সিগন্যালে দাঁড়িয়ে বাস। ছুরি হাতে ভয় দেখাচ্ছে উন্মত্ত ছিনতাইকারী। জানালা দিয়ে এক জনের ফোন ছিনিয়ে নেয়ার চেষ্টা ব্যর্থ হওয়ার পর সেই ছিনতাইকারী ও দলের সদস্যরা বাসের ভেতরে ঢুকে যায় কি না, এ নিয়ে ভীত সন্ত্রস্ত যাত্রীদের সামনে ভরসা হতে পারত পাশেই দুটি গাড়িতে থাকা পুলিশ সদস্যরা। কিন্তু ৫০ জনেরও বেশি মানুষের চিৎকার তাদের কানে যায়নি। ছিনতাইকারীদেরকে লাঠি দেখিয়ে বাঁশিতে ফু দিয়ে চলে যায় গাড়ি দুটি।
বলা হচ্ছে গাড়ি দুটি ভিআইপি প্রটোকলে ছিল। তবে যাত্রীরা এবং একজন অপরাধ বিজ্ঞানী নিউজবাংলাকে বলেছেন, এমন একটি পরিস্থিতিতে দুই গাড়ির কিছু সদস্য যাত্রীদের নিরাপত্তায় ব্যবস্থা নিতে পারতেন, তারা পুলিশের কাছাকাছি অবস্থানে তথ্য দিতে পারতেন।
নাগরিকদের এভাবে অনিরাপদে রেখে পুলিশ সদস্যদের এভাবে ঘটনাস্থল ত্যাগ করার মধ্য দিয়ে তারা তাদের চাকরির শপথ ভঙ্গ করেছেন বলে অভিযোগ উঠছে।
এই ঘটনাটি ঘটে গত মঙ্গলবার সন্ধ্যায়। রাজধানীর আসাদগেট এলাকায় ছিনতাই করতে আসে কয়েকজন তরুণ। তাদের হাতে ছিল বড় আকারের ছুরি। সেই বাসের একজন যাত্রী ঘটনাটি ভিডিওতে ধারণ করে ফেসবুকে ছেড়ে দিয়েছেন।
অলিগলিতে ছিনতাই নতুন কোনো ঘটনা নয়। কিন্তু প্রকাশ্য রাজপথে ভিড়ের মধ্যে এই ঘটনাটি একদিকে যেমন যাত্রীদের নিরাপত্তাহীনতার বিষয়টি প্রকাশ পায়, তেমনি পুলিশের আচরণে প্রশ্ন জাগে, তারা মানুষের নিরাপত্তা বিধানে আসলে কতটা আন্তরিক।
ঘটনার সময় পাশেই পুলিশের দুইটি গাড়ি ছিল। পাশেই ছিল ট্রাফিক পুলিশ বক্স। তাদের কেউ এগিয়ে আসেনি, এমনকি থানাতেও ফোন করে ছিনতাইকারীদের এই বিষয়টি না জানিয়ে এলাকা ছেড়ে চলে যায়।
ঘটনাস্থলটি শেরে-বাংলা নগর থানায় পড়েছে। থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা উৎপল বড়ুয়াকে জানিয়েছেন, এই ঘটনাটি তারা ফেসবুক দেখে জেনেছেন। তিনি বলেন, ‘এ বিষয়ে তদন্ত চলছে।’
একই কথা বলেছেন তেজগাঁও বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনার এইচ এম আজিমুল হক। তিনি বলেন, এ ঘটনা ঘটনাস্থলের কোনো পুলিশ সদস্য আমাদের জানায়নি।
ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়া ভিডিওটিতে বিভিন্ন কথার মধ্যে একজনকে বলতে শোনা যায়, ‘জ্যামের মধ্যে দিন দুপুরে ডাকাতি। পুলিশ দেখল একটা বাঁশি ফুঁ দিল, চলে গেল।’
তারপর আরেক জনকে বলতে শোনা যায়, ‘ওরা তো ভিআইপি প্রটোকলের পুলিশ।’
যা ঘটেছিল সেই সন্ধ্যায়
যিনি ভিডিওটি ফেসবুকে আপলোড করেন তিনিও ওই বাসের যাত্রী ছিলেন। তার নাম হাসিবুল হক আসিফ।
ঘটনার বর্ণনা দিয়ে তিনি বলেন, ‘মঙ্গলবার সন্ধ্যায় আসাদগেটের সিগন্যালে আটকা পড়ে ট্রান্স সিলভা বাসটি। আমার সামনের সিটে একজনের মোবাইল জানালা দিয়ে নিতে আসেন ৩ থেকে ৪ জন ছিনতাইকারী। ওই যাত্রী চিৎকার চেঁচামেচি করলে তারা চাকু হাতে দৌড়ে আসে মারার জন্য।
‘বাসের সবাই জানালা লাগিয়ে কন্ডাক্টরকে দরজা বন্ধ করতে বলেন। প্রথমে ভেবেছিলাম ব্যক্তিগত শত্রুতার কারণে হয়ত এমনটা ঘটছে। কিন্তু না, আমাদের সামনেই ওরা আরও কয়েকটা গাড়ি থেকে ছিনতাই করে। সবার হাতেই ধারালো ছুরি ছিল।’
তিনি বলেন, ‘এর মধ্যে রাস্তার অপর পাশে একটা পুলিশের গাড়ি ছিনতাইকারীদের দেখে লাঠি দেখিয়ে বাঁশি বাজায়। বাসের সব যাত্রী পুলিশের গাড়ি দেখে চেঁচিয়ে বলে ভাই ধরেন... ধরেন... এরা ছিনতাইকারী। কিন্তু পুলিশের গাড়ি চলে যায়।
