বছর দশেক আগেও সকালে মোড়ে মোড়ে এক বা দুই টাকার বান্ডেল বিক্রি হতো। এর ক্রেতা ছিলেন প্রধানত বাসের শ্রমিকরা। ভাড়া কাটার সুবিধার জন্য এই খুচরা কিনতেন তারা কিছু বেশি টাকা দিয়ে।
কিন্তু সর্বনিম্ন ভাড়া ৫ টাকা নির্ধারণের পর থেকে কদর হারাতে থাকে এই এক/দুই টাকার নোট। এখন সর্বনিম্ন ভাড়া ১০ টাকা আর ওয়েবিল নামে যাত্রী ঠকানোর কৌশল চালু হওয়ার পর থেকে ভাড়া কাটা হতে থাকে ১০, ১৫, ২০-এভাবে।
বছরের পর বছর ধরে যাত্রীরা ঠকে যাওয়ার পর কিলোমিটারের হিসাব করে ভাড়া আদায় নিশ্চিত করতে যে ই-টিকিটিং পদ্ধতি চালু হয়েছে, তাতে ভাড়া ক্ষেত্রবিশেষে ৫০ শতাংশ পর্যন্ত কমেছে। তবে সেই এক বা দুই টাকার নোটের অভাবে এই ভাড়া কমার পুরো সুবিধা পাচ্ছে না নগরবাসী।
এখন দূরত্ব থেকে ভাড়া আসছে ১১ টাকা বা ১৩ টাকা বা ২১ বা ২৩ টাকাও। কিন্তু যাত্রীদেরকে দিতে হচ্ছে ১৫ বা ২৫ টাকা। কারণ, টিকিট বিক্রেতার কাছে এক/দুই টাকার নোট থাকে না। আর তারা নির্ধারিত ভাড়ার চেয়ে কম নেন না, বেশিই নেন।
ভাড়া কমলেও বাকবিতণ্ডা থামেনি
ওয়েবিলে চলার সময় বসিলা ব্রিজ থেকে মিরপুর-১ নম্বর পর্যন্ত ভাড়া ছিল ২৫ টাকা। ই-টিকিটিংয়ে ভাড়া এসেছে ২১ টাকা।
কিন্তু ভাড়া কমার পরও যাত্রী শাহীন মিয়ার সঙ্গে টিকিট বিক্রেতার তর্কাতর্কির অবসান হয়নি।
বসিলা থেকে মিরপুর-১ পর্যন্ত প্রজাপতি বাসের টিকিট বিক্রেতার কাছ থেকে দুটি টিকিট নেন শাহীন। ভাড়া আসে ৪২ টাকা। তিনি ৫০ টাকার নোট দিলে তাকে ফেরত দেয়া হয় ৫ টাকা।
টিকিট বিক্রেতা স্বপনের কাছে বাকি তিন টাকা ফেরত চাইলে তাকে বলা হয়, খুচরা নাই। শাহীনও ছাড়ার পাত্র নন। তিনি ৩ টাকার জন্য তাগাদা দিতে থাকেন। এতে শাহীন ও স্বপনের মধ্যে বাগবিতণ্ডা শুরু হয়।
শাহীন নিউজবাংলাকে বলেন, ‘৪২ টাকার ভাড়া ৪৫ টাকা চেয়েছে। আমি ৫০ টাকার নোট দিয়েছি আমার কাছ থেকে প্রথমে ৪৫ টাকা রেখে ৫ টাকা ফেরত দিছে। বার বার বলেছি দুই টাকা খুচরা দিচ্ছি আমাকে ১০ টাকা ফেরত দিচ্ছে না। জোরাজুরি করার পরে দুই টাকা খুচরা রেখে ১০ টাকা ফেরত দিছে।’
আক্ষেপ করে তিনি বলেন, ‘প্রতিদিন যদি দুই-পাঁচ টাকা বেশি নেয় একজনের কাছ থেকে তাহলে চিন্তা করেন রাজধানীর এত যাত্রী থেকে কত কোটি টাকা বেশি নেয়া হচ্ছে। ন্যায্য ভাড়ার জন্য ই-টিকেটিং চালু করে সেই বেশি ভাড়াই যদি নেয়া হয়, তাহলে এটা চালু করে কী লাভ হলো?
