চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় সিন্ডিকেটের ১৭ পদের আট পদই শূন্য। শিক্ষক প্রতিনিধি নির্বাচন হচ্ছে না কয়েক বছর যাবৎ। সিন্ডিকেটে থাকা এক সদস্যের মেয়াদ পেরিয়েছে ২৬ বছর আগে। এ ছাড়া সিন্ডিকেটে নেই সিনেট মনোনীত বিশিষ্ট নাগরিক ও শিক্ষাবিদ।
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের অভিযোগ, সিন্ডিকেটের পদগুলোতে নির্বাচন দিলে নিজের পছন্দসই মানুষকে সিন্ডিকেটে তারা বসাতে পারবেন কি না তা নিয়ে প্রশাসন সন্দিহান। তা করতে না পারলে নিজেদের ইচ্ছামতো সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও বাস্তবায়নে বাধা আসতে পারে। এই কারণে দীর্ঘদিন ধরে সিন্ডিকেট নির্বাচন দেয়া হচ্ছে না।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় আইন ১৯৭৩ অনুযায়ী, বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরাম সিন্ডিকেট। বিশ্ববিদ্যালয়ের যাবতীয় গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত সিন্ডিকেট সভায় অনুমোদনের মাধ্যমে কার্যকর হয়। এই সিন্ডিকেটে পদাধিকার বলে সভাপতিত্ব করেন উপাচার্য। সদস্য সচিব থাকেন বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার। উপ-উপাচার্যও পদাধিকার বলে সদস্য হিসেবে সিন্ডিকেটে থাকেন।
সিন্ডিকেটে ডিন, প্রভোস্ট, অধ্যাপক, সহযোগী অধ্যাপক, সহকারী অধ্যাপক, প্রভাষক– এই ছয়টি ক্যাটাগরিতে ছয়জন শিক্ষক প্রতিনিধি থাকেন, যারা শিক্ষকদের ভোটে নির্বাচিত হন।
বিশ্ববিদ্যালয় সিন্ডিকেটে রাষ্ট্রপতি মনোনীত তিনজন সদস্য এবং সরকার মনোনীত একজন সদস্য থাকেন। এর বাইরে সিনেট মনোনীত এক রেজিস্টার্ড গ্র্যাজুয়েট ও একজন বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ সিনেটের সদস্য হন। এ ছাড়া সিনেট মনোনীত একজন বিশিষ্ট নাগরিকও সিন্ডিকেট সদস্য হয়ে থাকেন।
অ্যাকাডেমিক কাউন্সিল থেকে মনোনীত একজন শিক্ষক সিন্ডিকেটে সদস্য হিসেবে থাকেন। সিন্ডিকেট সদস্যরা দুই বছরের জন্য মনোনীত ও নির্বাচিত হন। তবে পরবর্তী নির্বাচন না হওয়া পর্যন্ত তারা বহাল থাকেন।
বর্তমানে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় সিন্ডিকেটের ১৭টি পদের আটটি পদই শূন্য। মেয়াদ পেরিয়ে গেলেও নির্বাচন না হওয়ায় এখনও স্বপদে রয়ে গেছেন দুজন সদস্য। সম্প্রতি রাষ্ট্রপতি কর্তৃক তিনজন এবং সরকার কর্তৃক একজন সদস্যকে মনোনীত করা হয়েছে।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় আইন ৭৩ এর ২৫ (সি) ধারা অনুযায়ী, সিন্ডিকেটে সিনেট কর্তৃক মনোনীত ২ জন সিনেট প্রতিনিধি থাকবেন। এদের মধ্যে একজন হবেন রেজিস্টার্ড গ্র্যাজুয়েট প্রতিনিধি, অন্যজন বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ প্রতিনিধি। এই দুই পদে সর্বশেষ মনোনীত হন যথাক্রমে এস এম ফজলুল হক ও অধ্যাপক ড. আবদুল করিম। তাদের মেয়াদ শেষ হয় ১৯৯৬ সালের ১৭ আগস্ট।
বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ হিসেবে অধ্যাপক ড. আবদুল করিম ২০০৭ সালে মারা যাওয়ার পর থেকে এই পদটি শূন্য। অন্যদিকে এস এম ফজলুল হক ২৮ বছর ধরে সিন্ডিকেট সদস্য হিসেবে রয়ে গেছেন। কারণ অনুসন্ধানে দেখা যায়, দীর্ঘদিন ধরে চবিতে সিনেট নির্বাচন না হওয়ায় সিনেট থেকে নতুন করে কোনো প্রতিনিধি মনোনীত করা হয়নি। ফলে এত বছর ধরে তিনি সিন্ডিকেট সদস্য পদে থেকে গেছেন।
এ বিষয়ে এস এম ফজলুল হকের মন্তব্য জানতে তাকে একাধিকবার ফোন দেয়া হলেও তিনি সাড়া দেননি।
আইনের ২৫ (এফ) ধারা অনুযায়ী, সিন্ডিকেটে সিনেট কর্তৃক মনোনীত একজন বিশিষ্ট নাগরিক থাকবেন। এই পদে সর্বশেষ মনোনয়ন পান সাবেক মন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার এল কে সিদ্দিকী। তারও মেয়াদ শেষ হয় ১৯৯৬ সালের ১৭ আগস্ট। তিনি ২০১৪ সালের আগস্টে মারা গেলে তার পদটি প্রায় আট বছর ধরে শূন্য।
বিশ্ববিদ্যালয় আইনের ২৫ (বি) ধারা অনুযায়ী, সিন্ডিকেটে ৬ জন শিক্ষক প্রতিনিধি থাকবেন। শিক্ষকরা ভোটাভুটির মাধ্যমে এই ছয়টি ক্যাটাগরিতে প্রতিনিধি নির্বাচিত করবেন। এদের মধ্যে চারটি পদ অধ্যাপক, সহকারী অধ্যাপক, সহযোগী অধ্যাপক ও প্রভাষক ক্যাটাগরিতে ভোট হয়েছিল শেষ ২০১৭ সালের ৩ ডিসেম্বর। সে সময় অধ্যাপক ক্যাটাগরিতে দর্শন বিভাগের ড. মোজাফ্ফর আহমদ চৌধুরী, সহযোগী অধ্যাপক ক্যাটাগরিতে ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের ড. মুহাম্মদ সাখাওয়াত হুসাইন, সহকারী অধ্যাপক ক্যাটাগরিতে নৃবিজ্ঞান বিভাগের এস এম সাদাত আল সাজীব এবং প্রভাষক ক্যাটাগরিতে ম্যানেজমেন্ট বিভাগের সেতু রঞ্জন বিশ্বাস শিক্ষক প্রতিনিধি হিসেবে নির্বাচিত হন।
ভিন্ন ভিন্ন সময়ে অধ্যাপক ক্যাটাগরির প্রতিনিধি অবসরে যাওয়া, সহযোগী অধ্যাপক ও প্রভাষক ক্যাটাগরির প্রতিনিধি পদোন্নতি পাওয়া ও সহকারী অধ্যাপক ক্যাটাগরির প্রতিনিধি শিক্ষা ছুটিতে যাওয়ায় এই চারটি পদ শূন্য হয়। নির্বাচন না হওয়ায় এখনও এই পদগুলো শূন্যই থেকে গেছে। এ ছাড়া ডিন ও প্রভোস্ট ক্যাটাগরিতে সর্বশেষ নির্বাচন হয়েছিল ২০১২ সালে। বর্তমানে এই দুটি পদও শূন্য।
অন্যদিকে অ্যাকাডেমিক কাউন্সিল কর্তৃক মনোনীত শিক্ষক প্রতিনিধির মেয়াদও উত্তীর্ণ হয়ে গেছে। এ পদে আছেন ২০১৫ সালে নির্বাচিত অধ্যাপক ড. মহীবুল আজিজ। পরবর্তী নির্বাচন না হওয়া পর্যন্ত তিনি এ পদে থাকবেন।
ফলে দেখা যায়, শুধু উপাচার্য ও উপ-উপাচার্য, রাষ্ট্রপতি ও সরকার মনোনীত চার সদস্য, সিনেট থেকে একজন সদস্য, অ্যাকাডেমিক কাউন্সিলের একজন সদস্য ও রেজিস্ট্রারকে নিয়েই সিন্ডিকেট সভাগুলো হচ্ছে।
