মশিউর রহমান রাঙ্গাকে দলীয় সব পদ থেকে অব্যাহতির ঘটনায় রংপুর জাতীয় পার্টি বিভক্ত হয়ে পড়েছে। পাল্টাপাল্টি বিক্ষোভ, ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া ও কুশপুতুল পোড়ানোসহ উত্তেজনা চলছে জাপার দুর্গে।
ডিসেম্বরে রংপুর সিটি করপোরেশনের সম্ভাব্য নির্বাচনের হিসাব-নিকাশ শুরু হয়েছে। ভোটে জাপার কী হবে তা নিয়ে সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে রাজনৈতিক অঙ্গনে চলছে আলোচনা। জাপার এই বিরোধ কাজে লাগাতে মাঠে নেমেছে স্থানীয় আওয়ামী লীগ।রংপুর সিটিতে এবার তৃতীয়বারের মতো ভোট হতে পারে ডিসেম্বরে। ২০১২ সালের প্রথম ভোট দলীয় প্রতীকে না হলেও আওয়ামী লীগের প্রবীণ নেতা প্রয়াত সরফুদ্দিন আহমেদ ঝন্টু মেয়র নির্বাচিত হন। ওই ভোটে তার প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন জাপা নেতা বর্তমান সিটি মেয়র মোস্তাফিজার রহমান মোস্তফা। দ্বিতীয়বারের ভোট দলীয় প্রতীকে হলে নৌকা প্রতীকের প্রার্থী সরফুদ্দিন আহমেদ ঝন্টু প্রায় এক লাখ ভোটে পরাজিত হন জাপা প্রার্থী মোস্তফার কাছে। এবার কোনোভাবেই সিটি মেয়র পদটি হারাতে চায় না স্থানীয় আওয়ামী লীগ।বরাবরই রংপুর সদর আসনে হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ সংসদ সদস্য হতেন। এরশাদ অন্য আসনে নির্বাচন করলে তার ভাই গোলাম মোহাম্মদ কাদের হন এই আসনের এমপি। এরশাদ ২০১৯ সালের ১৪ জুলাই প্রয়াত হওয়ার পর আসনটি শূন্য হলে তার ছেলে সাদ এরশাদ সাংসদ নির্বাচিত হন।
আওয়ামী লীগ নেতারা বলছেন, রংপুর সদর আসনের বাসিন্দাদের দুর্ভাগ্য যে, আওয়ামী লীগ সরকারে থাকলেও এই আসনে নৌকার প্রতিনিধি ছিলেন না। জাপার এমপি থাকলেও বিভাগ, বিশ্ববিদ্যালয়, সিটি করপোরেশন, মেট্রোপলিটন পুলিশ করেছে আওয়ামী লীগ সরকার। নগরীতে দৃশ্যমান যত উন্নয়ন হয়েছে তার সবই করেছে আওয়ামী লীগ।
দলীয় শৃঙ্খলাভঙ্গের অভিযোগে বুধবার দলের রংপুর মহানগর কমিটির সভাপতি ও বিরোধী দলীয় চিফ হুইপ মশিউর রহমান রাঙ্গাকে দলের সব পদ-পদবি থেকে অব্যাহতি দেন গোলাম মোহাম্মদ কাদের। এ নিয়ে বুধবার বিকেল থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত রংপুর নগরীতে রাঙ্গাপন্থি আর জি এম কাদেরপন্থিদের মধ্যে উত্তেজনা চলছিল। পক্ষে-বিপক্ষে মিছিল হয়েছে।বুধবার সন্ধ্যায় জি এম কাদেরের কুশপুতুলে আগুন দেন রাঙ্গাপন্থিরা। পরে জাতীয় পার্টির নেতাকর্মীরা রাঙ্গার কুশপুতুলে অগ্নিসংযোগ করেন কাদেরপন্থিরা। সেখানে বিক্ষোভ ও দলীয় কার্যালয়ে অবস্থান নেয়ায় নেতৃত্ব দেন রংপুর সিটি মেয়র মোস্তফা।
এদিন রাত সাড়ে ১০টার দিকে রংপুর নগরীর গুপ্তপাড়া থেকে মোটর মালিক সমিতির নেতা ও জেলা জাতীয় পার্টির সহসভাপতি আব্দুল মান্নানের নেতৃত্বে বিক্ষোভ মিছিল বের হয়। এতে মোটর মালিক ও শ্রমিকরা ছাড়াও জাতীয় পার্টির রাঙ্গাপন্থিদের একাংশ যোগ দেয়।
আব্দুল মান্নান বলেন, ‘মশিউর রহমান রাঙ্গাকে দলে ফিরিয়ে নিতে হবে। তার প্রতি অবিচার করা হয়েছে। তার অব্যাহতি আমরা মানছি না। এর তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানাই।’
