জামালপুরের ইসলামপুরে প্রায় ৬ কোটি টাকার মিনি স্টেডিয়াম নির্মাণের জন্য ব্রহ্মপুত্র নদ থেকে একাধিক অবৈধ ড্রেজার দিয়ে এক মাস যাবৎ অপরিকল্পিতভাবে বালু উত্তোলন চলছে। ফলে হুমকিতে পড়েছে ১৩৩ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত একটি সেতু।
স্থানীয়দের দাবি, ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিরা প্রভাবশালী হওয়ায় ব্যবস্থা নিচ্ছে না জেলা প্রশাসন। তবে জেলা প্রশাসন বলছে, এটি বন্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে।
স্থানীয় পর্যায়ে ক্রীড়া চর্চা বাড়াতে জামালপুরের ইসলামপুরের দক্ষিণ শুভাকুড়া গ্রামে তৈরি করা হচ্ছে শেখ রাসেল মিনি স্টেডিয়াম। জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ এবং যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের অধীনে তিন একর জমির ওপর এ স্টেডিয়াম বানাতে ব্যয় ধরা হয়েছে প্রায় ৬ কোটি টাকা।
এটি বানাতে ব্রহ্মপুত্র নদে একাধিক ড্রেজার মেশিন বসিয়ে এক মাস ধরে অবৈধভাবে বালু উত্তোলন করছেন ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান বিনিময় কনস্ট্রাকশনের প্রভাবশালী প্রতিনিধি।
শুভাকুড়া গ্রামের বাসিন্দা আজাহার আলী নিউজবাংলাকে বলেন, ‘এক মাস যাবৎ নদী থাইকে ড্রেজারে মাটি কাইটে স্টেডিয়াম মাঠের মাটি কাটা হয়তাছে।’
মিনি স্টেডিয়ামের পশ্চিম পাশে রয়েছে ৫৬০ মিটার দৈর্ঘ্যের শহীদ মেজর জেনারেল খালেদ মোশাররফ বীর-উত্তম সেতু। ২০১৮ সালে ইসলামপুরের সঙ্গে বকশীগঞ্জ উপজেলা ও শেরপুর জেলাকে সরাসরি সংযুক্ত করতে ১৩৩ কোটি টাকা ব্যয়ে সেতুর নির্মাণকাজ শেষ করে এলজিইডি। এ সেতুর ৩০ মিটারের মধ্যে একাধিক অবৈধ ড্রেজার মেশিন দিয়ে অপরিকল্পিতভাবে বালু উত্তোলনের কারণে ধসে পড়েছে সেতুর পূর্ব পাশের অ্যাপার্টমেন্টের সিসি ব্লক। বালু উত্তোলন দ্রুত বন্ধ না হলে সেতুটি ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা করছে স্থানীয়রা।
ব্রিজ এলাকার বাসিন্দা মো. শাকিল নিউজবাংলাকে বলেন, ‘নদীর অবস্থা খুব খারাপ। শুধু ড্রেজারের কারণে ভয়াবহ ভাঙন শুরু হইছে। কোন সময় জানি এই শতকোটি টাকার ব্রিজ ভাইঙে পইড়ে যাব গা। এইগুলা তো ঠিক না। সরকারের পদক্ষেপ নেয়া উচিত।’
সেতু দিয়ে নিয়মিত চলাচলকারী ইজিবাইকচালক হৃদয় বলেন, ‘এই ব্রিজ দিয়ে শেরপুর-বকশীগঞ্জের লোকও আসা-যাওয়া করে। নিয়মিত লাখ লাখ মানুষ যাতায়াত করে। এই ব্রিজটার যদি কোনো ক্ষয়ক্ষতি হয়, আমাদের অনেক কষ্ট হবে। এর জন্য আমাদের বালু তোলা বন্ধ করা দরকার।’
নদীতীরবর্তী বাসিন্দাদের দাবি, অপরিকল্পিতভাবে বালু উত্তোলনের ফলে নদের পূর্বপাড়ে দেখা দিয়েছে ভাঙন। এতে হুমকিতে রয়েছে শত শত একর ফসলি জমি ও বেশ কিছু বসতভিটা। বালু উত্তোলনে বাধা দেয়ায় হুমকির মুখেও পড়তে হচ্ছে তাদের।
