বছরের পর বছর ধরে বাসে অতিরিক্ত ভাড়া দিয়ে আসা রাজধানীবাসীকে আশার ঝিলিক দেখিয়েও হতাশ করার উপক্রম করছে ই-টিকিটিং সিস্টেমও।
এই পদ্ধতিতে বাসে আদায় ক্ষেত্রবিশেষে অর্ধেকেও নেমেছে, কিন্তু বাদ সেধেছে পরিবহন কোম্পানি ও বাস মালিকদের মধ্যে অবিশ্বাস আর পরিবহন শ্রমিকদের অসহযোগিতা।
গত ২২ সেপ্টেম্বর রাজধানীতে প্রজাপতি, পরিস্থান, বসুমতি ও মিরপুর সুপার লিংক পরিবহনের বাসগুলোতে ওয়েবিলের বদলে এই পদ্ধতিতে ভাড়া কাটা শুরু হয়।
এতে দেখা যায়, যে দূরত্বে আগে ২০ বা ২৫ টাকা ভাড়া আদায় হতো, সেখানে ভাড়া আসছে ১৩ টাকাও।
ঢাকায় বাস ভাড়া ১০ বা ১৫ বা ২০ বা ২৫ বা ৩০ টাকা দিয়ে অভ্যস্ত যাত্রীরা দেখলেন ভাড়া হচ্ছে ১৩ টাকা বা ১৭ টাকা বা ১৯ টাকা। সরকার নির্ধারিত হারে একজন যাত্রী যত কিলোমিটার যাবেন, তিনি ভাড়া দেন ঠিক ততটুকু দূরত্বের জন্যই। আগের মতো ওয়েবিল পদ্ধতিতে মগবাজার নেমে মতিঝিলের ভাড়া দিতে হচ্ছিল না।
ই-টিকিটিংয়ে বিভিন্ন রুটে বাস ভাড়ার রিসিট। ছবি: নিউজবাংলা
সেদিন জানানো হয়, ২৫ সেপ্টেম্বর থেকে অছিম পরিবহন, রাজধানী পরিবহন ও নূরে মক্কায় ভাড়া কাটা হবে এই পদ্ধতিতে আর এক মাসের মধ্যে রাজধানীর সব বাসেই ভাড়া আদায় করতে দূরত্ব হিসাব করে আগেই টিকিট কাটা হবে।
স্বভাবত উৎফুল্ল ছিল যাত্রীরা। কিন্তু এই ‘সুখ’ তাদের কপালে কতদিন টিকবে তা নিয়ে সংশয় দেখা দিয়েছে নানা কারণে।
পরীক্ষামূলক যাত্রার পরের দিন থেকেই বিভিন্ন রুটে বাস কমিয়ে দেয়া হয়, আবার শুরুতে আগে টিকিট না কেটে যাত্রী তুলতে বাধা দিলেও পরে যেখান-সেখান থেকে যাত্রী তোলা শুরু হয়, আবার টিকিট কাটার পর বিশেষ করে রাতে পুরো গন্তব্যে না গিয়ে যাত্রীদের আগেই নামিয়ে বাস ঘুরিয়ে দেয়ার অভিযোগ পাওয়া যেতে থাকে। যাত্রীরা ভাড়া চাইলে তাদের জানিয়ে দেয়া হয়, টিকিট কাটা হয়ে গেছে, আর ফেরত দেয়া সম্ভব নয়।
মালিকদের অভিযোগ, বাসে কত টাকা আয় হয়, তা জানানো হয় না তাদের। বরং নানা খরচের অজুহাত দেখিয়ে টাকা কেটে রাখা হচ্ছে। বিপরীতে পরিবহন কোম্পানির কর্মকর্তারা বলছেন, পরীক্ষামূলকভাবে চালানোর শুরুতে কিছু সমস্যা থাকবে, সেগুলো সমাধান হয়ে যাবে।
প্রজাপতি ও পরিস্থান বাস যে রুটে চলে এই রুটের বর্তমান চিত্র হচ্ছে দিনের গুরুত্বপূর্ণ সময়ে এই রুটে যাত্রীদের হুড়োহুড়ি দেখা যায়। কারণ হিসেবে যাত্রীরা বলছেন, আগের থেকে বাস অনেক কমে গেছে।
আবার রাস্তার মাঝে মাঝে থামিয়ে যাত্রী নেয়া হচ্ছে। অনেকে টিকিট না নিয়েই বাসে উঠে যাচ্ছেন। ফলে টাকাটা শ্রমিকদের পকেটে চলে যাচ্ছে।
