প্রশ্ন: নেতৃত্বের দ্বন্দ্বে গণফোরাম কি ভেঙে গেছে? আপনাদের তো বহিষ্কার করেছেন মোস্তফা মহসীন মন্টুরা?
ডা. মিজানুর রহমান: গণফোরামের নামে তারা যে কমিটি করেছিল, সে কমিটিতে আমার কোনো সম্মতি ছিল না। তারা যে কমিটি ডিক্লেয়ার করেছে, তার সঙ্গে আমার এবং আমাদের সভাপতি ড. কামাল হোসেনের কোনো সম্পৃক্ততা ছিল না। তারা যে কাউন্সিল করেছে, সেখানে আমি উপস্থিত ছিলাম না। দ্বিতীয় বিষয়টি হলো- কমিটি ঘোষণা করে কমিটির যে মিটিংগুলো করেছে, কোনোটায় আমার সম্পৃক্ততা কখনও ছিল না। ফলে তারা নিজেরা কারও নাম ব্যবহার করা এবং তাদের বহিষ্কার করা– এটা তাদের নিজস্ব বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ ব্যাপারে আমার এবং আমার দলের সভাপতি ড. কামাল হোসেনের যেহেতু কোনো সম্পৃক্ততা ছিল না, সে হিসেবে তাদের এ বিষয়টি ভিত্তিহীন ও অযৌক্তিক।
প্রশ্ন: মোস্তফা মহসিন মন্টু নেতৃত্বাধীন অংশের নেতারা তো বলছেন তারা কাউন্সিল করে কমিটি গঠন করেছেন, যেটা নির্বাচন কমিশনও চেয়েছিল। আর তাদের নেতৃত্বেই সংগঠনগুলো রয়েছে। কিন্তু আপনারা কাউন্সিল করতে পারেননি। নির্বাচন কমিশন কোন কমিটির কথা শুনবে?
ডা. মিজানুর রহমান: আমাদের গঠনতন্ত্রে আছে দলের প্রধান ড. কামাল হোসেন। মানে সভাপতি হচ্ছেন দলের প্রধান। কাউন্সিল করতে হলে দলের প্রধানের সম্মতি লাগবে এবং ৩০ দিন আগে গঠনতন্ত্র অনুসারে নোটিশ দিতে হবে। কাউন্সিলের সিদ্ধান্ত থাকতে হবে। সেই সিদ্ধান্ত অনুযায়ী সারা বাংলাদেশ থেকে ডেলিগেট ও কাউন্সিলরা আসবেন। সেভাবেই কাউন্সিল করতে হয়। কিন্তু ওনারা যেটা করছেন, দলের সভাপতির সম্মতি যদি না থাকে, উপস্থিতি না থাকে, তারা নিজেরা কাউন্সিল করে তো সেটাকে মূল দলের দাবি করতে পারেন না। এতে গণফোরাম কিংবা দলের সভাপতি ড. কামাল হোসেনের কোনো সম্পৃক্তরা ছিল না। যার ফলে নির্বাচন কমিশনে তারা যে কমিটি জমা দিয়েছে, সেটা এমনিতেই বাতিল হয়ে গিয়েছে।
প্রশ্ন: কিন্তু ওনারা তো বলছেন, ওনারা যখন কাউন্সিল করেছেন, তখন ড. কামাল হোসেনের সায় ছিল। এ কারণে দলের উপদেষ্টা পরিষদে ওনারা তাকে রেখেছিলেন।
ডা. মিজানুর রহমান: তারা যে কাউন্সিল করেছে, সেখানে ড. কামাল হোসেনের কাছে গিয়ে বলেছেন যে আমরা একটা সম্মেলন করছি। আপনি শুভেচ্ছা জানাবেন। কিন্তু ড. কামাল হোসেন কিন্তু গণফোরামের নামে কোনো শুভেচ্ছা দেননি। উনি ওনার ব্যক্তিগত প্যাডে তাদের শুভেচ্ছা জানিয়েছেন। সেখানে তিনি উল্লেখ করেননি যে গণফোরামের নামে যে কাউন্সিল হচ্ছে, তাকে আমি শুভেচ্ছা জানাচ্ছি। এখন যদি কোনো ব্যক্তি নিজে একটা দল গঠন করে কিংবা তারা যদি কাউন্সিল করে, এটা তো তার ব্যক্তিস্বাধীনতার ব্যাপার। কিন্তু গণফোরামের নামে ড. কামাল হোসেন কোনো শুভেচ্ছা বার্তা দেননি। আর যদি কাউকে উপদেষ্টা কিংবা কোনো পদে রাখেন, তার একটা সম্মতিপত্রের দরকার হয়। সেখানে ড. কামাল হোসেন তাদের উপদেষ্টা পদ গ্রহণ করেছেন– এই মর্মে কোনো প্রমাণ তারা দেখাতে পারেননি। তারা নিজেরাই পদে রাখছেন, আবার নিজেরাই অব্যাহতি দিচ্ছেন। এটা তো তাদের নিজস্ব ব্যাপার।
প্রশ্ন: কিন্তু ওনারা তো বলছেন, দলে অধিকসংখ্যক নেতা-কর্মী ওনাদের সঙ্গেই আছেন। এ বিষয়ে কী বলবেন?
