দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের কর্মপরিকল্পনা ঘোষণা করেছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। বুধবার এই ঘোষণার মধ্য দিয়ে কমিশন তাদের ভোট সম্পর্কিত ভাবনা দেশের মানুষের সামনে তুলে ধরেছে।
মূলত ভোট আয়োজনে কাজী হাবিবুল আউয়ালের নেতৃত্বাধীন কমিশনের সামনে বেশকিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে। সেসব কীভাবে কোন পথে মোকাবেলা করা হবে সে সম্পর্কে ধারণা দিতেই ভোটের প্রায় দেড় বছর আগে কমিশনের এই রোডম্যাপ ঘোষণা।
রাজধানীর আগারগাঁওয়ে নির্বাচন ভবনের অডিটরিয়ামে বুধবার ইসির নির্বাচনী কর্মপরিকল্পনার মোড়ক উন্মোচন করা হয়। রোডম্যাপে ১৪টি চ্যালেঞ্জ ও তা মোকাবেলায় ১৯ দফা কর্মপরিকল্পনার উল্লেখ করেছে সাংবিধানিক সংস্থাটি।
এ উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানে শারীরিক অসুস্থতার কারণে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়াল উপস্থিত ছিলেন না। তবে বাকি চার কমিশনারসহ ইসির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা ছিলেন।
অনুষ্ঠানে নির্বাচন কমিশনার মো. আলমগীর বলেন, ‘ভোটের কর্মপরিকল্পনায় সবার মতামত রাখার চেষ্টা করা হয়েছে। যেসব বিষয় আমাদের আওতায় রয়েছে তা রাখা হয়েছে। তবে সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক সুপারিশগুলো রাখা হয়নি।’
পরিকল্পনা ধরেই বর্তমান কমিশন এগিয়ে যাবে বলে মন্তব্য করেন নির্বাচন কমিশনার (ইসি) রাশেদা সুলতানা। তিনি বলেন, ‘সবার সহযোগিতা পেলে অংশগ্রহণমূলক ও সুন্দর নির্বাচন উপহার দিতে সক্ষম হব আমরা।’
অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ, গ্রহণযোগ্য ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন করার উদ্দেশ্যেই এই কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন করা হয়েছে বলে জানান নির্বাচন কমিশনার আহসান হাবিব। তিনি বলেন, ‘আমরা অনেক প্রশ্নের সম্মুখীন এবং আমরা অনেক আস্থাশীলতার ঘাটতির মধ্যে আছি। আমাদের কর্মকাণ্ড দিয়ে প্রমাণ দিয়েছি, আস্থা অর্জনে আমরা কিছুটা হলেও আগের চেয়ে এগিয়ে গেছি।’
এ কর্মপরিকল্পনার মাধ্যমে নিজেদের জবাবদিহিতা ও বিবেকের কাছে দায়বদ্ধতা বাড়বে বলে মনে করেন এই কমিশনার।
অংশীজন সবার সহযোগিতা দরকার বলে মনে করেন নির্বাচন কমিশনার আনিছুর রহমান। তিনি বলেন, বাস্তবভিত্তিক ও সময়ভিত্তিক এই রোডম্যাপ বাস্তবায়ন হলে কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছানো যাবে।’
ইসি যেসব চ্যালেঞ্জ দেখছে
আগামী জাতীয় নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে আয়োজনে সুনির্দিষ্ট ১৪টি চ্যালেঞ্জ দেখছে নির্বাচন কমিশন। সেগুলো হলো-
১. সরকার ও নির্বাচন কমিশনের প্রতি নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী রাজনৈতিক দলগুলোর আস্থা সৃষ্টি;
২. নির্বাচনের দায়িত্বে মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তা বিশেষ করে পুলিশ ও প্রশাসনের কর্মকর্তাদের নিরপেক্ষভাবে দায়িত্ব পালন;
৩. ব্যবহৃত ইভিএমের প্রতি দলগুলোর আস্থা সৃষ্টি;
৪. অর্থ ও পেশিশক্তির দৌরাত্ম্য নিয়ন্ত্রণ;
৫. নির্বাচনকালীন আইন-শৃঙ্খলা বজায় রাখা
৬. সব রাজনৈতিক দলের নির্বাচনী আচরণবিধি অনুসরণ
৭. নিয়মতান্ত্রিক নির্বাচনী প্রচারণার ক্ষেত্রে বিপক্ষ/প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী/সমর্থক/পুলিশ/প্রশাসন কর্তৃক কোনরকম বাধার সম্মুখীন না হওয়া;
৮. জাল ভোট/ভোটকেন্দ্র দখল/ব্যালট ছিনতাই রোধ;
৯. প্ৰাৰ্থী/এজেন্ট/ভোটারদের ভোটকেন্দ্রে অবাধ আগমন;
১০. ভোটারদের পছন্দ অনুযায়ী প্রার্থীকে ভোট প্রদানের সুযোগ সৃষ্টি;
১১. নির্বাচনী দায়িত্ব পালনকারী বিপুলসংখ্যক কর্মকর্তা/কর্মচারীকে প্রশিক্ষণ প্রদান
১২. আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর পর্যাপ্তসংখ্যক সদস্য নিয়োজিত করা;
১৩. পর্যাপ্তসংখ্যক নির্বাহী/জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট নিয়োজিত করা;
১৪. দেশি/বিদেশি নিরপেক্ষ পর্যবেক্ষক নিয়োগ করা।