একটি বাসের চালক মো. ইলিয়াস বলেন, ‘মালিকদের লাভ নাই। সবাই বাস বন্ধ করে দিচ্ছে। তাই যাত্রীর চাপ বেশি। চালক-হেলপারদেরও আয় কমে গেছে বলে তারাও মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে।’
মিরপুরের কাজীপাড়া থেকে ধানমন্ডি ২৭ নম্বর পর্যন্ত বাসের যাত্রী ইয়াসমিন আরা নিউজবাংলাকে বলেন, ‘এখন অনেকেই টিকিট ছাড়া বাসে ওঠে। প্রথম দিন কড়াকড়ি থাকলেও কন্ডাক্টররা এখন টিকিটের বদলে টাকা নেয়।’
অস্বচ্ছতার অভিযোগ বাস মালিকদের, অস্বীকার বাস কোম্পানির
ইকবাল হোসেনের দুটি গাড়ি চলে প্রজাপতি পরিবহনের ব্যানারে। ই-টিকিটিংয়ে ভাড়া কাটা শুরুর দুদিন পর বন্ধ করে দিয়েছেন একটি।
কারণ জানতে চাইলে তিনি নিউজবাংলাকে বলেন, ‘ওয়েবিলে সব খরচ বাদে দিনে তিন থেকে সাড়ে তিন হাজার টাকা পেতাম। ই-টিকিট চালু হওয়ার প্রথম দিনে এক সিঙ্গেল মারা হলো। কিন্তু কোনো হিসাব পেলাম না। কিন্তু আমার এক হাজার টাকার তেল খরচ হলো। প্রথম দিন ভেবে লস দিলাম। এরপর তিন দিন কোনো হিসাব দিল না।’
তিনি বলেন, ‘একেক দিন তিন ট্রিপে তেল লাগে ৬ হাজার টাকার। তিন দিনে ১৮ হাজার টাকা দিলাম। ড্রাইভার-স্টাফকে দিলাম তিন হাজার। এরপর কোম্পানির সঙ্গে যোগাযোগ করলাম। তারা সব খরচ কেটে দিনে আমায় এক দিনে ৫ হাজার ৭০০ টাকা। কিন্তু আমার খরচ আরও বেশি। বাকি টাকা কি আমি পকেট থেকে দেব? পরে তারা বলে, কিছু বলার নাই। দুই-চার দিন যাক ঠিক হয়ে যাবে।’
ইকবাল হোসেন বলেন, ‘প্রতিদিন লস। এরপর বেশ কয়েকজন মালিক নিয়ে আমরা রাগারাগি করলাম। পরে সব মিলিয়ে গত আট দিনে দুই হাজার টাকা পেয়েছি। এই দুই হাজার টাকা আবার মবিল আর গ্লাস লাগাতে চলে গেছে।’
কোম্পানি থেকে হিসাব দেয়া হয় না- এটা আক্ষেপ এই বাস মালিকের। বলেন, ‘কোম্পানি কত টাকার টিকিট বিক্রি করতেছে, গাড়ি কয়টা চলতেছে এইগুলোর কোনো হিসাব আমরা পাচ্ছি না।’
একই পরিবহনের তিনটা বাসের মালিক আবদুল আজিজ বলেন, ‘আগে প্রজাপতি বাস ১০০টার ওপরে চলত। এখন ৪০ থেকে ৫০টা চলে। মালিকরা টাকা পাচ্ছে না, গাড়ি কেন চালাবে?’
ইকবালের মতো তিনিও বলেন, ‘টাকার কোনো হিসাব পাই না আমরা। আজকে গাড়ি চলেছে পরশু হিসাব দেবে। তাদের ইচ্ছামতো টাকা দেয়। তিন ট্রিপ মারলে সাত থেকে সাড়ে আট হাজার টাকা দেয়।
‘পরশু দিন গাড়ি চলেছে, আজকে হিসাব দিয়েছে সাড়ে আট হাজার টাকা। গাড়ির তেল খরচ ৬ হাজার, স্টাফের বেতন ২ হাজার ১০০ টাকা। তাহলে আমার থাকল ৪০০ টাকা। আর গাড়ির পেছনে ছোটোখাটো অনেক খরচ থাকে। সব মিলিয়ে লসে চলতেছে। গাড়ির মালিকরা গাড়ি বন্ধ না করে কী করবে?’
