বৃহত্তর ময়মনসিংহ অঞ্চলের ফসলের নিবিড়তা বৃদ্ধি প্রকল্পের আওতায় শেরপুরে প্রথমবারের মতো পলিনেট হাউস পদ্ধতিতে ফল-সবজি রোপণ ও চারা উৎপাদন শুরু হয়েছে।
প্রতিটি পলিনেট হাউস প্রায় ১৬ লাখ টাকা ব্যয়ে নির্মাণ করেছে কৃষি বিভাগ। জেলার নকলা, নালিতাবাড়ী ও ঝিনাইগাতী উপজেলায় প্রথমবারের মতো এ হাউসে চাষাবাদ শুরু হয়েছে। আর এতে সুফল পাচ্ছে তিন উপজেলার কৃষকরা। ফলে কৃষি উৎপাদনে বিপ্লব ঘটবে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।
স্থানীয় কৃষি বিভাগ জানায়, পলিনেট হাউসে উচ্চমূল্যের ফসল যেমন টম্যাটো, ক্যাপসিকাম, ব্রকলি, রকমেলন, রঙিন তরমুজ, রঙিন ফুলকপি, বাঁধাকপি, লেটুসের মতো সবজির পাশাপাশি চারা উৎপাদন করা হয়।
পলিনেটে সবজি চাষে যেমন বৈচিত্র্য আসে, তেমনি অনেকেই আয়ের নতুন উৎসের সন্ধান পান। শেরপুরেও সেটি হচ্ছে বলে জানায় কৃষি বিভাগ।
কৃষকরা জানান, পলিথিনের আচ্ছাদন থাকায় এতে সূর্যের ক্ষতিকর রশ্মি ভেতরে প্রবেশে বাধা পায় এবং অতিবৃষ্টি বা প্রাকৃতিক দুর্যোগেও ফসল অক্ষত থাকে। অসময়ে সবজি চাষের জন্য পলিনেট হাউস দেশে আধুনিক কৃষি প্রযুক্তির নতুন সংযোজন। এর মাধ্যমে শীতকালীন সবজিগুলো যেমন সহজেই গ্রীষ্মকালে উৎপাদন করা যায়, তেমনি গ্রীষ্মকালের সবজিও শীতে উৎপাদন করা যায়।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, ঝিনাইগাতী উপজেলার বাকাকুড়া গ্রামে ১০ শতাংশ জমির ওপর একটি পলিনেট হাউস স্থাপন করা হয়েছে। বর্তমানে পলিনেট হাউসে টম্যাটো, ফুলকপি, পেঁপে, কলার চারা ও ক্যাপসিকামসহ বিভিন্ন ধরনের সবজির আবাদ করা হচ্ছে। আর এতে কাজ করছেন পলিনেটের উদ্যোক্তা ফজলুল হক।
ঝিনাইগাতী উপজেলার পশ্চিম বাকাকুড়া গ্রামের কৃষক ফজলুল হক তার ১০ শতাংশ জমিতে পলিনেট হাউস পদ্ধতিতে নানা ধরনের সবজি চাষ ও চারা উৎপাদন করছেন।
ফজলুল হক জানান, আধুনিক এই পলিনেট হাউসে প্লাস্টিক ট্রেপে মাটির পরিবর্তে নারকেলের ছোবড়ায় তৈরি কোকোপিটে চারা উৎপাদন করা হয়। এতে ভাইরাস ও পোকামাকড় থেকে রক্ষা পাওয়া যায়। ফলে সার ও কীটনাশক দিতে হয় না।
ইতোমধ্যে এ হাউসে ১০ হাজার চারা তৈরি করা হয়েছে বলেও জানান তিনি।
এই উদ্যোক্তা বলেন, ‘আমি ঝিনাইগাতীর সফল নার্সারি মালিক বলে আমাকে এই পলিনেট হাউসটি দিয়েছেন কৃষি বিভাগ। আমি এতে খুব খুশি। আমি এ পলিনেটে অসময়ের সবজি চাষ ও চারা উৎপাদন করে সফলতা পাচ্ছি। আমার এখান থেকে অনেকে চারা সংগ্রহ করছে। অসময়ে বিভিন্ন সবজি চাষ করার ফলে বেশি দামে বিক্রি করতে পারছি।’
