ইলেক্ট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম) নিয়ে কোনো সংকট দেখছে না নির্বাচন কমিশন (ইসি)। তবে রাজনৈতিকভাবে বিষয়টির ফয়সালা হলে এই পদ্ধতি থেকে সরে আসবে কমিশন। সেক্ষেত্রে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সব আসনে ব্যালটে ভোট গ্রহণ করা হবে।
প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়াল বুধবার রাজধানীর আগারগাঁওয়ে নির্বাচন ভবনে নিজ দপ্তরে সাংবাদিকদের এসব কথা বলেন।
সিইসি বলেন, ‘ইভিএম নিয়ে কোনো সংকট দেখছি না। রাজনৈতিক অঙ্গনে যে সংকট দেখছি তা ইভিএম নিয়ে নয়, আরো মোটাদাগে। রাজনৈতিকভাবে যদি শতভাগ সমঝোতা হয় তাহলে সব ভোট ব্যালটে হতে কোনো অসুবিধা নেই।’
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আরও দেড় বছর বাকি। ওই নির্বাচনে কোন পদ্ধতি অনুসরণ করে ভোটগ্রহণ হবে সম্প্রতি তা জানিয়ে দিয়েছিল নির্বাচন কমিশন। ওই নির্বাচনে অনধিক দেড় শ’ আসনে ইভিএমে ভোটগ্রহণের সিদ্ধান্ত নিয়েছে সাংবিধানিক এই সংস্থা।
সর্বনিম্ন কত আসনে ইভিএমে ভোট হবে তা না জানালেও এক কমিশনার বলেছেন, কমপক্ষে ৭০ আসনে ভোট করার পরিকল্পনা রয়েছে তাদের।
এদিকে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ ছাড়া বিএনপি ও জাতীয় সংসদে বিরোধী দল জাতীয় পার্টিসহ অনেক দলই ইভিএমে ভোটগ্রহণের বিরোধী। তারা ব্যালটের মাধ্যমে ভোট নেয়ার পক্ষে। সবশেষ মঙ্গলবার দেশের ৩৯ বিশিষ্ট নাগরিক ইভিএম ব্যবহার থেকে বিরত থাকতে ইসিকে পরামর্শ দিয়েছে। এরপরই বুধবার কমিশনের নতুন অবস্থানের কথা জানান দিলেন সিইসি।
কাজী হাবিবুল আউয়াল বলেন, ‘রাজনৈতিক অঙ্গনে যে সংকট দেখছি তা আশা করি কেটে যাবে। আর যদি ফয়সালা হয় তাহলে সব ভোট ব্যালটে হবে। রাজনৈতিকভাবে শতভাগ সমঝোতা যদি হয় অসুবিধা নেই। তখন আমরা সিদ্ধান্ত নেব। সব দল নির্বাচনে আসছে, সেটা তো একটা ভাল উদ্যোগ।
‘আমাদের জন্য যেটা প্রয়োজন সেটা হলো নির্বাচনটা হলো কিনা। ইভিএম নাকি ব্যালটে- সেটা বিষয় নয়। নির্বাচনটা অবাধ, সুষ্ঠু ও নির্বিঘ্ন হলো কিনা সেটাই বড় কথা। কাজেই বড় ধরনের সংকট ওখানে নয়। রাজনৈতিক সংকটের যদি নিরসন হয় তাহলে নির্বাচনটা সুন্দরভাবে উঠে আসতে পারে।’
ইভিএম নিয়ে রাজনৈতিক সংকট প্রকট হবে না বলে মনে করেন সিইসি। তিনি বলেন, ‘ আরেকটি বিষয়, ভারতের তুলনা দেয়া হচ্ছে। সেটা হলো পেপার ট্রেইল যুক্ত করা। এটা যদি থাকে কে কাকে ভোট দিলো পরে দেখা যায়। তবে ভারতে যত নির্বাচন হয়েছে, ওই পেপার ট্রেইল দিয়ে কেউ এমপি পদে নির্বাচিত হয়েছেন, এমন নজির নেই।’
সিইসি বলেন, ‘ইভিএম নিয়ে যে কথাগুলো বলাবলি হচ্ছে তা বহুজনের পক্ষ থেকেই বলা হয়েছে। জাফর ইকবাল বলেছিলেন এটা খুব জটিল মেশিন নয়। ওই হিসেবে বলছেন যে এটা দুর্বল যন্ত্র।
‘যন্ত্র দুর্বল কি সবল এটা আমার বিবেচনার বিষয় নয়। সবল হওয়ারও দরকার নেই, দুর্বল হওয়ারও দরকার নেই। যন্ত্র কাজ করছে কিনা, এটাই আসল বিষয়। আমরা হাজার হাজার নির্বাচন করেছি। হাজার হাজার ইভিএম ব্যবহার করেছি বিগত বেশ কয়েক বছর ধরে। কোথাও আমাদের যন্ত্র ম্যালফাংশন করেছে, এমনটি ঘটেনি।’
