বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

সিলেটে পরিবহন শ্রমিকদের বিরুদ্ধে নগরবাসীকে ‘জিম্মি’র অভিযোগ

  •    
  • ২৩ সেপ্টেম্বর, ২০২২ ১৬:৩৪

সিলেট নগর বৃহস্পতিবার রাতে আকস্মিকভাবে ৪ ঘণ্টা অবরুদ্ধ করে রাখেন পরিবহন শ্রমিকরা। এতে চরম দুর্ভোগে পড়েন নগরবাসী। মোড়ে মোড়ে অবস্থান নিয়ে রিকশা, এমনকি বাইক চলাচলেও বাধা দেয়া হয়। জরুরি কাজে কেউ বাইক নিয়ে যেতে চাইলে তাদের হেনস্তা, এমনকি মারধরের অভিযোগও উঠেছে।

নিজেদের দুই গ্রুপের মধ্যে বিরোধ নিয়ে পাল্টাপাল্টি মামলা হয়েছে থানায়। এর জেরে বৃহস্পতিবার রাতে হঠাৎ পুরো নগর অবরুদ্ধ করে ফেলেন পরিবহন শ্রমিকরা। প্রায় ৪ ঘণ্টার জন্য অচল হয়ে পড়ে সিলেট।

নগরের অন্তত ২৫টি স্থানে এলোপাতাড়িভাবে গাড়ি রেখে সড়ক অবরোধ করেন পরিবহন শ্রমিকরা। মোড়ে মোড়ে অবস্থান নিয়ে রিকশা, এমনকি বাইক চলাচলেও বাধা দেয়া হয়। জরুরি কাজে কেউ বাইক নিয়ে যেতে চাইলে তাদের হেনস্তা, এমনকি মারধরের অভিযোগও উঠেছে।

এর আগে পাঁচ দফা দাবিতে গত ১৩ সেপ্টেম্বর দিনভর কর্মবিরতি পালন করেন পরিবহন শ্রমিকরা। এতে বন্ধ করে দেয়া হয় সব ধরনের যান চলাচল। এমনকি ব্যক্তিগত গাড়ি চলাচলেও বাধা দেয়া হয়।

বৃহস্পতিবারের অবরোধ কেন?

পরিবহন শ্রমিকদের দুই গ্রুপের মধ্যে দীর্ঘদিন ধরেই বিরোধ চলছে। এই বিরোধের জেরে সম্প্রতি লেগুনা শ্রমিক ইউনিয়নের নেতা মো. শাহাব উদ্দিনকে সংগঠন থেকে বহিষ্কার করা হয়। এ নিয়ে দুই পক্ষের মধ্যে অপ্রীতিকর ঘটনাও ঘটে। এর জের ধরে ১৪ সেপ্টেম্বর দক্ষিণ সুরমা থানায় পাল্টাপাল্টি মামলা হয়।

শাহাবউদ্দিনের করা মামলায় সিলেট জেলা বাস মিনিবাস শ্রমিক ইউনিয়ন সভাপতি মইনুল ইসলাম, সিএনজি অটোরিকশা শ্রমিক ইউনিয়ন সভাপতি জাকারিয়া আহমদ, হিউম্যান হলার শ্রমিক ইউনিয়ন সভাপতি রুনু মিয়া মইন ও আওলাদ মিয়াসহ অজ্ঞাত আরও ২০-২৫ জনকে আসামি করা হয়। মামলায় মারপিট ও টাকা-পয়সা ছিনিয়ে নেয়ার অভিযোগ আনা হয়।

বৃহস্পতিবার এই মামলার ব্যাপারে সিলেট মহানগর পুলিশ কমিশনারের সঙ্গে দেখা করতে যান পরিবহন শ্রমিক নেতারা। এরপর সন্ধ্যা থেকে আচমকা সিলেট নগরের সবগুলো সড়ক অবরোধ করে দেন শ্রমিকরা। মামলা প্রত্যাহার ও পুলিশ কমিশনারের অপসারণ দাবিতে বন্ধ করে দেন যান চলাচল। মোড়ে মোড়ে অবস্থান নিয়ে রিকশা, বাইক চলাচলেও বাধা দেন শ্রমিকরা। চালক এবং যাত্রীদের মারধরও করা হয়।

অবরোধে প্রায় অচল হয়ে পড়ে সিলেট নগর। ঢাকা-সিলেট মহাসড়কেও দীর্ঘ যানজট দেখা দেয়। অবরোধের কারণে কোনো গাড়ি নগরে প্রবেশ করতে বা বের হতে পারেনি।

মামলার আট দিন পর আন্দোলনে নামার বিষয়ে বৃহস্পতিবার সিলেট জেলা বাস মিনিবাস শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতি মইনুল ইসলাম বলেছিলেন, ‘মামলার বিষয়টি আমরা আজই জানতে পেরেছি। আজ কয়েকজন শ্রমিক পুলিশ কমিশনারের সঙ্গে এ ব্যাপারে দেখা করতে যান। তিনি তাদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করেছেন।’

