বরগুনার পাথরঘাটা উপজেলা তাফালবাড়িয়া ইউনিয়নের জেলে আবদুল খালেক। ৪০ বছর ধরে গভীর সাগরে মাছ শিকার করে জীবিকা চালাচ্ছেন তিনি। প্রধান প্রজনন মৌসুমে মাছ শিকারে সরকারের নিষেধাজ্ঞার কারণে এখন ঘরে বসে আছেন খালেক।
নিউজবাংলাকে তিনি বলেন, ‘সিজনের শুরুতে ৬৫ দিন নিষেধাজ্ঞায় ঘরে বইয়া আছিলাম। এরপর ইলিশ শিকারে সাগরে গিয়া ঝড়ের কবলে পইরা কোনো মতে জানডা লইয়্যা বাড়তে ফিরছি। হেরপর ডরে আর সাগরে যাইতে পারিনায়। এহন আবার মাছ ধরায় ২২ দিন নিষেধ। এহনও যদি চাউল দুগ্গা না পাই তয় গুরাগারা লইয়া কী খামু।’
মা ইলিশ রক্ষা এবং প্রজনন মৌসুম নির্বিঘ্ন করতে ইলিশ ধরায় ২২ দিনের নিষেধাজ্ঞা শুরু হয় ৭ অক্টোবর থেকে। এ সময়ে সরকার চাল সহায়তা দিলেও অধিকাংশ জেলেই তা পান না। এতে ধারদেনায় ডুবে যান তারা।
খালেকের মতোই বরগুনা জেলায় উপকূলীয় বাসিন্দাদের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ মৎস্যজীবী। এদের একাংশ গভীর সাগরে মাছ ধরে। বাকিরা স্থানীয় নদ-নদীতে বছরজুড়েই মাছ শিকার করে; এই জেলেদের প্রান্তিক জেলে বলা হয়।
গভীর সাগরে যাওয়া জেলেরা সাধারণত বর্ষা ও শীত মৌসুমে ইলিশ শিকার করেন। এ ছাড়া তারা আর কোনো কাজ করেন না। তবে প্রান্তিক জেলেরা মাছ ধরার পাশাপাশি অবসরে দিনমজুর কিংবা নিজেদের জমিতে কৃষিকাজ করে থাকেন।
মৎস্য বিভাগের হিসাবে, বরগুনায় নিবন্ধিত জেলে প্রায় ৫০ হাজার। তবে স্থানীয় বাসিন্দা ও এনজিও প্রতিনিধিরা বলছেন, সংখ্যাটা দ্বিগুণ হবে।
নিষেধাজ্ঞাকালীন মোট জেলের এক-চতুর্থাংশ খাদ্য সহায়তার আওতায় চাল পেয়ে থাকেন। জেলা মৎস্য অফিস বলছে, বরগুনায় মোট ৩৭ হাজার ৭৭০ জেলে খাদ্য সহায়তার আওতায় ২৫ কেজি করে চাল পাবেন। তবে এখন পর্যন্ত এই সহায়তা দেয়া হয়নি।
পাথরঘাটার বলেশ্বর নদের বাঁধের ধারে কর্মহীন জেলেদের কেউ রাস্তার পাশে টং দোকানে অলস সময় পার করছেন।
পশ্চিম চরলাঠিমারা বেড়িবাঁধ এলাকার জেলে ফারুক মিয়া বলেন, ‘মোগো কাম লাগবে। কাম ছাড়া মোরা কী লইয়া বাঁচমু।’
তালতলীর নিশানবাড়িয়া এলাকার জেলে আবদুর রব বলেন, ‘সরকার জেলেদের মাসে ২৫ কেজি করে চাল দেয়। এই চালে ৫ সদস্যের কয় দিন চলে?’
বরগুনা সদর, আমতলী ও পাথরঘাটার অন্তত ২৫টি জেলে পরিবারের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, মোটামুটি প্রতিটি জেলে পরিবারই ঋণগ্রস্ত। কেউ আবার একাধিক এনজিও থেকে ঋণ নিয়েছেন। এসব জেলের মধ্যে মহাজনী দাদন নেয়ার প্রবণতাও আছে।
স্থানীয় জেলে বাবুল হাওলাদার বলেন, ‘তিনডা কিস্তি দেওন লাগে হপ্তায়। এনজিও দিয়া ঋণ আর আড়ত দিয়া দাদন লইয়া জাল কিনছি, ট্রলার বানাইছি। এহন এই ২২ দিন কিস্তি দিমু না নিজেরা গুরাগারা লইয়া খামু। এহন এহানে খ্যাত খামারেও কাজ নাই। কী হরমু যে মোরা কিছছু কইতে পারি না।’
জেলা ট্রলার শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক দুলাল মাঝি বলেন, ‘আমাদের পাথরঘাটায় প্রায় ২০ হাজার জেলে আছেন, যারা শুধু সাগরে ইলিশ শিকার করে। জেলায় মোট ৩৭ হাজার জেলে খাদ্য সহায়তার আওতায়। বাকিরা অভাব-অনটনে খেয়ে না খেয়ে দিন কাটায়। এসব জেলের জন্য বিকল্প কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে হবে, নয়তো খাদ্য সহায়তার পরিমাণ বাড়াতে হবে। নইলে এই ২২ দিন ধারদেনা করে আরও ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়ে তারা।’
জেলা মৎস্যজীবী সমিতির সভাপতি আবদুল খালেক দফাদার বলেন, ‘আমাদের জেলায় যে খাদ্য সহায়তা দেয়া হয়, জেলেদের তুলনায় তা অর্ধেক। খাদ্য সহায়তা বাড়ানোর জন্য আমরা মৎস্য বিভাগকে একাধিকবার বলেছি। সহায়তা নিষেধাজ্ঞার আগে দিলে জেলেরা কিছুটা স্বস্তিতে থাকতে পারে। কিন্তু বরাবরই নিষেধাজ্ঞা শুরুর অনেক পরে চাল দেয়া হয়। এটা অবশ্যই সরকারকে ভাবতে হবে।’
জেলা মৎস্য কর্মকর্তা বিশ্বজিৎ কুমার বলেন, ‘কোস্ট গার্ড, নৌ পুলিশ ও মৎস্য বিভাগের সমন্বয়ে প্রতিদিন বরগুনার বিষখালী, বলেশ্বর ও পায়রা নদী ও বঙ্গোপসাগরের মোহনায় অভিযান পরিচালনা করছে জেলা মৎস্য বিভাগ। এখন পর্যন্ত জেলার তিনটি নদীতে নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে ইলিশ ধরায় ১৭ জনকে জেল জরিমানা করা হয়েছে।’
জেলেদের মধ্যে খাদ্য সহায়তা দ্রুতই বিতরণ করা হবে বলেও জানান তিনি।