সেতু এলাকার বাসিন্দা মিজানুর রহমান নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আমার বাড়ি-ঘরের অবস্থা খুব খারাপ। কাছারের ওপরে এখন ভাঙতাছে। বালু তোলা বন্ধের জন্যেই আমরা সুপারিশ করছি। তারা সুপারিশ মানে না। ড্রেজার দিয়ে বালু কাটতাছে। তারা বলে, স্টেডিয়াম করব। আল্লাহর কাছে সইপে দিছি। আল্লাহ যদি থুয়ে দেই, থাকব। আর না হইলে যাওয়া লাগব।’
সেখানকার বাসিন্দা মহর আলী নিউজবাংলাকে বলেন, ‘একটা সেতুর ৩০০ মিটারের মধ্যে বালু উত্তোলন করা নিষেধ থাকলেও মাটি কাটতাছে একদম ব্রিজের ৩০ মিটারের মধ্যে। একদিকে ব্রিজের ক্ষতি হইতাছে। আরেকদিকে এই জায়গায় যত গভীর হইতাছে, আমাদের জায়গা সম্পত্তির তত ক্ষতি হইতাছে। বাড়িঘর নিয়েও হুমকির মধ্যে আছি আমরা। আমি এর জন্যে ড্রেজারে মাটি কাটবার দিমু না বইলে নিষেধ করছিলাম। মাটি কাটবার নিষেধ করার পরে তখন আংগোরে হুমকি দিছে। বলে যে, পুলিশ আসব। আইসে তগরে বাইরাব, বাইরেয়ে ধইরে নিয়ে যাব গা। হুমকির কারণে তারপর আর কোনো প্রতিবাদ করি নাই।’
এদিকে বালু উত্তোলনের কাজে ব্যবহৃত পাইপের কারণে ব্যাহত হচ্ছে নৌযান চলাচল।
ব্রহ্মপুত্র নদের মাঝি মো. মজিবর রহমান নিউজবাংলাকে বলেন, ‘এই ড্রেজারের জন্য নদী দিয়ে নৌকা চলাফেরা করা অসুবিধা হয়ে গেছে গা। বড় নৌকা চলতে পারে না। আর আমরা কোনো মতে চলতাছি। তাও উজান দিকে যাবারই পাই না।’
এ বিষয়ে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান বা এর প্রতিনিধির কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
এলজিইডির নির্বাহী প্রকৌশলী সায়েদুজ্জামান সাদেক নিউজবাংলাকে বলেন, ‘নদী ভাঙতে ভাঙতে আমাদের অ্যাপার্টমেন্টের কাছে আসে। আমাদের অ্যাপার্টমেন্টসহ প্রটেকশন ক্ষতিগ্রস্ত হয়। আমরা আমাদের এলজিইডির পক্ষ থেকে এই ব্রিজটি টিকিয়ে রাখার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।’
এদিকে এলজিইডি চাইলে পানির নিচের ক্ষতি পরিমাপ করে কারিগরি সহায়তা দিতে প্রস্তুত পাউবো। পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মোহাম্মদ আবু সাঈদ নিউজবাংলাকে বলেন, ‘এখানে পানির নিচে কতটুকু ক্ষতি হলো, কতটুকু ভাঙন আছে, রিভার বেডে কতটুক স্কাউরিং আছে, এটার সার্ভে করলে বোঝা যাবে এবং সেই অনুযায়ী এখানে মেরামতের ডিজাইন হবে।’
মোহাম্মদ আবু সাঈদ আরো বলেন, ‘এলজিইডি অনেক বড় একটি ইঞ্জিনিয়ারিং ডিপার্টমেন্ট। তার পরও যদি তারা চায়, যদি প্রয়োজন মনে করে, সে ক্ষেত্রে পাউবো কারিগরি সহযোগিতা করতে রাজি আছে।’
অবৈধভাবে বালু উত্তোলন বন্ধের বিষয়ে জেলা প্রশাসক শ্রাবস্তী রায় নিউজবাংলাকে বলেন, ‘জেলার যেকোনো জায়গায় যারা বালু উত্তোলন করবে, তাদের তালিকা তৈরি করে আমরা নিয়মিত মামলা করার জন্য তহসিলদার, ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান, মেম্বার ও সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের নির্দেশনা দিয়েছি। এই বিষয়ে আইনশৃঙ্খলা কমিটির সভার সিদ্ধান্তও আছে।’