ডা. মিজানুর রহমান: ড. কামাল হোসেন দলের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি। এখন সারা বাংলাদেশের সব নেতা-কর্মী তার সঙ্গেই আছেন। ওনারা বাইরে থেকে কে কী বললেন, সেটা তো আমাদের বিষয় না। কারণ গণফোরাম মানেই ড. কামাল হোসেন এটা আমরা মনে করি।
প্রশ্ন: তাহলে দলের কত শতাংশ নেতা-কর্মী আপনাদের সঙ্গে রয়েছেন?
ডা. মিজানুর রহমান: আমাদের সঙ্গে যারা গণফোরাম করেন, তারা সবাই আছেন। আমরা গণফোরামে বিভক্তি দেখি না। গণফোরাম যারা করতেন, তারা অনেকেই বিভিন্ন রাজনৈতিক দলে চলে গেছেন। অনেকে এমপি-মন্ত্রী হয়েছেন। এখন গণফোরাম থেকে বেরিয়ে যদি কেউ কোনো দল করে, সেটা তাদের নিজস্ব স্বাধীনতার ব্যাপার। গণফোরাম থেকে কত শতাংশ লোক চলে গেছে, এটা আমাদের কাছে দেখার বিষয় না। আমরা মনে করি, গণফোরাম বলতে ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে আমরা ঐক্যবদ্ধ। আর যদি এখান থেকে গিয়ে কেউ রাজনৈতিক দল করে, সেটার সঙ্গে গণফোরামের কোনো সম্পৃক্ততা নেই।
প্রশ্ন: দলে বিভক্তির জন্য মন্টুপন্থিরা আপনাদের দায়ী করেন। আর দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ও তো তাদের দখলে। তাহলে প্রকৃত গণফোরাম মানুষ কোন অংশকে বলবে?
ডা. মিজানুর রহমান: কোন দলীয় অফিস কার দখলে আছে, সেটা বিবেচ্য বিষয় না। আগে আমাদের অফিস ছিল কাকরাইলে, এরপর আরামবাগে। কোনো অফিস আমাদের নিজস্ব নয়, ভাড়ায় নেওয়া হয়। এটা পরিবর্তনশীল। তাই একটা ভাড়ার অফিস অর্থাৎ অস্থায়ী কার্যালয়ের সঙ্গে গণফোরামের বিভক্তি বোঝা যায় না।
আর নির্বাচন কমিশন তো ড. কামাল হোসেনের যে কমিটি এবং সম্পৃক্ততা সেটাকেই গণফোরাম হিসেবে চিহ্নিত করে। এর বাইরে আপনি যাদের কথা বলছেন, তারা কমিটি করে দিয়েছিল। কিন্তু নির্বাচন কমিশন তো তাদের স্বীকৃতি দেয়নি। কাজেই অন্য কেউ গণফোরাম নাম দাবি করাটাও অযৌক্তিক।
প্রশ্ন: মন্টুপন্থিরা বলছেন, দলের নিষ্ক্রিয়রা আপনাদের বর্তমান কমিটিতে রয়েছেন। এ বিষয়ে কী বলবেন?