দুর্ভোগ-ক্ষোভ

অফিস শেষে বাড়ি ফেরার জন্য রাত সাড়ে ৭টার দিকে বাইক নিয়ে বের হন বেসরকারি চাকুরে তমজিদ হোসেন। প্রায় ৩ ঘণ্টা কিন ব্রিজের ওপর আটকে ছিলেন তিনি।

তিনি বৃহস্পতিবার রাতে নিউজবাংলাকে বলেন, ‘শ্রমিকরা সড়কে এলাপাতাড়িভাবে গাড়ি ফেলে রেখেছে। ফলে কোনো যানবাহনই যেতে পারছে না। বাইক দিয়ে যেতেও তারা বাধা দিচ্ছে। ফলে ৩ ঘণ্টা ধরে ব্রিজের ওপর আটকে আছি।’

শ্রীমঙ্গল থেকে বাসে করে সিলেট রওনা দিয়েছিলেন কল্লোল চক্রবর্তী। ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের মৌলভীবাজারের শেরপুরে আসার পর যানজটে আটকা পড়েন তিনি। দীর্ঘ সময় যানজটে আটকে থেকে আবার শ্রীমঙ্গলে ফিরে যেতে হয় তাকে।

বৃহস্পতিবার রাতে ঢাকা যাওয়ার উদ্দেশে সিলেটের কেন্দ্রীয় বাস টার্মিনালে যান বাসদ নেতা প্রণব জ্যোতি পাল। তিনি বলেন, ‘সব বাস বন্ধ রয়েছে। কেউ টিকিট বিক্রি করছে না। আচমকা এমন কর্মসূচিতে চরম দুর্ভোগে পড়েছি।’

পরিবহন শ্রমিকদের এই অবরোধে সাধারণ মানুষের দুর্ভোগের কথা ফেসবুকে তুলে ধরেছেন অনেকেই।

সিলেট জেলা পুলিশের পরিদর্শক শ্যামল বণিক ফেসবুকে একটি ছবি যুক্ত করে লিখেছেন, ‘হাইওয়ে রাস্তায় দাউদাউ আগুন জ্বলতে দেখে ভয়ে সব গাড়ি থেকে নেমে যাত্রীরা যখন ছোটাছুটি করছে, তখন অসহায় অন্ধ ব্যক্তিটি তার শিশুসন্তানকে নিয়ে কান্না শুরু করেছে। তাদের অনেক কষ্টে নিরাপদে বাসস্ট্যান্ড পৌঁছিয়ে দিলাম।’

নগরের চৌহাট্টায় এমন দুর্ভোগের প্রত্যক্ষদর্শী আলমগীর কবির। তিনি বলেন, ‘রাতে চৌহাট্টা পয়েন্টে একটা মোটরসাইকেলে বাবা তার দুই শিশুকে নিয়ে যাচ্ছিলেন। এ সময় তাদের আটকে পরিবহন শ্রমিকরা লাঞ্ছিত করে। ব্যাপক অত্যাচারের শিকার হতে হয় তাদের।’

ফেসবুকেই ঘুরে বেড়াচ্ছে ফুডপান্ডার খাবার বিতরণকারী এক তরুণের আর্তনাদের ভিডিও। যাতে কান্নাজড়িত কণ্ঠে তিনি অভিযোগ করছেন, বৃহস্পতিবার রাতে নগরের খাবারের অর্ডার নিয়ে বাইকে করে আসছিলেন। শাহী ঈদগাহ এলাকায় পরিবহন শ্রমিকরা তাকে আটকে মারধর করে।

সিলেটের নাগরিক আন্দোলনের সংগঠক আব্দুল করিম কিম নিউজবাংলাকে বলেন, ‘পরিবহন শ্রমিকরা দিনের পর দিন তাণ্ডব চালাচ্ছে। মানুষকে জিম্মি করে ফেলছে। তবু আজ পর্যন্ত তাদের বিরুদ্ধে একটা মামলাও হয়নি। কোথাও তাদের তাণ্ডবে বাধা দিতেও দেখা যায়নি।’

কী বলছেন শ্রমিক নেতারা

পুলিশের কারণেই সিলেটের মানুষকে এমন দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে বলে দাবি করছেন সিলেট জেলা বাস মিনিবাস শ্রমিক ইউনিয়ন সভাপতি মইনুল ইসলাম। শুক্রবার তিনি বলেন, ‘১৩ সেপ্টেম্বরের ধর্মঘট ডাকা হয়েছিল পুলিশের ট্রাফিক বিভাগের উপকমিশনারের অন্যায় কর্মকাণ্ডের প্রতিবাদে, তার অপসারণ দাবিতে। আর বৃহস্পতিবারের দুর্ভোগের দায় মহানগর পুলিশ কমিশনারের।’

নিউজবাংলাকে তিনি বলেন, ‘মামলার খবর শুনে আমাদের নেতা-কর্মীরা পুলিশ কমিশনারের কাছে গিয়েছিলেন। তিনি তাদের আশ্বাস দেয়া তো দূরের কথা, উল্টো দুর্ব্যবহার করেছেন। আরও মামলার হুমকি দিয়েছেন। এই দুর্ব্যবহারে ক্ষুব্ধ হয়ে শ্রমিকরা অবরোধ করেছে। ক্ষোভ থেকেই আমরা মানুষকে কষ্ট দিয়েছি, নিজেরাও কষ্ট করেছি।’

