বাংলাদেশে দায়িত্বরত বিদেশি কূটনীতিকদেরকে বাংলাদেশের সম্পর্কে বক্তব্য রাখার সময় তাদের সীমার বিষয়টি স্মরণ করিয়ে দেয়া হয়েছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে।
পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম বলেন, ‘কূটনীতিকদের একটা সীমাবদ্ধতা আছে। তাদের সেই দিকে খেয়াল রাখা দরকার। তা না হলে অন্য চিন্তা করা হবে।’
জাতিসংঘ মানবাধিকার কাউন্সিলে বাংলাদেশের জয়, সাধারণ পরিষদে রাশিয়ার বিরুদ্ধে ভোটসহ সাম্প্রতিক যুক্তরাষ্ট্র সফর নিয়ে করা সংবাদ সম্মেলনে তিনি এই তথ্য জানান। বৃহস্পতিবার দুপুরে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অনক্লোজ সম্মেলন কক্ষে গণমাধ্যমকর্মীদের সামনে আসেন তিনি।
এ সময় প্রতিমন্ত্রী বাংলাদেশের জাতীয় নির্বাচন নিয়ে বিদেশি কূটনীতিকদের নানা বক্তব্যে বিরক্তি প্রকাশ করেন।
কিছুদিন ধরে বিশেষ করে ঢাকায় যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত পিটার ডি হাস বিষয়টি নিয়ে নানা কথা বলছেন। ঢাকায় যে কর্মসূচিতেই তিনি যোগ দেন, সাংবাদিকরা তাকে প্রশ্ন রাখেন আগামী জাতীয় নির্বাচন নিয়ে। আর পিটার হাস তুলে ধরেন তার দেশের অবস্থান। সেদিন তিনি বলেছেন, ‘সহিংসতা বজায় থাকলে বাংলাদেশে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়।’
এর আগেও পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী কারও নাম উল্লেখ না করে কূটনীতিকদের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে বক্তব্য না রাখার বিষয়ে জোর দেন। সম্প্রতি পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূতের নাম উল্লেখ করেই বিষয়টি নিয়ে কথা বলেন।
গত ১১ অক্টোবর সংবাদ সম্মেলন করে তিনি বলেন, ‘আমরা বিশ্বাস করি আমাদের দেশে যারা ডিপ্লোম্যাট আছেন তারা পরিপক্ব। তারা সম্মানিত লোক। তারা কূটনৈতিক শিষ্টাচার মেনে চলবে বলে আমাদের বিশ্বাস। গণতন্ত্র, মানবাধিকার ও নির্বাচন নিয়ে বিদেশি কূটনীতিকদের পরামর্শ সরকারের দরকার নেই।’
বিষয়টি নিয়ে আবার কথা বলেন শাহরিয়ার। তিনি বলেন, ‘…এগুলো কিন্ত আমরা সব সময় আলোচনায় বলি, প্রেসে (গণমাধ্যমে) বলি না। কারণ, হয়ত অনেকেই বিব্রত হবেন। ঘরোয়া আলোচনায় কী হচ্ছে তাও হয়তো আমরা জানার চেষ্টা করি না। আমরা সবার ওপর সম্মান রেখেই চলার চেষ্টা করি। এর অর্থ এই নয় যে, আমাদের আভ্যন্তরীণ বিষয়ে তারা মুক্তহস্তে হস্তক্ষেপ করবেন।
‘তাদের মনে রাখতে হবে আমাদের দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে তারা কতটুকু বলতে পারবেন, তাদের দেশে অন্য দেশের কূটনীতিকরা ঠিক কতটুকু বলার অধিকার রাখেন। তাদের খেয়াল রাখতে হবে, তাদের কোনো কিছুই যেন এর বাইরে না যায়।’
সম্প্রতি একাধিক আলোচনায় পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেনও কূটনীতিকদেরকে শিষ্টাচার মেনে চলার অনুরোধ করেছেন
কূটনীতিকরা ‘সীমা অতিক্রম করে যেতে থাকলে’ তাদের জন্য বিভিন্ন দপ্তরে প্রবেশাধিকার সীমিত করার ইঙ্গিতও দেন প্রতিমন্ত্রী। তিনি বলেন, ‘আমরা যেভাবে অতিথিপরায়ণ হয়ে সব দেশের রাষ্ট্রদূতদের জন্য আমাদের দেশের দপ্তরগুলোর দরজা খোলা রাখি, সব মন্ত্রণালয়, সকল অধিদপ্তর, সব বিভাগের জন্য এটা প্রযোজ্য; এটা যেন তারা অতিক্রম না করে। যদি করে, তবে আমরা অন্যকিছু ভাবব।’
এ সময় সাংবাদিকরা ঢাকায় জার্মান রাষ্ট্রদূত আকিম ট্রোস্টারের একটি বক্তব্যের বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। এদিন সকালে তিনি গণমাধ্যমকর্মীদের বলেন, ‘সরকার যতই সমালোচনা করুক, যত বাধাই আসুক আমরা সরকারের সমালোচনা করবই। বাংলাদেশে যে নির্বাচনি সহিংসতা হচ্ছে, তা অবশ্যই একটা গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার জন্য বাধা।’
পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী বলেন, ‘আমি যেহেতু নিজের কানে এটা শুনিনি, তাই এ নিয়ে আমি কোনো মন্তব্য করব না, তবে খতিয়ে দেখব।’
কাউকে নির্বাচনে আনার গ্যারান্টি দিতে পারব না
কাউকে নির্বাচনে আনার গ্যারান্টি সরকার দিতে পারবে না বলে যুক্তরাষ্ট্রকে স্পষ্ট করে বলা হয়েছে বলে জানিয়েছেন পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী।
তিনি জানান, যুক্তরাষ্ট্র সফরের সময়ে সে দেশের পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী উন্ডি আর শেরমেনের সঙ্গে তার বৈঠক হয়। সেই বৈঠকে শেরমেন বলেন, যুক্তরাষ্ট্র চায় বাংলাদেশের আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন ফ্রি অ্যান্ড ফেয়ার হবে।
শাহরিয়ার বলেন, ‘আমি স্পষ্ট ভাষায় বলেছি, নির্বাচন অবশ্যই ফ্রি ও ফেয়ারভাবেই হবে। কিন্তু আমরা এটা নিশ্চিত করতে পারব না, কে নির্বাচনে আসবে, কে নির্বাচনে আসবে না।’
ঢাকায় যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত পিটার ডি হাস সম্প্রতি নানা অনুষ্ঠানে বাংলাদেশের আগামী জাতীয় নির্বাচন নিয়ে কথা বলেছেন। তার কাছে বাংলাদেশের রাজনীতি নিয়ে প্রশ্ন করায় গণমাধ্যমকর্মীদের ওপর চটেছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী
কে নির্বাচনে আসবে আর কে আসবে না, তা নির্দিষ্ট সেই ব্যক্তি ও দলের ওপর নির্ভর করে জানিয়ে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী বলেন, ‘বাস্তবতার নিরিখে যে রাজনৈতিক দলগুলোর কোনো লিডারশিপ নেই, চালিকাশক্তি নেই, অতীতের ব্যাগেজ তারা কেন টেনেছে, তার প্রকৃত ব্যাখ্যা যারা জনগণের কাছে দিতে পারে না, তাদের বিষয়ে বাংলাদেশ কখনোই কোনো গ্যারান্টি দিতে পারে না।’
প্রতিমন্ত্রী জানান, তিনি যুক্তরাষ্ট্রকে জানিয়েছেন, রাষ্ট্রপতি একটি সার্চ কমিটির মাধ্যমে নির্বাচন কমিশন গঠন করেছেন। সেখানে সরকারের কোনো হস্তক্ষেপ ছিল না।
‘ফখরুলের বক্তব্য রাষ্ট্রদ্রোহের শামিল’
বুধবার চট্টগ্রামের সমাবেশে সরকারের ওপর নিষেধাজ্ঞা চেয়ে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর যে বক্তব্য রেখেছেন, তাতে রাষ্ট্রদ্রোহ হয়েছে বলে মনে করেন পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী।
তিনি বলেন, ‘এটা আবার প্রমাণ হলো বিএনপি জনগণের ওপর আস্থা রাখে না। বিদেশি রাষ্ট্রের মুখাপেক্ষী হওয়া বা এইসব রাষ্ট্রের মুখ থেকে কিছু বের করা বা বর্তমান সরকারের সঙ্গে সেইসব রাষ্ট্রের সম্পর্কে বাধা সৃষ্টি করা তাদের লক্ষ্য।’
তারেক রহমানের প্রতি ইঙ্গিত করে শাহরিয়ার বলেন, প্রধানমন্ত্রীর সন্তান থাকাকালীন সময়ে যুক্তরাষ্ট্র যেন তার প্রতি বিধিনিষেধ আরোপ করে এমন তারবার্তা বাংলাদেশে যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূতের কাছে সে দেশের প্রশাসনের কাছে গিয়েছিল। পরে উইকিলসের মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। এতে প্রমাণ হয়, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্কের ক্ষেত্রে তারেক রহমান একটা বাধা।
‘সেই দলের মহাসচিবের উচিত যুক্তরাষ্ট্রকে বলা, তারেক রহমানের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের যে বিধিনিষেধ আছে বলে শোনা যায়, যুক্তরাষ্ট্র যেনো তা মাফ করে দেয়। তা না করে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা চাওয়া রাষ্ট্রদ্রোহিতার শামিল’- বলেন শাহরিয়ার আলম।