ছিলেন। এ সময় জোরে একটি আওয়াজ হলো। ওই চাচা চিৎকার দিয়ে বলেন, একটা ছেলে পড়ে গেছে, সবাই তাড়াতাড়ি আসেন।
‘দৌড়ে গিয়ে দেখি তার (শাহরিয়ার) নাক-মুখ দিয়ে প্রচুর রক্ত ঝরছে। সঙ্গে সঙ্গে আমি, চাচা ও আরেকজন তাকে ধরে বাইরে নিয়ে গেলাম। অটো করে সিলসিলা রেস্তোরাঁর কাছে যেতেই একটি অ্যাম্বুলেন্স আসে। সেখান থেকে তাকে মেডিক্যালে নিয়ে যাওয়া হয়।’
শাহরিয়ারের পড়ে যাওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে বলেন, ‘তার একটা স্যান্ডেল নিচে তার পাশে পড়ে ছিল, আরেকটি দোতলার মসজিদের সামনে। তাই মনে করছি, তিনি দ্বিতীয় তলার ছাদে যেতে চাচ্ছিলেন; তখন হাত ফসকে হয়তো পড়ে গেছেন। তাছাড়া অন্য কোনো কারণ তো এখানে দেখছি না।
‘আর অ্যাম্বুলেন্সে যাওয়ার সময় শাহরিয়ারের ট্রাউজারের পকেটে মোবাইল পেয়েছি। ওই পকেটে চেন লাগানো ছিল। তখন (পড়ে যাওয়ার সময়) তিনি যদি মোবাইল ব্যবহার করতেন, তাহলে তার মোবাইল পকেটে থাকত না। সুতরাং মোবাইল ব্যবহার করতে গিয়ে কিন্তু তিনি পড়েননি। তাই ধারণা করছি, ছাদ পার হতে গিয়েই তিনি পড়ে গেছেন।’
জানতে চাইলে ওই হলের আরেক শিক্ষার্থী মিলন হোসাইন বলেন, ‘ভাইয়ের (শাহরিয়ার) রুম পূর্ব ব্লকে। কিন্তু ভাই সবসময় পশ্চিম ব্লক হয়েই উঠতেন। প্রায় প্রতিদিনই দেখা হতো। সঠিক বলা যাচ্ছে না আসলে কী হয়েছে। তবে ভাইয়ের হাইট (উচ্চতা) খুব বেশি ছিল না। তাই মনে হয়, পার হতে গিয়েই (তৃতীয় তলা থেকে দ্বিতীয় তলার ছাদে যেতে) পড়ে গেছেন।’
একই কথা বললেন আরেক আবাসিক শিক্ষার্থী সুজন আলী। তার ভাষ্য, ‘আমার কাছেও একই বিষয় মনে হয়, দ্বিতীয় তলার মসজিদের ছাদে যেতে গিয়েই এ দুর্ঘটনা ঘটেছে। কারণ অনেক শিক্ষার্থীই এভাবে পার হয়ে ওই ছাদে যায়। তবে আমি কখনও শাহরিয়ারকে পার হতে দেখিনি। অন্যদের দেখাদেখি সে হয়তো পার হতে গিয়েই এমনটি হয়েছে বলে আমার ধারণা। কারণ ওখানের দেয়ালে হাতের একটা দাগও আছে।’
এ বিষয়ে মার্কেটিং বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক শুভ্রা রানী দাস নিউজবাংলাকে বলেন, ‘ছাত্রদের কাছে থেকে যতটা শুনেছি ফোনে কথা বলতে যাওয়ার জন্য দ্বিতীয় তলার ছাদে যেতে গিয়ে এই দুর্ঘটনা ঘটেছে। তারপরও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন যদি কোনো তদন্ত কমিটি গঠন করে তাহলে ভালো হবে।’
এ ঘটনায় তদন্ত কমিটি গঠন হবে জানিয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অধ্যাপক আসাবুল হক। বলেন, ‘এখন পর্যন্ত কোনো তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়নি। তবে আমাদের শিক্ষার্থী কিভাবে পড়েছে এটা জানা দরকার, তাই আমরা একটা তদন্ত কমিটি গঠন করব।’
রাজশাহী মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত উপকমিশনার রফিকুল আলম নিউজবাংলাকে বলেন, ‘এ ঘটনায় মতিহার থানায় একটি ইউডি মামলা হয়েছে। তাছাড়া পুলিশ বিষটি তদন্ত করেছে। ওই হলের ছাত্রদের সঙ্গে কথা বলেছে।
‘তাতে প্রাথমিকভাবে মনে হয়েছে, অসাবধানতাবশত এই দুর্ঘটনাটি ঘটেছে। এর পরও ঘটনার পর হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ একটি তদন্ত কমিটি করেছে। দেখা যাক সেটিতে কী উঠে আসে। এরপর আমরা আরও বিস্তারিত জানতে পারব।’