‘তারা কেন ভাংতি টাকা রাখেন না। পাশের দেশ ভারতে টিকিট বিক্রেতারা ব্যাগ ভরে ভাংতি টাকা রাখেন। আর আমাদের দেশের এরা কীভাবে ধান্দা করা যায় সেটা খোঁজে।’
প্রজাপতি বাসের টিকিট বিক্রেতা স্বপন নিউজবাংলাকে বলেন, ‘ভাংতি ছিল না। পরে তার টাকা ফেরত দিছি।’
একই চিত্র দেখা যায় মোহাম্মদপুর বাসস্ট্যান্ডে এসে। পরিস্থান পরিবহনে অপূর্ব রায় মিরপুর ১০ নম্বর যাবেন। ভাড়া আসে ২৫ টাকা। টিকেট কেটে ৫০ টাকার নোট দিলে প্রথমে তাকে ফেরত দেয়া হয় ২০ টাকা।
তিনি বলেন, ‘ভাড়া আসে ২৫ টাকা। আমি ৫০ টাকার নোট দিয়েছি আমাকে ফেরত দিয়েছে প্রথমে ২০ টাকা। বাকি পাঁচ টাকা ফেরত চাইলে আমাকে ২ টাকা দিয়েছেন। বলতেছে ৩ টাকা খুচরা নাই।’
কেন তার পাওনা সম্পূর্ণ টাকা ফেরত দেয়া হচ্ছে না জানতে চাইলে পরিস্তান পরিবহনের টিকিট বিক্রেতা মো. পলাশ বলেন, ‘আমার কাছে ভাংতি নাই, তাই বেশি নিয়েছি। কোম্পানি থেকে আমাদের ভাংতি টাকা দেয় না। আমরাই ভাংতি টাকা নিয়ে আসি। ভাড়া আসে ১১ টাকা, ২১ টাকা। সবাই খুচরা দেয় না।’
প্রজাপতি পরিবহনের আসাদগেটে টিকিট বিক্রির দায়িত্বে থাকা মো. রাসেল নিউজবাংলাকে বলেন, ‘তারা (যাত্রী) যদি আমাদেরকে খুচরা দেয় তাহলে তো ভালো হয়। আমি প্রতিদিন ১০ হাজার টিকিট বিক্রি করি। এখন এত টাকা তো আমার খুচরা থাকে না। আমাদেরও খুচরা রাখা উচিত। আর যাত্রীদেরও খুচরা রাখা উচিত। সবাইকে খুচরা দিতে পারি না। এত খুচরা টাকা থাকে না।’
কোম্পানি থেকে খুচরা টাকা দেয়া হয় কি না জানতে চাইলে রাসেল বলেন, ‘যা দেয় তা তো শেষ হয়ে যায়। এর পরে কী করব।’
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির সাংগঠনিক সম্পাদক মাহাবুবুর রহমান নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আমি অস্বীকার করব না। ভাংতি টাকার সমস্যা অবশ্যই আছে। আমি প্রত্যেক কোম্পানির কাছে এই ম্যাসেজটা পৌঁছে দেবো। যাতে সকল কাউন্টারে ভাংতি টাকা দিয়ে দেয়। আমরা দুই টাকা আর পাঁচ টাকার ভাংতি পাচ্ছি। এক টাকার কয়েন পাচ্ছি না। আমরা বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছ থেকে ভাংতি টাকা সংগ্রহ করে কাউন্টারে দেই।’
যাত্রীদের অনুরোধ করে তিনি বলেন, ‘যাত্রীদেরও অনুরোধ করবো আপনারা ভাংতি টাকা নিয়ে কাউন্টারে আসবেন। আমি কোথায় যাব সেটা তো আমি যানি। তাই সেই পরিমাণ ভাংতি টাকা আমি নিয়ে যাব। তাহলে সমস্যাটা কমে আসবে।’
এখন প্রশ্ন হচ্ছে পরিবহন মালিক বা যাত্রীরা চাইলেই কি খুচরা পাবেন? বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে এক টাকা বা দুই টাকার নতুন নোট ছাড়া হয় না বললেই চলে। বছর কয়েক আগে কয়েন ছাড়ার পর এটি জনপ্রিয় হয়নি। পকেটে ভারী হয় বলে মানুষ কয়েনে উৎসাহ দেখায়নি। এখন এটিই কাল হচ্ছে।
প্রতিদিন কেবল খুচরার অভাবে বাস যাত্রীরা কত টাকা ঠকছে, সে বিষয়ে সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য নেই। যাত্রী অধিকার নিয়ে সোচ্চার সংগঠন যাত্রীকল্যাণ সমিতি সম্প্রতি এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে, ঢাকায় প্রতিদিন ৫০ লাখ বাস যাত্রী যাতায়াত করে। খুচরার অভাবে যদি প্রতিজন গড়ে ৩ টাকা করেও ঠকেন, তাতে প্রতিদিন বাড়তি যায় দেড় কোটি টাকা। এই হিসেবে মাসে ৪৫ কোটি আর বছরে ৫৪০ কোটি।
কেবল বাস ভাড়া নয়, বাজার করতে গিয়েও একই কারণে ঠকছে মানুষ। সবজির দাম এখন ১০ বা ১৫ বা ২০ এভাবে পাঁচ টাকা করে বাড়ে কমে, অথচ ৮ বা ৯ বা ১১ বা ১৩ টাকা-এভাবে বিক্রি হতো আগে।
প্যাকেজটাত খাবারের দাম ১০ টাকা থেকে বেড়ে এক লাফে হয়েছে ১৫ টাকা। ৫০ শতাংশ বাড়াটা যুক্তিযুক্ত কি না, এই হিসাবও কেউ করেনি।
বাজারে ভাংতি টাকার পাওয়া যাচ্ছে না কেন জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের ভারপ্রাপ্ত মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক জী এম আবুল কালাম আজাদ নিউজবাংলাকে বলেন, ‘বাজারে এক বা দুই টাকার নোট কম থাকলে পর্যাপ্ত কয়েন আছে। কিন্তু মানুষের দৃষ্টিভঙ্গীর পরিবর্তন হয়েছে। তারা আগের মতো কয়েন নিতে চায় না।’