বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

হাসপাতালের অনিয়ম পাল্টায়নি এতটুকু

  •    
  • ২৬ সেপ্টেম্বর, ২০২২ ১৪:২৬

সরকারি হাসপাতালগুলোকে চিকিৎসা নিতে যাওয়া রোগীদের পদে পদে জিম্মি করে টাকা আদায়ের চিত্র তার মাকে ভর্তি করতে গিয়ে দেখে এসেছেন রংপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের একজন চিকিৎসক। নিজের কর্মস্থলে এই অনিয়ম নিয়ে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দিয়েছেন কর্তৃপক্ষকে। কিন্তু তাতে হাসপাতালের চিত্র পাল্টায়নি।

সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে গিয়ে রোগীদের পদে পদে যে হয়রানিতে পড়তে হয়, তার স্বরূপ দেখে এসে একজন চিকিৎসক লিখিত অভিযোগ করার পরেও রংপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের চিত্র পাল্টায়নি এতটুকু। ওয়ার্ড বয়, নার্সদের ঘুষ না দিলে তাদের কাছ থেকে সেবা পাওয়া যায় না এখনও।

গত ১৯ সেপ্টেম্বর রংপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে অর্থো সার্জারি বিভাগের চিকিৎসক এবিএম রাশেদুল আমীর তার মাকে ওই হাসপাতালে ভর্তি করাতে গিয়ে সেবার আসল চিত্র দেখে আসেন।

এরপর প্রথমে ফেসবুকে নিজের অভিজ্ঞতা লেখেন এই চিকিৎক। পরে আসার সে পোস্ট ডিলিটও করে দেন। এরপর আনুষ্ঠানিক অভিযোগ জমা দেন হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের কাছে।

এ নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্যাপক হৈচৈ পড়ে এবং রংপুরে আলোড়ন তৈরি হয়। এর কারণে বিভাগীয় শহরের এই হাসপাতালটিতে চিকিৎসা নিতে গিয়ে এই ধরনের ভোগান্তিতে রোগী ও স্বজনরা নিয়মিত পড়েন।

চিকিৎসকের অভিযোগ পাওয়ার পর দুই চুক্তিভিক্তিক কর্মচারী মাসুদ ও ঝর্ণাকে বহিস্কার ছাড়াও তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি করা হয়েছে। কিন্তু যেসব অভিযোগ আনা হয়েছিল তাদের বিরুদ্ধে, সেগুলো এখনও চছে সেই আগের মতোই।

গত দুই দিন রংপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে গিয়ে ভর্তি রোগীর স্বজনদের সঙ্গে কথা বলে এমনটা জানা গেছে।

সেই চিকিৎসক যা দেখে আসেন

গত ১৯ সেপ্টেম্বর রাত সাড়ে ১১টার দিকে রংপুর মেডিক্যালেরেই চিকিৎসক এবিএম রাশেদুল আমীরের মাকে নিয়ে হাসপাতালের জরুরি বিভাগে যান অন্য স্বজনরা। হাসপাতালে ভর্তি ফি ২৫ টাকা হলেও ১০ গুণ ২৫০ টাকা চাওয়া হয় তাদের কাছ থেকে।

স্বজনরা এরপর চিকিৎসকের পরিচয় জানালে তো নেমে আসে ৫০ টাকায়, তবু তা ছিল নির্ধারিত ফির দ্বিগুণ।

ভর্তির পর রোগীকে করোনারি কেয়ার ইউনিট বা সিসিইউতে পাঠানো হলে সেখানেও দিতে হয় ২০০ টাকা নেয়। সেখানে স্বজনরা চিকিৎসকের পরিচয় দেয়ার পর তাদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করা হয়।

এর মধ্যে সেই চিকিৎসক ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়ে ভিডিও করেন। নিউজবাংলাকে তিনি বলেন, ‘আমার মাকে ভর্তি করা থেকে শুরু করে বিভিন্ন স্টেপে টাকার জন্য চাপ দেয়া হয়েছে। ওই কর্মচারী নিজে মাসুদ নামে পরিচয় দেয়। আমি বিষয়টি একসময় ভিডিও করি। সেটি আমার ফেসবুকে পোস্ট করি।’

পরে সেই ভিডিও ফেসবুক থেকে ডিলিট করে দেন চিকিৎসক রাশেদুল আর লিখিত অভিযোগ দেন হাসপাতাল পরিচালকের কাছে।