‘এরপর ছিনতাইকারীরা আমাদের বাসের দিকে আসে। ছুরি হাতে বাসের জানালা দরজা দিয়ে হামলার চেষ্টা করে। আমরা আবারও বাসের জানালা দরজা বন্ধ করে দিই। এর মধ্যে সিগন্যাল ছেড়ে দেয়। ওরা আমাদের বাস লক্ষ করে ইট ছোড়ে, পরে ধাওয়া করে। কিন্তু ধরতে পারেনি।’
যার ফোনটি ছিনতাইয়ের চেষ্টা হয়েছিল তিনি শিক্ষানবিশ আইনজীবী মো. রাসেল। নিউজবাংলাকে তিনি বলেন, ‘আমি ডাক্তার দেখিয়ে বাসে করে ফিরছিলাম। আসাদ গেটের সিগন্যালে ছিনতাইকারীরা জানালা দিয়ে আমার ফোন টান দেয়। নিতে না পেরে আমাকে গালিগালাজ করে। আমি তখন গালিগালাজের উত্তর দেই। পরে তারা দেশীয় অস্ত্র নিয়ে গাড়িতে হামলা চালায়। সিগন্যাল ছেড়ে দেয়ায় রক্ষা পেয়েছি।
‘অল্প সময়ের মধ্যে তারা ওই জায়গায় একটা আতঙ্ক সৃষ্টি করে ফেলছিল। এ কারণে কেউ সাহস করে তাদের কিছু বলতে পারেনি। পাশে যে পুলিশের গাড়ি ছিল তারা ভিআইপি প্রটোকল দিচ্ছিল। সেখানে দুইটা পুলিশের গাড়ি ছিল। একটা গাড়িকে পুলিশের দুইটা গাড়ি প্রটোকল দিয়ে নিয়ে যাচ্ছিলেন। তারা এগিয়ে আসেন নাই।’
নাগরিককে এভাবে অনিরাপদে রেখে কি পুলিশ যেতে পারে?
ঘটনাস্থলে থেকেও ছিনতাইকারীদের থেকে যাত্রীদের রক্ষা না করে, এমনকি পুলিশের নিকটবর্তী কোনো অবস্থানে তথ্য না দিয়ে ভিআইপি প্রটোকলে যাওয়া উচিত নয় বলে মনে করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক জিয়াউর রহমান।
নিউজবাংলাকে তিনি বলেন, ‘বাস ভর্তি মানুষ আতঙ্কে, ছিনতাইকারীরা ছুরি নিয়ে তেড়ে আসছে। সেখানে প্রটোকল দেয়া জরুরি নাকি সাধারণ মানুষকে রক্ষা করা জরুরি? এখানে তো আইনের বিষয় না।
‘আমাদের এখানে পুলিশের নেচার এবং কালচার হচ্ছে বড়লোকদের সেবা করা। তারা মনে করেছে এটা কোনো ঘটনাই না। এটা ছোট ঘটনা। কিন্তু ঘটনাটা তো আর ভাইরাল এমনি হয় নাই। এই ঘটনাকে অন্য ঘটনার সঙ্গে মিলিয়ে দেখলে চলবে না।’
পুলিশের আচরণে পরিবর্তন আনতে এই ঘটনাটিকে গুরুত্বের সঙ্গে নিয়ে পুলিশের অভ্যন্তরীণ তদন্তের সুপারিশও করেছেন এই অপরাধ বিশেষজ্ঞ। তিনি বলেন, ‘পুলিশ বাঁশি দেয় তখনই সরে যেতে বলে। মানে জানান দেয়, আমি আসছি, তুমি চলে যাও। ঘটনা যদি এরকম হয় তাহলে এটা দুঃখজনক। এখন যদি আমরা পুলিশের এ রকম আচরণ দেখি তাহলে আমরা সামনের দিকে এগোতে পারব না।
‘কোনো পুলিশ সদস্যরা সেখানে ছিলেন, সেটা তদন্ত করে বের করা উচিত। এটার মধ্যে দিলে একটা ম্যাসেজ আমাদের দেয়া দরকার, পুলিশের সনাতনী যে সংস্কৃতি এবং এক্টিভিটিজের মধ্যে পরিবর্তন আনা দরকার।’
পুলিশের বিষয়টি দেখা উচিত ছিল : ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার
ঘটনাস্থলে উপস্থিত পুলিশ সদস্যদের এমন নির্লিপ্ততা পুলিশের দায়িত্ববোধের সঙ্গে সাংঘর্ষিক কি না, এ বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা মহানগর পুলিশের পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার (ক্রাইম অ্যান্ড অপারেশন্স) এ কে এম হাফিজ আক্তার সরাসরি জবাব না দিয়ে বলেন, ‘লোকাল পুলিশ হোক আর বাইরের পুলিশ হোক এটা অবশ্যই দেখবে।’
পুলিশ যাত্রীদের রক্ষা না করে সেখান থেকে কীভাবে চলে যেতে পারে?- এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘হয়তো বা অন্য কাহিনি থাকতে পারে।’
নিউজবাংলাকে তিনি বলেন, ‘আমি বিষয়টা দেখে ডিসিকে ফোন করেছিলাম। তিনি বলেছেন, এ বিষয়ে অভিযান চলছে। একেক পুলিশের একেক ধরনের ডিউটি। এ বিষয়ে পুলিশ অবগত হয়েছে। এটা ছিনতাইয়ের ঘটনা ছিল না, অন্য ঘটনা ছিল। এটা ভাইরাল হয়েছে অন্যভাবে।’