তিনি বলেন, ‘ডিজিটাল জালিয়াতি সম্ভব- এমন কথা তো প্রথম দিন থেকেই বলা হচ্ছে। এটা নিরসনে আমরা প্রচুর সময় নিয়েছি। সব দলকে প্রযুক্তিবিদ নিয়ে এসে যাচাই করে দেখতে বলেছি। আমরাও তাদের কথা আমলে নিয়ে পরীক্ষা করেছি। ডিজিটাল জালিয়াতি সম্ভব- এমন বক্তব্যের সপক্ষে আমরা কোনো প্রমাণ পাইনি।
‘দলগুলোর মধ্যে ইভিএম নিয়ে আস্থা নেই। এটা জানি না কতটা আস্থা নেই। কতগুলো দল এসেছিল, আমরা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখেছি। পাঁচ-সাতটি দল সরাসরি ইভিএমের পক্ষে বলেছে, কতগুলো দল শর্তসাপেক্ষে বলেছে। দলগুলো যদি নির্দিষ্ট করে না বলতে পারে যে কিভাবে জালিয়াতি সম্ভব, কেউ যদি দেখাতে না পারে, তাহলে আমরা দৃঢ়ভাবে বলতে চাচ্ছি- ডিজিটাল জালিয়াতি সম্ভব নয়।’
ইভিএমের পক্ষে যারা বলেছেন তারাও একেবারে কম নয় দাবি করে কাজী হাবিবুল আউয়াল বলেন, ‘আমরা তাদের ভোটাভুটির জন্য ডাকিনি। মতামতের জন্য ডেকেছিলাম। আমরা সুবিধাগুলো তুলে ধরেছি। কারচুপি ও সহিংসতা নিঃসন্দেহে কমে যাবে। আমরা স্টাডি করেছি, ওখানে আমার ভোট আপনি, আপনার ভোট আমি দিতে পারব না। ওখানে জোরাজুরি, সহিংসতা অনেকখানি কমে যাবে।’
কাজী হাবিবুল জানান, ‘আমাদের দেশে যে ব্যালটে হয়েছে, গত ৫০ বছরে আদালতে মামলা করে পুনঃগণনার পর নির্বাচিত হয়ে কেউ সংসদে এসেছেন এমন তথ্য আছে কি? যদি না থাকে তাহলে এই একটা জিনিস নিয়ে আপনারা এতো উঠেপড়ে লাগলেন কেন?
‘নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে করাটাই বড় কথা। আমরা যদি ইভিএম তুলে দেই, আর যদি কারচুপি হয় তাহলে আমি নিশ্চিতভাবেই বলতে পারি কেউ পরাজিত হয়ে মামলা করে পুনর্গণনা করে জয়ী হয়ে সংসদে আসতে পারবেন না। এটা গ্রাউন্ড রিয়েলিটি। আমরা এটাকে আমলে নিয়েছি।’
প্রতিবেশী দেশ ভারতের প্রসঙ্গ টেনে সিইসি বলেন, ‘ভারত কিন্তু বায়োমেট্রিক দিতে পারেনি আমাদের ইভিএমের মতো। ইউরোপের কথা বলা হচ্ছে। সেখানে ইভিএম তুলে দেয়া হয়েছে কেন তা আমি জানি না। তবে ওদেরকে হাত তুলে ভোট দিতে বললেও ভদ্রভাবে হাত তুলে ভোট দিয়ে চলে আসবে। নির্বাচন নিয়ে ওখানে কারচুপি হয় না। ওদের ওখানে কোনো মেশিন বসাতে হয় না। কারণ ওদের ওখানে সভ্যতা ও নিয়মতান্ত্রিকতা এমন একটা পর্যায়ে এসেছে যে ইভিএম কী আর ব্যালট হলেই বা কী।’
অপর এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আর্থিক সংকটের কথা আমি অ্যাপ্রিসিয়েট করি। তবে এটা দেখার দায়িত্ব আমরা না, মন্ত্রণালয়ের। সুন্দর ও সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য আমরা বললাম যে এটা লাগবে, আর সরকার বললো পয়সা দিতে পারব না; তাহলে আমরা তো জোরাজুরি করব না দেশের মানুষকে আর্থিক সংকটে ফেলে। সুষ্ঠু নির্বাচনের যে আর্থিক মূল্য এবং অসুষ্ঠু নির্বাচনের যে আর্থিক মূল্য তা ইভিএমের মূল্যের চেয়ে অনেক অনেক বেশি।’