এ বিষয়ে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সাবেক সভাপতি ও চবি আইন অনুষদের সাবেক ডিন অধ্যাপক মো. জাকির হোসেন নিউজবাংলাকে বলেন, ‘রাষ্ট্রপতি মনোনীত পদগুলো শূন্য হবার পর দ্রুত সময়ের মধ্যেই মনোনীত হচ্ছে, তবে শিক্ষক প্রতিনিধি পদগুলোতে কয়েক বছর ধরেই নির্বাচন হচ্ছে না। একটা কারণ, আমি (প্রশাসন) যাদের চাই, তারা আমার দল থেকে নমিনেশন পাবে কি না, পেলেও নির্বাচনে পাস করে আসতে পারবে কি না, আবার যদি না পারে, তাহলে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে জবাবদিহি হতে হবে, আমি সিন্ডিকেটে যা করতে চাই বা পাস করাতে চাই সেটা বাধাগ্রস্ত হবে। অর্থাৎ বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের পছন্দের কেউ না এলে তারা পছন্দমতো সিদ্ধান্ত নিতে পারবে না, এ শঙ্কায় তারা নির্বাচন দিতে চায় না।’
তিনি বলেন, ‘সিনেটের নির্বাচন বহু বছর হয় না। সিনেট নির্বাচন হলে তদবির করে উপাচার্য হওয়ার পথ বন্ধ হয়ে যাবে। সেই কারণে সিনেট নির্বাচন কেউ দিতে চায় না। ফলে অ্যাক্ট অনুযায়ী প্যানেল করে যে উপাচার্য নির্বাচন হয়, সেটি আর হয় না। কোনো উপাচার্যই সিনেট নির্বাচন দেয় নাই প্যানেলে তাদের নাম না আসার শঙ্কায়। সিনেট নির্বাচন না হওয়াটা বিশ্ববিদ্যালয় অ্যাক্টের সরাসরি লঙ্ঘন।’
এ ছাড়াও সহযোগী ও সহকারী পদ মর্যাদার দুই শিক্ষকের সঙ্গে কথা হয়েছে এই প্রতিবেদকের। নাম প্রকাশ না করার শর্তে তারা বলেন, ‘সিনেটে নির্বাচিত শিক্ষক প্রতিনিধি না হলে সিনেট স্বয়ংসম্পূর্ণ হয় না। শিক্ষক প্রতিনিধিরা শিক্ষকদের মধ্য থেকে নির্বাচিত হন। ফলে তারা শিক্ষক ও বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বার্থ বুঝে সিদ্ধান্ত নেন। শিক্ষকদের মতামতের প্রতিফলন ঘটে এবং অনিয়মের সুযোগ থাকে না। শিক্ষক প্রতিনিধিরা শিক্ষকদের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট দাবি সেখানে উত্থাপন করতে পারেন। কিন্তু প্রশাসন এই নির্বাচন গুলো দিচ্ছে না। প্রশাসন চাইলে নির্বাচনগুলো দিতে পারে।’
এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. শিরীণ আখতারের সঙ্গে দুই দিন কথা বলার চেষ্টা করা হয়েছে। তবে তিনি ফোন ধরেননি।
সিন্ডিকেট সচিব ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার অধ্যাপক এস এম মনিরুল হাসান নিউজবাংলাকে বলেন, ‘নির্বাচনগুলো হওয়া উচিৎ, এটাও ঠিক। নির্বাচনগুলো বিভিন্ন কারণে হয়তো হচ্ছে না। নির্বাচনের জন্য উদ্যোগ গ্রহণ করা হবে। উপাচার্য, স্ট্যান্ডিং কমিটি, দল সবাইকে এ জন্য কাজ করতে হবে।’
সিনেট নির্বাচন ও প্রতিনিধি মনোনয়নের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘এটায় (সিনেট নির্বাচনে) নানা ধরনের জটিলতা আছে। ইলেকশন করতে গেলে আদালত থেকে স্টে অর্ডার করিয়ে ফেলে, অনেক দিনের আইনি জটিলতা আছে। তবে শিক্ষক প্রতিনিধি নির্বাচনে কোনো জটিলতা নেই। আর এটা শুধু একা আমাদের হাতে না, সংশ্লিষ্ট সবার ওপর নির্ভর করে।’