ডা. মিজানুর রহমান: এটা ওনাদের নিজস্ব অভিব্যক্তি। কারণ গণফোরামে কে নিষ্ক্রিয় আর কে সক্রিয়, তা গণফোরামের নেতা-কর্মীরা ঠিক করবেন। মোস্তফা মহসিন মন্টুর তো এটা বলার সুযোগ নেই। উনি তো নিজেও একসময় বিএনপিতে যোগদান করেছিলেন।
প্রশ্ন: গণফোরামের নতুন কমিটি করা হলো গত ১৭ সেপ্টেম্বর। যার নেতৃত্বে আপনি আছেন, নতুন নেতৃত্বের প্রধান লক্ষ্য কী হবে?
ডা. মিজানুর রহমান: গণফোরামের যে আদর্শ ও লক্ষ্য আছে, এ অনুসারে আমাদের দল পরিচালিত হবে। এটার কর্মসূচি আছে, আমাদের সাংগঠনিক কর্মকাণ্ড আছে, এটা চলমান। আমরা যারা আছি, প্রত্যেকে গণফোরামের প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে আছি। আমরা প্রত্যেকেই গণফোরামের বিভিন্ন কমিটিতে দায়িত্ব পালন করেছি। গণফোরামে কেউ নবাগত নই।
প্রশ্ন: কিন্তু জাতীয় ইস্যুতে তো আপনাদের কর্মসূচি দেখা যাচ্ছে না।
ডা. মিজানুর রহমান: আমরা সব সময় কাজের মধ্যেই আছি। আমাদের এখন মূল লক্ষ্য জেলা কমিটিগুলো সক্রিয় করা। তারপর নতুন সদস্য সংগ্রহ করা। আমরা রাজনৈতিক দল হিসেবে শক্তি সঞ্চয় করছি। এর পাশাপাশি যেসব কর্মসূচি আছে, সেখানে আমরা জেলায় জেলায় অ্যাক্টিভিটিস বাড়াচ্ছি। আমরা জনগণের মৌলিক বিষয়গুলো নিয়ে মূলত রাজপথে থাকব। আমরা সব জায়গায় সক্রিয়ভাবে কাজ করব।
প্রশ্ন: আসন্ন নির্বাচন নিয়ে আপনার দলের চাওয়াটা কী? আপনারা কি বিএনপির সঙ্গে জোট করবেন?
ডা. মিজানুর রহমান: বিএনপির সঙ্গে জোট করার এই মূহূর্তে আমাদের সিদ্ধান্ত নেই। রাজনৈতিকভাবে দলের লক্ষ্য, উদ্দেশ্য, চাহিদা এবং জনগণের চাহিদা ও সংকট আছে সেগুলো নিয়ে কাজ করব। নির্বাচন যখন আসছে, গণফোরাম একটি নির্বাচনমুখী দল। অতীতে জাতীয় নির্বাচনে গণফোরাম অংশগ্রহণ করেছে। কোনো নির্বাচনই বয়কট করেনি। আমরা একটি রাজনৈতিক দল হিসেবে মাঠেও আছি এবং অবস্থা অনুসারে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করব।
গণফোরামের সাধারণ সম্পাদক ডা. মো. মিজানুর রহমানের সাক্ষাৎকার নেন নিউজবাংলার প্রতিবেদক আল হেলাল শুভ। ছবি: নিউজবাংলা
প্রশ্ন: গত নির্বাচনে আপনার দল বিএনপির সঙ্গে জোট করেই নির্বাচন করেছে। এবার দেখা গেল এখন পর্যন্ত সব দলকে নিয়ে বিএনপি সংলাপ করলেও আপনার সঙ্গে করেনি। কারণ কী বলে মনে করেন?
