আগাম আলু উৎপাদনের একমাত্র জেলা নীলফামারীতে চলছে কৃষকদের জোর প্রস্তুতি। কেউ জমি প্রস্তুত করছেন। কেউবা আলু বীজ রোপণ করছেন। আবার কেউ আবহাওয়ার দিকে নজর রেখে আলু বীজ রোপণের প্রস্তুতি শুরু করেছেন।
নীলফামারীর কিশোরগঞ্জ উপজেলার নিতাই, পুটিমারী ও বাহাগিলি ইউনিয়নের বিভিন্ন এলাকা ঘুরে এমন চিত্র দেখা গেছে। গতবারের লোকসানের শঙ্কা কাটিয়ে এবার বাম্পার ফলন ও ভালো দামের স্বপ্ন দেখছেন হাজারো কৃষক।
নিতাই ইউনিয়নের পশ্চিম দুরাকুটি এলাকার কৃষক শামীম হোসেন বাবু বলেন, ‘এবার ২৩ বিঘা জমিতে আগাম আলু রোপণের কাজ শুরু করেছি। ৫৫-৬০ দিনের মধ্যে আলু তুলে বিক্রি করা যাবে। ৮০ থেকে ১০০ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হবে এই আগাম আলু।’
তবে জ্বালানি, সার, কীটনাশক ও শ্রমিকের মজুরি বৃদ্ধির কারণে উৎপাদন ব্যয়ও বেড়ে গেছে। আগে বিঘাপ্রতি ২৫ হাজার টাকা পর্যন্ত খরচ হলেও এবার খরচ পড়ে যাবে ৩৫ হাজার পর্যন্ত।
তিনি বলেন, ‘আলু তোলার সময় এখানে উৎসব শুরু হয়। ঢাকা চট্টগ্রামসহ বিভিন্ন এলাকার পাইকাররা ট্রাকে ট্রাকে আলু নিয়ে যায়। সে সময়ে বেশ ভালো লাগে আমাদের।’
আরেক কৃষক রুবেল রানা বলেন, ‘২০ বিঘা জমিতে আগাম আলু আবাদ শুরু করেছি। বছরে তিনটি ফসল ফলাই এক জমিতে। আমনের পর আগাম আলু, এরপর ভুট্টা লাগাব। বিঘাপ্রতি ৪০-৪৫ বস্তা আলু হলে ৩৫-৪০ হাজার টাকা লাভ আসবে। এক বিঘায় ১০-১২ বস্তা বীজ আলু রোপণ করতে হয়।’
তিনি জানান, সারা দেশের মধ্যে একমাত্র আগাম আলু উৎপাদন হয় নীলফামারীর কিশোরগঞ্জে। এ কারণে এই এলাকার কৃষকরা লাভ-লোকসান মাথায় নিয়ে এমনকি ঝুঁকি নিয়ে আলু আবাদে মাঠে নেমে পড়েন। এই এলাকা আলু চাষের জন্য উত্তম। কারণ উঁচু এলাকা হওয়ায় পানি জমে থাকে না। সে কারণে আলুর ফলনও ভালো হয়।
তিনি বলেন, ‘প্রথমে যখন আলু উঠবে, ওই আলু ১০০ টাকারও বেশি কেজি দরে বিক্রি হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। পরে আস্তে আস্তে আলুর ব্যাপকতা বাড়লে দামও কমে আসে।’
আরেক কৃষক বকুল হোসেন বলেন, ‘ছয় বিঘা জমিতে আগাম আলু চাষের প্রস্তুতি নিচ্ছি। জমি তৈরি হচ্ছে, কিন্তু আবহাওয়ার দিকে খেয়াল করছি, কারণ বৃষ্টি হলে বীজ আলু নষ্ট হয়ে যাবে। দু-একটা দিন পর্যবেক্ষণ করে রোপণে যাব।’
তিনি অভিযোগ করেন পর্যাপ্ত সার পাওয়া যাচ্ছে না, তেল ও কীটনাশকের দাম বেড়েছে, যার প্রভাব পড়ছে কৃষিতে। খরচ বাড়লেও লাভ তেমন বাড়ে না।
এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, একেকটি জমিতে আট-দশজন মিলে দল বেঁধে আলু রোপণে কাজ করছেন শ্রমিকরা। কেউ রশি টেনে লাইন তৈরি করছেন, কেউ কোদাল দিয়ে বীজ ভরাট করছেন, কেউ বীজের গর্ত তৈরি করছেন।
জানতে চাইলে কৃষক আজিজার রহমান বলেন, ‘জিনিসপত্রের দাম বেড়েছে। সে কারণে আমাদেরও মজুরি বেড়েছে। চার শ টাকা হাজিরা পাই, তাও দিয়া হয় না।’
আরেক শ্রমিক একরামুল হক জানান, গত বছর কয়েক দফায় বৃষ্টি হওয়ার কারণে বীজ নষ্ট হয়েছে। কৃষক দাম পায়নি। এইবার ঝুঁকি নিয়ে কৃষক আলু লাগিয়েছে।
উপজেলা কৃষি দপ্তর সূত্র জানায়, চলতি মৌসুমে ৬ হাজার ৬৫০ হেক্টর জমিতে আগাম আলু চাষের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। উপজেলার নিতাই, বাহাগিলি, পুটিমারী, রণচন্ডিসহ আরো কয়েকটি ইউনিয়নে আগাম আলু হয়ে থাকে। নীলফামারী জেলার আলুই দেশে সবার আগে ক্ষেত থেকে বাজারে যায়।
জানতে চাইলে কিশোরগঞ্জ উপজেলার অতিরিক্ত কৃষি কর্মকর্তা তুষার কান্তি রায় বলেন, ‘সেপ্টেম্বরের ২০ থেকে আগাম আলু রোপণ শুরু হয়, যা চলে অক্টোবরের মাঝামাঝি পর্যন্ত। যেহেতু দেশের একমাত্র জেলা নীলফামারীতে আগাম আলু হয়, এ কারণে কৃষকদের দিকে বিশেষ নজর দিতে হয়, যাতে কোনোভাবে ফসল ক্ষতিগ্রস্ত না হয়।’
কিশোরগঞ্জ উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান আবুল কালাম বারী পাইলট জানান, ‘এ উপজেলায় ব্যাপক আকারে আলু উৎপাদন হলেও তা সংরক্ষণের অভাবে কৃষকরা ভালো দাম থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। এ কারণে হিমাগার স্থাপন এবং আলুভিত্তিক বিভিন্ন কারখানা স্থাপন করা হলে কৃষকরা লাভবান হবেন।’