তবে এই চাষাবাদ লাভজনক হবে কি না তা নিয়ে নিজে একটু শঙ্কায় ছিলেন বলেও জানান ফজলুল হক। বলেন, ‘আবাদ শুরুর পর দেখি এ পদ্ধতি বেশ ভালো। সারা বছর এখানে বিভিন্ন ধরনের ফসল চাষ করে আমরা লাভবান হতে পারব।’
নালিতাবাড়ীর আরেক উদ্যোক্তা বকুল মিয়া বলেন, ‘আমি এ পলিনেটের মাধ্যমে অনেক সুবিধা পাচ্ছি। এতে অসময়ের সবজি চাষ করা যায়। আমার এখান থেকে অনেকে চারা সংগ্রহ করছে। আমি ভালোই সাড়া পাচ্ছি। ইতোমধ্যে এই হাউসে টম্যাটো, ফুলকপি, ক্যাপসিকাম, কলাসহ বিভিন্ন ধরনের ফল ও শাক-সবজি লাগানো হয়েছে। এইটা দেশের সব জায়গায় করলে সব কৃষক এইটার সুফল ভোগ করবে আমাদের মতো।’
চাষিরা জানান, এই পদ্ধতিতে সার ও কীটনাশক ছাড়াই সব ধরনের শাক-সবজি, ফল রোপণ ও চারা উৎপাদন করা হয়। এতে খরচ কম ও লাভ বেশি হওয়ায় আগ্রহ বাড়ছে অন্য চাষিদের মাঝে। প্রতিদিনই এই হাউস দেখতে আসছেন কৃষকরা। লাভজনক হলে পলিনেট হাউস করবে তারাও।
পশ্চিম বাকাকুড়ার এরশাদ আলী বলেন, ‘আমি আসলেও প্রথমে ভাবছিলাম এনো সবজি হব না। এখন দেহি ভালাই সবজি হইছে। আমিও এডা পলিনেট হাউস করবার চাইতাছি।’
কৃষক লাদেন মিয়া বলেন, ‘পলিনেটে তো শীতকালের সবজি এহনি পাওয়া যাইতাছে। এইডাতে তো মেলা লাভ। এহন টম্যাটোর দাম বাজারো ১৫০ টাহা কেজি। আর এহন বেইচাও ভালা টাহা পাওয়া যাইতাছে দেখলাম।’
কৃষক আব্দুল করিম বলেন, ‘আসলে এই সময়ে তো শীতকালের সবজির চারা সব জায়গায় হয় না। কিন্তু এর মধ্যে তো হইতাছে। আমি এনো থাইকা কিছু চারা নিয়া লাগাইছি। এনো চারা তো কম সময়ের মধ্যেই হয়ে যাই।’
আব্দুল ওহাব বলেন, ‘ওয়াদুদ ভাইয়ের মত যদি আমাগোরে কৃষি বিভাগ একটু সাহায্য করে এডা পলিনেট হাউস বানাই দেয়। তাহলে আমিও এই রহম কইরা সবজি চাষ করতাম।’
ঝিনাইগাতী উপজেলা কৃষি অফিসার কৃষিবিদ হুমায়ুন দিলদার বলেন, ‘এই পদ্ধতিতে কৃষকরা সারা বছর সবজি চাষ করতে পারবেন। এতে তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করে সব ধরনের সবজি চাষ করে কৃষকরা আর্থিকভাবে লাভবান হতে পারেন। কৃষি বিভাগ থেকে এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় পরামর্শ দেয়া হচ্ছে। এই পদ্ধতির সুবিধা দেখে এলাকার অনেক কৃষকই এ ব্যাপারে আগ্রহী হয়ে উঠছে।’
তিনি বলেন, ‘পলিনেট হাউস প্রযুক্তির মাধ্যমে ভারি বৃষ্টিপাত, তাপ, কীটপতঙ্গ, ভাইরাসজনতি রোগ ইত্যাদির মতো প্রতিকূল পরিস্থিতি থেকে নিরাপদ শাক-সবজি ও ফলমূল উৎপাদন সম্ভব। পলিনেটের ওপরে শেড দিয়ে তাপ নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে কৃত্রিম উপায়ে। এখানে উৎপাদিত চারা ২০ দিন পর রোপণযোগ্য হয়। মূলত অতিবৃষ্টি ও অকাল বন্যায় চারা রাখতে না পারায় বিকল্প এই চিন্তা।’