ডা. মিজানুর রহমান: গত নির্বাচনের প্রেক্ষাপটে আমাদের দলীয়ভাবে সিদ্ধান্ত হয়েছিল, যে কারণে ঐক্যফ্রন্ট গঠিত হয়েছিল। কিন্তু নির্বাচনের পর সেই ঐক্যফ্রন্টের অস্তিত্ব আর ছিল না। এখন নতুন করে তো আর কোনো মেরুকরণ আমাদের দল থেকে হয়নি। আর বিএনপি আমাদের ডাকল কি, ডাকল না সেটার ওপর আমাদের রাজনীতি নির্ভর করে না।
আগামী নির্বাচনে জনগণের প্রত্যাশা অনুসারে আমরা, দলের নেতা-কর্মী এবং বিভিন্ন ফোরামের সঙ্গে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করব যে আমরা ভবিষ্যৎ রাজনীতিতে কী করব?
প্রশ্ন: গত নির্বাচনের পর তো ঐক্যফ্রন্টে যাওয়া নিয়ে দলে মতপার্থক্য হয়েছে। তাহলে ড. কামাল হোসেন কেন ওই নির্বাচনে গিয়েছিলেন?
ডা. মিজানুর রহমান: তখনকার প্রেক্ষাপটে ঐক্যফ্রন্ট করা ও রাজনীতিতে অংশগ্রহণ করা ছিল একটা সময়ের দাবি। সেটা তো একটি নির্বাচনি জোট হয়েছিল। স্থায়ী কোনো জোট ছিল না। নির্বাচনের পর সেই জোটের অবস্থানটাও শেষ হয়ে যায়।
প্রশ্ন: বর্তমান সরকারের অধীনে আপনার দল নির্বাচনে যাবে কি?
ডা. মিজানুর রহমান: এটা আসলে সরকারের ওপর নির্ভর করবে। সরকার কতটুকু অবস্থান নেবে এবং নির্বাচনে পরিবেশ কতটুকু করবে– তার ওপর নির্ভর করে। এখনই সেটা বলার মতো সময় আসেনি।
প্রশ্ন: পরিবেশ তৈরি করতে পারলে এই সরকারের অধীনে নির্বাচনে যাবেন?
ডা. মিজানুর রহমান: এই সরকারের অধীনে নির্বাচনে যেতে তো একটা পরিবেশ লাগবে। তার পরও নির্বাচন কমিশনের যে সকল কথাবার্তা আমরা দেখছি, এটাকে আমরা খুব একটা ইতিবাচক হিসেবে নিচ্ছি না। যেমন ইভিএম নিয়ে তাদের বক্তব্য দেশের মানুষ কিন্তু ভালোভাবে নিচ্ছে না। তার পরও গণফোরাম একটি নির্বাচনমুখী দল। নির্বাচনের আগে সকল বিষয় বিবেচনায় নিয়ে আমরা কাজ করব।
প্রশ্ন: ড. কামাল হোসেন দলের বিভক্তি ঠেকাতে পারেননি। এবার ওনার নেতৃত্বে নির্বাচনে গেলে দলের খণ্ডিত একটি অংশ নিয়ে কতটি আসনে প্রার্থী দিতে পারবেন?
ডা. মিজানুর রহমান: আমরা কিন্তু দলের খণ্ডিত অংশ মনে করি না। কারণ গণফোরামের প্রতিষ্ঠাতা ড. কামাল হোসেন। আমরা ২৯ বছর ধরেই তার রাজনীতি করে আসছি। নানা কারণেই অনেকে দল থেকে চলে গেছেন। কিন্তু মূল দলের নেতা তো ড. কামাল হোসেন। এখানে খণ্ডিত অংশ হওয়ার সুযোগ নেই।
প্রশ্ন: ২৯ বছর ধরে গণফোরাম জনগণের সঙ্গে তেমন সম্পৃক্ত হতে পারেনি। এর জন্য কাকে দায়ী করবেন?
ডা. মিজানুর রহমান: আসলে বাংলাদেশের রাজনীতিটা হয়ে গেছে কালো টাকা ও পেশিশক্তি-নির্ভর। নীতিনিষ্ঠ রাজনীতি তো এখন অনেকটাই অনুপস্থিত। আমরা শুরু থেকে যে লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য ঘোষণা করেছিলাম, সেখান থেকে গণফোরাম কখনও বিচ্যুত হয়নি। আমরা একটি নীতিনিষ্ঠ রাজনীতি মানুষের কাছে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছি। আমরা দলের শুরু থেকে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি নিয়েই আছি।