রংপুর সিটি মেয়র ও জাপার প্রেসিডিয়াম সদস্য মোস্তাফিজার রহমান মোস্তফা বলেন, ‘পার্টির চেয়ারম্যানকে রংপুরে রাজনীতি করতে দেবেন না বলে রাঙ্গা গণমাধ্যমে যে বক্তব্য দিয়েছেন তা ঠিক হয়নি। একই সঙ্গে রাঙ্গার বিষয়ে পার্টির চেয়ারম্যান বহিষ্কারের যে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, তা সঠিক ও সময়োপযোগী। এই সিদ্ধান্তের সঙ্গে রংপুর মহানগর ও জেলা কমিটি থাকবে।’ জাপার এক নেতা নাম প্রকাশ না করার অনুরোধ জানিয়ে বলেন, ‘সামনে সিটি ইলেকশন। ঠিক এমন সময় বড় দুই নেতার বিরোধে আমাদের খারাপ লাগছে। আওয়ামী লীগ বহুদিন ধরে ওঁতপেতে আছে এই আসন এবং মেয়র পদটি নিতে। জাপার দুই শীর্ষ নেতার মধ্যে এমন বিরোধ থাকলে আওয়ামী লীগের পথ সুগম হবে। জাপা কোণঠাসা হয়ে পড়বে। ভোটের মাঠে আওয়ামী লীগ সুযোগ নেবে। আমি মনে করি, জাতীয় রাজনীতির স্বার্থে এই দুই নেতার এক থাকা উচিত।’
রংপুর মহানগর যুবলীগ সভাপতি সিরাজুম মুনির বাসার বলেন, ‘আসন্ন সিটি নির্বাচনে আমরা চাই দলীয় প্রার্থী। আমরা বিশ্বাস করি, আমাদের প্রার্থী বিজয়ী হবে। জাপার এটি অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব, সে বিষয়ে আমরা খেয়াল রাখছি।‘
রংপুর মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক তুষার কান্তি মণ্ডল বলেন, ‘রংপুর আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জাতীয় পার্টি কারও দুর্গ নয়। এখানকার মানুষ বুঝে গেছে, উন্নয়নে নৌকার বিকল্প নেই। আগামী নির্বাচনে নৌকার প্রার্থীর বিজয় হবে এটা নিশ্চিত। তাদের এই দ্বন্দ্ব নতুন কিছু নয়। সাধারণ মানুষ আর জাপাকে ভোট দিতে চায় না।’
মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি শাফিয়ার রহমান শফি বলেন, ‘আমি মনে করি, জাতীয় পার্টির এই দ্বন্দ্ব তাদের অভ্যন্তরীণ। রংপুর সিটির মানুষ উন্নয়ন চায়। এ কারণে নৌকার প্রার্থী প্রায়োজন। তাদের এই দ্বন্দ্ব নিয়ে আমরা ভাবি না। এবার রংপুরের মানুষ নৌকাতেই ভোট দেবে।’ জেলা জাতীয় পার্টির সাধারণ সম্পাদক ও রাঙ্গাপন্থি হিসেবে পরিচিত আব্দুর রাজ্জাক বলেন, ‘দ্বন্দ্ব নিরসন হয়ে গেছে। ভুল বোঝাবুঝি হয়েছিল। এ নিয়ে সিটি ভোটে কোনো প্রভাব পড়বে না।’ রংপুর মহানগর জাতীয় পার্টির সাধারণ সম্পাদক এস এম ইয়াসির বলেন, ‘আমাদের মেয়র অনেক উন্নয়ন করেছেন। ভোটের পাস মার্ক দেবে জনগণ। ভোটার যদি মনে করে মোস্তফা ভালো কাজ করেছেন, তবে তাকেই ভোট দেবেন।’
জাপার এই নেতা বলেন, ‘এই ঘটনার সমাধান না হলে হয়তো কিছু ওয়ার্কার কমতে পারে। আমি বিশ্বাস করি, এটা নিরসন হবে। আর ভোটের জন্য আমরা অলরেডি সেন্টার কমিটি করেছি। এটা ঠিক, বড়মাপের একজন নেতা এই মুহূর্তে নেই, সে কারণে কিছুটা সমস্যা হতে পারে। একসঙ্গে থাকলে শক্তি-সামর্থ্য দুটোই বেশি হতো।’
জাপার প্রেসিডিয়াম সদস্য ও মেয়র মোস্তাফিজার রহমান মোস্তফা বলেন, ‘ভোটার হলেন সাধারণ মানুষ। এখানে কার গ্রহণযোগ্যতা আছে কি-নেই সেটা প্রমাণ করবে ভোট। রাঙ্গা ইস্যু বিন্দুমাত্র প্রভাব পড়বে না ভোটে। আর অন্যায়ভাবে আওয়ামী লীগ বা অন্য কোনো ব্যক্তি বা দল ভোট নিতে চাইলে ১৯৩টি কেন্দ্রে আমাদের প্রহরী রয়েছে, তা পারবে না। আমাদের সে প্রস্তুতি আছে। যেকোনো পরিস্থিতিতে আমাদের নেতাকর্মীরা অতন্ত্র প্রহরী হয়ে কাজ করবে।’ জাপার দুই পক্ষের বিরোধ নিয়ে সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) রংপুর মহানগর কমিটির সভাপতি অধ্যক্ষ ফখরুল আনাম বেঞ্জু বলেন, ‘বুধবার যে দৃশ্য দেখা গেছে, রংপুরের মানুষ তাতে বিস্মিত হয়েছে। দুই শীর্ষ নেতার মধ্যে এমন বিরোধ দেখা দেয়ায় কিছুটা প্রভাব নির্বাচনে পড়বে। দুই নেতারই পক্ষে-বিপক্ষে নেতাকর্মী আছে।’