টাকা আত্মসাতের সুযোগ নেই: পরিবহন কোম্পানি
বাস মালিকদের অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে প্রজাপতি পরিবহনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক কে এম রফিকুল ইসলাম নিউজবাংলাকে বলেন, ‘প্রতিদিন যে গাড়ি চলে মালিকরা তার পরের দিন টাকা পেয়ে যায়। এখানে আত্মসাৎ করার কোনো সুযোগ নাই। যে টিকিট বিক্রি হয় তা চাইলে বাস মালিকরা দেখতে পারে।’
মালিকরা বলছেন তাদের কোনো হিসাব দেয়া হচ্ছে না- এমন তথ্যের ভিত্তিতে রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘মালিকরা অবশ্যই দেখেন। তাদের সামনেই আলোচনা করা হয়। সবাইকে গড় হিসেবে টাকা দেয়া হচ্ছে।’
এই পদ্ধতিতে বাস মালিকদের লাভ থাকছে না, এটি স্বীকার করেন রফিকুল। বলেন, ‘লস ঠিক না, সমান সমান থাকছে মালিকদের। কখনও দুই-এক শ টাকা লোকসান হচ্ছে।’
ঘাটারচর থেকে উত্তরাগামী পরিস্থান পরিবহনের ই-টিকিট বিক্রি করেন এক এজেন্ট। ছবি: নিউজবাংলা
একজন মালিক কেন লোকসান করে বাস চালাবে এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘আপনারাই (গণমাধ্যম) তো বলেন আমরা ভাড়া নৈরাজ্য করি। মালিক সমিতি একটা উদ্যোগ নিয়েছে, সেটা বাস্তবায়ন করতে গেলে তো কিছুটা সময় লাগবে।’
বাসে প্রচুর যাত্রী উঠছে, তাহলে লোকসান কেন হচ্ছে জানতে চাইলে রফিকুল ইসলাম অভিযোগ করেন শ্রমিকদের প্রতি। তিনি বলেন, স্ট্যান্ড থেকে টিকিট ছাড়া যাত্রী না তুললেও পরে যাত্রী তোলা হচ্ছে। আর সেই টাকা আসলে কোম্পানি পাচ্ছে না।
পরিস্থান পরিবহনের পরিচালক মো. সাগর দাবি করেন তাদের রুটে গাড়ি কমেনি। বলেন, ‘আগে এক শর মতো গাড়ি চলত আমাদের, এখনও সেই পরিমাণেই চলছে।
‘এই সমস্যা হয়েছে প্রজাপতি পরিবহনে। তাদের আগে গাড়ি ছিল ৯০টার মতো। আজকে হয়তো ২০টাও চলে না।’
নতুন পদ্ধতি বুঝতে না পারায় প্রথমে লোকসান হলেও এখন বাস কোম্পানি ও মালিকরা ভালো আছে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘এখন দিনে ১০ থেকে ১২ হাজার টাকা আমরা দিতে পারছি মালিকদের।’
তবে পরিস্থান পরিবহনের অন্তত ৭ জন বাস মালিকের সঙ্গে কথা বলে পাওয়া যায় ভিন্ন তথ্য।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে পরিস্থান তিনটি বাসের মালিক বলছেন, ‘আগে সব খরচ বাদ দিয়ে প্রতিদিন দুই থেকে আড়াই হাজার টাকা লাভ পেতাম। বর্তমানে খরচ বাদ দিয়ে টাকাই পাচ্ছি না।’
বাস মালিকদের অভিযোগের বিষয় জানার পর ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির সাংগঠনিক সম্পাদক মাহাবুবুর রহমান নিউজবাংলাকে বলেন, ‘গতকাল আমিও এই অভিযোগ পেয়েছি। অভিযোগ পেয়ে প্রজাপতির ব্যবস্থাপনা পরিচালকের সঙ্গে কথা বলেছি। তিনি বলেছেন, বাস মালিকদের ১০ হাজার টাকা করে দেয়া হচ্ছে। পরিস্থানের বাস মালিকরা দিনে দেড় হাজার থেকে ১ হাজার ৭০০ টাকা লাভ পাচ্ছেন।’
তিনি বলেন, ‘রাজধানী ও বসুমতি পরিবহন ভালোই লাভে চলছে। মালিকরাও খুশি। প্রজাপতি পরিবহনের সমস্যাই বেশি পেয়েছি। আমি লোক পাঠাচ্ছি তাদের অফিসে। সমাধান করছি বিষয়টা।’