চ্যালেঞ্জগুলো উত্তরণে ইসি ১৯ দফা কর্মপরিকল্পনা নির্ধারণ করেছে। সেসবের মধ্যে রয়েছে-
১. বিশিষ্ট নাগরিক ও রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে মতবিনিময় সভায় সংবিধান ও নির্বাচনী আইন অনুযায়ী যে সুপারিশগুলো অধিকাংশজন করেছেন তা বাস্তবায়ন
২. সব রাজনৈতিক দল যাতে নির্বাচনী প্রচার কারজ নির্বিঘ্নে করতে পারে সে বিষয়ে সরকারের কাছে প্রস্তাব রাখা;
৩. সরকারের কোনো সংস্থা কর্তৃক হয়রানিমূলক মামলা না করা;
৪. প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী-সমর্থক দ্বারা প্রার্থী, সমর্থক ও তাদের বাড়িঘর, ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে আক্রমণ না করা এবং এমন হলে আইন অনুযায়ী দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণ;
৫. নির্বাচনের আগে অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার করা ও বৈধ অস্ত্র জমা নেয়া;
৬. মন্ত্রিপরিষদ সচিব, জনপ্রশাসন, জননিরাপত্তা, মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা, কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সচিব, পুলিশ, র্যাব, বিজিবি, কোস্টগার্ড, আনসার ও ভিডিপির প্রধানদের সঙ্গে সভা করে তাদের অধীনস্ত কর্মকর্তা যারা নির্বাচনী দায়িত্ব পালন করবেন তাদেরকে আন্তরিকতা ও নিরপেক্ষভাবে দায়িত্ব পালনের নির্দেশ দেয়া;
৭. প্রত্যেক ভোটকক্ষে সিসিটিভি ক্যামেরা স্থাপন
৮. ভোট কেন্দ্রগুলোতে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পর্যাপ্তসংখ্যক সদস্য মোতায়েন;
৯. ইভিএমের ব্যবহার সর্বোচ্চ ১৫০ আসনে সীমাবদ্ধ রাখা এবং শুধু মেট্রোপলিটন ও জেলা সদরের আসনগুলোতে এই যন্ত্রের ব্যবহার করা;
১০. নির্বাচনের সিডিউল ঘোষণার পরদিন থেকে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটসহ আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর স্ট্রাইকিং ফোর্স নিয়োগ;
১১. নির্বাচনী আচরণবিধি কঠোরভাবে প্রয়োগ, ভঙ্গকারীর বিরুদ্ধে তদন্তপূর্বক সঙ্গে সঙ্গে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ;
১২. আরপিও এবং নির্বাচনী আচরণ বিধিতে কতিপয় প্রয়োজনীয় সংশোধনের প্রস্তাব করা;
১৩. রিটার্নিং অফিসার ও সহকারী রিটার্নিং অফিসার যতদূর সম্ভব নির্বাচন কমিশনের কর্মকর্তাদের মধ্য থেকে নিয়োগ দেয়া;
১৪. রিটার্নিং অফিসার, সহকারী রিটার্নিং অফিসার, প্রিজাইডিং অফিসার, সহকারী প্রিজাইডিং অফিসারদের একটি তালিকা তৈরি করে তাদের প্রশিক্ষণ নির্বাচনের সিডিউল ঘোষণার আগেই শুরু করা যাতে যথাযথভাবে তাদের প্রশিক্ষণ প্রদান করা সম্ভব হয়;
১৫. যেসব প্রিজাইডিং/সহকারী প্রিজাইডিং অফিসারের বিষয়ে প্রার্থীর যুক্তিসংগত আপত্তি থাকবে তাদের নিয়োগ না দেয়া;
১৬. দেশি-বিদেশি পর্যবেক্ষক নিয়োগ ও তাদের জন্য কমিশনের পক্ষ থেকে ব্রিফ করা;
১৭. গণমাধ্যমকর্মী নিয়োগ ও তাদের জন্যও ব্রিফিং-এর ব্যবস্থা করা;
১৮. নিরপেক্ষ দায়িত্ব পালনে অনীহা, পক্ষপাতিত্বের অভিযোগ প্রমাণিত হলে তার বিরুদ্ধে নির্বাচন কর্মকর্তা (বিশেষ বিধান) আইন-১৯৯১ অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করা;
১৯. প্রার্থীদের জনসভা করার জন্য স্থান, তারিখ ও সময় সিডিউল করে দেয়া।
ইসির রোডম্যাপের সারসংক্ষেপ
আইন সংস্কার: ২০২২ সালের আগস্ট থেকে ২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারি;
সংলাপ: ২০২২ সালের মার্চ থেকে ডিসেম্বর;
সংসদীয় আসন পুনর্বিন্যাস: ২০২৩ সালের জানুয়ারি থেকে জুন।
আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার: ২০২২ সালের আগস্ট থেকে ২০২৩ সালের আগস্ট।
নতুন দল নিবন্ধন: ২০২২ সালের সেপ্টেম্বর থেকে ২০২৩ সালের জুন।
ভোটার তালিকা: হালনাগাদ শুরু ২০২২ সালের মে, চূড়ান্ত প্রকাশ ২০২৩ সালের মার্চ; তফসিল ঘোষণার সঙ্গে সংসদীয় আসন অনুযায়ী ৩০০ এলাকার তালিকা প্রস্তুত।
ভোটকেন্দ্র নির্ধারণ: ২০২৩ সালের জুন থেকে আগস্ট; তফসিল ঘোষণার পর থেকে ভোটের অন্তত ২৫ দিন আগে গেজেট প্রকাশ।
প্রশিক্ষণ: ২০২৩ সালের জানুয়ারি থেকে তফসিল ঘোষণার পরও চলবে।
পর্যবেক্ষক সংস্থা নিবন্ধন: ২০২৩ সালের জানুয়ারি থেকে আগস্ট পর্যন্ত।