এসব ঘটনায় যে হাসপাতালে নিজে চাকরি করেন, সেখানে মায়ের চিকিৎসা নিয়ে শঙ্কিত হয়ে রিলিজ নিয়ে দেন তিনি। রোগী নিয়ে আসার সময় আবার চাওয়া হয়েছে টাকা, এবার আরও বেশি।

নিউজবাংলাকে রাশেদুল বলেন, ‘হয়ত আমার অভিযোগ অনেকে নানাভাবে নিতে পারে। সর্বশেষ গতকাল সোমবার যখন আমার মাকে হাসপাতাল থেকে রিলিজ নিয়ে চলে আসি তখনও ময়লা পরিষ্কার বাবদ আমার কাছে ৩ হাজার টাকা চাওয়া হয়েছে। এটা দুঃখজনক।’

পাঁচ দিন পর সেই একই চিত্র

চিকিৎসক রাশেদুলের হয়রানির পর কর্তৃপক্ষ আসলে কী করেছে, সেটি দেখতে বৃহস্পতি ও শুক্রবার হাসপাতালের চিত্র পর্যবেক্ষণ করে নিউজবাংলা। রোগীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সরকারনির্ধারিত ফির বাইরে টাকা না দিয়ে চিকিৎসা পাওয়ার কোনো সুযোগই নেই।

২১ দিন স্ত্রীর চিকিৎসা শেষে হাসপাতাল থেকে ছাড়পত্র নেন কুড়িগ্রামের নাগেশ্বরী উপজেলার মধুর হাইল্যা গ্রামের রফিকুল ইসলাম। গত বৃহস্পতিবার বিকালে হাসপাতাল ছাড়েন তিনি। এ সময় বিভিন্ন জনকে সাড়ে তিন শ টাকা বকশিস দিতে হয়েছে।

রফিকুল বলেন, ‘আমরা কেবিনে ছিলাম। সেখানে রুম পরিস্কারের জন্য ১০০, কাউকে দিতে হয়েছে ৫০, কাউকে দেড়শ।‘

কুড়িগ্রামের চিলমারী এলাকার তারা মিয়া বলেন, ‘আমার ছেলে লিটনকে শুক্রবার রাত ১০-১১ টার দিকে ভর্তি করাই। ভর্তির জন্য নিছে ১০০ টাকা, ঠেলাগাড়ির জন্য (ট্রলি) নিছে ২০০ ট্যাকা।’

বাড়তি টাকা দিয়ে রাগে গা জ্বলছে তার। বলেন, ‘এটা কোনো কথা হইল? ওমরা (তারা) কি বেতন ট্যাতন পায় না? আমারগুলের (আমাদের) ভরসায় থাকে...।’

লালমনিরহাটের সাহেব পাড়া গ্রামের আলী আকবর বলেন, ‘গত পরশু (বৃহস্পতিবার) আমার ভাইকে ভর্তি করেছি। ভর্তির জন্য নিছে ১০০ টাকা। আর ট্রলির জন্য নিয়েছে ১৫০ ট্যাকা। এটা কেন নেয় জানি না। প্রথমে কিছু বলে না। রোগী নিচ থেকে উপরে নিয়ে যাওয়ার পর বলে, মামা এত কষ্ট করলাম বকশিস দেন। পরে তাদের দিতে বাধ্য হই।’

তিনি জানান, প্রথমে ২০০ টাকা দাবি করছিল, তিনি দেন ১৫০।

রংপুরের তারাগঞ্জের সোহেল রানা বলেন, ‘২২ তারিখ আমার বোনকে ভর্তি করাইছি। ভর্তিতে নিছে ১০০ টাকা আর ট্রলির জন্য নিয়েছে ১২০ টাকা।’

প্রতিদিন কত আদায়, টাকা কারা নেন

হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, প্রতিদিন এই হাসপাতালে সর্বনিম্ম নতুন রোগী ভর্তি হয় ২৫০ জন। সর্বোচ্চ ৪৫০ জন ভর্তি হয়।

হাসপাতালের জরুরি বিভাগ থেকে জানা গেছে, গত ২২ সেপ্টেম্বর হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ৩৩৭ ও ২৩ সেপ্টেম্বর ভর্তি হয়েছেন ২৫৯ জন।