মহানগর পুলিশ কমিশনার নিশারুল আরিফের অপসারণ দাবিতে করে এই শ্রমিক নেতা বলেন, ‘এই পুলিশ কমিশনার আমাদের জনগণ ও সরকারের মুখোমুখি করে দেয়ার চেষ্টা করছেন। তিনি সরকারবিরোধী।’

এ ব্যাপারে সিএনজি অটোরিকশা শ্রমিক ইউনিয়ন সভাপতি জাকারিয়া আহমদ বলেন, ‘আমাদের নামে ছিনতাইয়ের মামলা করা হয়েছে। আমরা কী ছিনতাইকারী? পুলিশ এই মামলা নেয় কী করে? এই পরিস্থিতির জন্য পুলিশই দায়ী।’

জাকারিয়া আরও বলেন, ‘লেগুনা শ্রমিক ইউনিয়ন থেকে শাহাবউদ্দিনকে বহিষ্কার করা হয়েছে। তিনি আমাদের কাছে বিচারপ্রার্থী হয়েছিলেন। সেই বিচার না করায় তিনি ক্ষুব্ধ হয়ে লোকজন নিয়ে এসে আমাদের সভা পণ্ড করেন। আমাদের নেতাকে আটকিয়ে লাঞ্ছিত করেন। আমাদের নামে মিথ্যে মামলা করেন। এসব অন্যায়ের প্রতিবাদেই আমরা বৃহস্পতিবার রাস্তায় নেমেছিলাম।’

পুলিশ এই মামলার চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেয়ার আশ্বাসে অবরোধ প্রত্যাহার করা হয়েছে বলে জানান তিনি।

পুলিশের ভাষ্য

মহানগর পুলিশের ট্রাফিক বিভাগের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে নিউজবাংলাকে বলেন, ‘সিলেটে বৈধ অটোরিকশার চেয়ে অবৈধ অটোরিকশা বেশি। অনেক বাস চালকের রেজিস্ট্রেশন নেই, গাড়ির কাগজপত্র ঠিক নেই। এসবের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে গেলেই পরিবহন শ্রমিকরা একজোট হয়ে আন্দোলনে নেমে যায়। তারা কোনো আইনের তোয়াক্কা না করে ইচ্ছেমতো গাড়ি চালানোর স্বাধীনতা চায়। জনগণের ভোগান্তি লাঘবে তাদের ব্যাপারে পুলিশকেও অনেক সময় পিছু হটতে হয়।’

পরিবহন শ্রমিকরা নিজেদের স্বার্থে ‘মানুষকে ব্ল্যাকমেইলিং’ করছে উল্লেখ করে সিলেট মহানগর পুলিশের কমিশনার নিশারুল আরিফ বলেন, ‘কিছু ঘটলেই তারা যান চলাচল বন্ধ করে দেয়। মানুষজনকে চলাচলে বাধা দেয়। এ রকম পরিস্থিতিতে আমরা দুই ধরনের পন্থা অবলম্বন করি। একটা হচ্ছে বুঝিয়ে আন্দোলনকারীদের সরানো। আরেকটা হচ্ছে শক্তি প্রয়োগ ও আইনি পদক্ষেপ।’

তিনি আরও বলেন, ‘পরিবহন শ্রমিকদের ক্ষেত্রে আমরা প্রথম পন্থাই অবলম্বন করছি। তারা বারবার জনদুর্ভোগ তৈরি করছেন, তবু পরিস্থিতি বিবেচনায় আমরা শক্তি প্রয়োগ বা আইনি পদক্ষেপ নিতে পারছি না। কারণ এখন এসএসসি পরীক্ষা চলছে, সামনে দুর্গাপুজা, এরপর সিলেটে নারী এশিয়া কাপ। এসব কারণে আমরা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে চেষ্টা করছি। ফলে আমরা অনেকটা নমনীয় আচরণ করছি।’

তার বিরুদ্ধে শ্রমিকদের অভিযোগ প্রসঙ্গে পুলিশ কমিশনার বলেন, ‘তাদের বিরুদ্ধে মামলা তো পুলিশ করেনি। তাদেরই একজন করেছে। পুলিশের কাজ তদন্ত করা। এটা তাদের বোঝানোর চেষ্টা করেছি। তারা বোঝেননি। তারা মামলা প্রত্যাহার চান। কিন্তু এটা তো বাদী বা আদালত ছাড়া কারও পক্ষে সম্ভব নয়।’

পুলিশ কমিশনার আরও বলেন, ‘শ্রমিকদের এসব কর্মকাণ্ডের নেপথ্যে আরও কাহিনি আছে। শ্রমিক নেতাদের বিরুদ্ধে শ্রম আদালতে মামলা চলমান আছে। সেই মামলায় তাদের বড় অঙ্কের জরিমানা হতে পারে। এটার জন্যও চাপ তৈরির কৌশল নিয়েছেন তারা।’

এ বিভাগের আরো খবর