একেকজনের কাছে ভর্তিতে ৭৫ টাকা করে বাড়তি আদায় হলে ২২ সেপ্টেম্বর ২৫ হাজার ২৭৫ টাকা আর পরদিন ১৯ হাজার ৪২৫ টাকা বাড়তি আদায় করা হয়।

যাদের ট্রলি বা হুইল চেয়ার লেগেছে, তাদের সবার কাছ থেকে বাড়তি আদায় করা হয়েছে অর্থ।

হাসপাতালের একাধিক কর্মচারী নাম প্রকাশ না করে বলেছেন, এই বকশিস নিচ্ছেন মূলত চুক্তিভিক্তি কর্মচারী।

ওই কর্মচারী জানান, যখন কোন রোগী হাসপাতালে আসেন ভর্তি হতে আসেন, তখনই এই কর্মীরা তাকে ঘিরে ধরে কী হয়েছে, বাড়ি কোথায়, কখন আসছেন ইত্যাদি ইত্যাদি বলতে থাকে। এভাবে ভর্তি শেষ করে যখন ১০০ টাকা চায়। অনেকে গরিব মানুষ দিতে চায় না। এ নিয়ে ঝামেলা হয়।

শনিবার হাসপাতালের মূল ফটকে কথা হয় এক চুক্তিভিত্তিক কর্মচারীর সঙ্গে। তিনি নাম প্রকাশ না করে বলেন, ‘নাম বললে আমার চাকরি থাকবে না। আর চাকরি চলে গেলে আপনি নিয়েও দিতে পারবেন না। আমাদের সংসার চলবে কীভাবে? আমরা জোর করে কারও কাছে টাকা নেই না।’

তিনি বলেন, ‘আপনি বলেন, একজন রোগীকে ট্রলিতে করে নিচ তলা থেকে চার তলা পর্যন্ত নিয়ে যেতে কষ্ট আছে কি না...। আমরা চার তলায় হোক আর দোতলায় হোক, নিয়ে যাওয়ার পর বলি মামা বকসিশ দেন। এটা কি কোনো অপরাধ? কষ্ট করে তো টাকা নেই। জোর করে না।’

বিষয়টি জানতে চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী (সরকারি) নেতাদের সঙ্গে কথা বলতে চাইলে তারা কোনো কথা বলতে রাজি হননি।

তবে নাম প্রকাশ না করার অনুরোধ করে এক কর্মচারী বলেন, ‘আমরা সরকারি বেতন-বোনাস পাই। বকশিসের প্রয়োজন হয় না। চুক্তিভিত্তিক কিছু কর্মচারীরা এই কাজ করেন। দুর্নাম বা বদনাম হয় আমাদের।’

হাসপাতাল পরিচালক কী বলছেন

হাসপাতালে এই চিত্র কেন- জানতে চাইলে পরিচালক শরীফুল হাসান সাংবাদিকদের বলেন, ‘বিচ্ছিন্নভাবে পরিচ্ছন্ন কর্মীরা হাসপাতালে প্রবেশ করে। তারা আমার মতে ট্রেইনড না। হাসপাতালের সিস্টেম বা বিধি বিধান সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা না থাকার কারণে এ ধরনের কার্যক্রমে উৎসাহিত হচ্ছে। এই সিস্টেম থেকে আমরা বের হতে পারি এবং সরকারি কর্মচারীদের বিধি বিধান সেগুলো আছে, সেগুলো মানে তাহলে হাসপাতালের পরিবেশ উন্নত হবে।’

এগুলো নিশ্চিত করাই তো আপনার দায়িত্ব- এই বিষয়টি স্মরণ করিয়ে দিলে পরিচালক বলেন, ‘আমরা ইতোমধ্যে পরিচালনা পর্ষদে কথা বলেছি। এখানে সিদ্ধান্ত হয়েছে হাসপাতাল তীক্ষ্ণ তদারকি থাকবে। মানুষ যেন হয়রানির শিকার না হয়, চিকিৎসা সেবা পান সে বিষয়ে সবাইকে বলা হয়েছে।’

রোগী বা স্বজনদের অভিযোগ বা পরামর্শ জানানোর সুবিধার্থে একটি অভিযোগ বাক্স রাখার কথাও জানান তিনি। বলেন, ‘সুনির্দিষ্ট প্রমাণসহ কেউ অভিযোগ করলে আইন শৃঙ্খলাবাহিনীর মাধ্যমে সমাধান করা হবে।’

এ বিভাগের আরো খবর