ফেসবুকে ‘উসকানিমূলক পোস্ট’ শেয়ার করার অভিযোগে ফের কারাগারে গেছেন সুনামগঞ্জের শাল্লার ঝুমন দাস।
এর আগে হেফাজত নেতা মামুনুল হকের সমালোচনা করে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দেয়ার পর গত বছরের মার্চে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মামলায় গ্রেপ্তার হয়েছিলেন ঝুমন। ছয় মাস কারাগারে থাকার পর গত বছরের ২৮ সেপ্টেম্বর তিনি জামিনে মুক্তি পান।
এর ১১ মাস পর আবার ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মামলার মুখে গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে গেলেন ঝুমন। এবার যে পোস্টটি শেয়ার দিয়ে ‘সাম্প্রদায়িক উসকানি দেয়ার’ অভিযোগের মুখোমুখি হয়েছেন ঝুমন দাস, সেটি নিয়ে অনুসন্ধান চালিয়েছে নিউজবাংলা।
সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়া উপজেলার সলঙ্গা থানার হাটিকুমরুল ইউনিয়নের নবরত্ন মন্দিরের গেটে ঝোলানো মসজিদের দানবাক্সের ছবি সম্প্রতি ভাইরাল হয় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। হেঁটে দেশ পরিভ্রমণে নামা এক ব্যক্তি ছবিটি তুলে ফেসবুকে শেয়ার করেন। মন্দিরের গেটে মসজিদের দানবাক্স ঝোলানোর ঘটনাটি নিয়ে প্রশ্নও তোলেন তিনি।
আরও পড়ুন: কারামুক্তির ১১ মাস পর ফের কারাগারে ঝুমন দাস
সেই ছবিটি ফেসবুকে শেয়ার করার কারণেই ঝুমন দাসকে ফের ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মামলায় গ্রেপ্তার করে পুলিশ।
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মামলায় গ্রেপ্তার হওয়ার পর ঝুমন দাস। ছবি: নিউজবাংলা
ঐতিহাসিক নিদর্শন নবরত্ন মন্দির
সিরাজগঞ্জের হাটিকুমরুল নবরত্ন মন্দির এখন প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন হিসেবে বিবেচিত। সিরাজগঞ্জ জেলা প্রশাসনের ওয়েবসাইটে মন্দিরটি সম্পর্কে বলা হয়েছে, ‘রামনাথ ভাদুড়ী মুর্শিদাবাদের নবাব মুর্শিদকুলী খাঁর আমলে (১৭০৪ থেকে ১৭২৮ খ্রিষ্টাব্দ) এই মন্দিরটি নির্মাণ করেন। হিন্দু স্থাপত্যের উজ্জ্বল নিদর্শন কারুকার্যমণ্ডিত নবরত্ন মন্দিরটি তিনতলা। এই মন্দিরে ছিল পোড়ামাটির ফলকসমৃদ্ধ ৯টি চূড়া। এ জন্য এটিকে নবরত্ন মন্দির বলা হতো।’
মন্দিরটি সম্পর্কে আরও বলা হয়, ‘দিনাজপুর জেলার কান্তজীউ মন্দিরের অনুকরণে গঠিত এই মন্দিরের আয়তন ৬৫.২৪ বাই ৬৫.২৪। বর্গাকার মন্দিরটি প্রায় ২ ফুট প্ল্যাটফরমের ওপর তৈরি। মন্দিরের মূল কক্ষটি বেশ বড়।
‘চারদিকের দেয়ালের বাইরের চারপাশে পোড়ামাটির ফলক দিয়ে সাজানো ছিল। পরে কালের বিবর্তনে প্রাকৃতিক আর মানুষের অবহেলায় সংস্কারের অভাবে সব নষ্ট হলে প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ মন্দিরটি অধিগ্রহণ এবং নতুন করে এর সংস্কার করে।’
নবরত্ন মন্দিরের গেটে মসজিদের দানবাক্স কীভাবে
নবরত্ন মন্দিরের গেটে পাশের একটি মসজিদের দানবাক্সের ছবিটি তোলা হয় গত ২৮ আগস্ট। ছবিটি ভাইরাল হওয়ার পরদিনই স্থানীয় প্রশাসনের নির্দেশে সেটি সরিয়ে ফেলা হয়।
স্থানীয়রা নিউজবাংলাকে জানান, মন্দিরের উল্টো দিকেই রয়েছে একটি মসজিদ। আগের অবকাঠামো দুর্বল হয়ে পড়ায় সেটি ভেঙে সেখানে নতুন ভবন নির্মাণ করা হচ্ছে। ওই মসজিদের জন্য অনুদান পেতে দুটি দানবাক্স ঝুলিয়েছিল মসজিদ কমিটি। এর মধ্যে একটি মসজিদের সামনে গাছে ঝোলানো, আরেকটি লাগানো হয় মন্দিরের গেটে।
বৃহস্পতিবার ঘটনাস্থলে গিয়ে মন্দিরের গেটের দানবাক্সটি রাস্তার পাশের একটি খুঁটিতে ঝোলানো দেখা যায়।
মসজিদ কমিটির সভাপতি রঞ্জু আলম অবশ্য দাবি করছেন, তারা মন্দিরের গেটে দানবাক্স ঝোলাননি; ‘অজ্ঞাতপরিচয় লোকজন’ এ কাজ করেছে।
রঞ্জু নিউজবাংলাকে বলেন, ‘মসজিদ আমাদের গ্রামের, ওইটার নির্মাণকাজ করতেছি, ভাঙা মসজিদ। নবরত্ন মন্দিরের সামনে একটা খুঁটির সঙ্গে দানবাক্স লাগানো ছিল। হয়তো কোনো গাড়ির সঙ্গে লেগে খুঁটিটা ভেঙে গেছিল, পরে কারা জানি ওই মন্দিরের লোহার গেটের সঙ্গে নিয়ে ঝুলিয়ে রাখছিল।’
ফেসবুকে ছবি ভাইরাল হওয়ার পর দানবাক্সটি সরিয়ে নেয়া হয় জানিয়ে তিনি নিউজবাংলাকে বলেন, ‘পরদিনই আমাদের লোকাল থানার স্যার বলল, রঞ্জু ওখানে কী হইছে? পরে স্যার নিজে গিয়ে দেখছে ওখানে আর নাই। কেউ রাখছিল হয়তো এক দিনের জন্য, পরে সরায়ে দোকানের সামনে নিয়ে আবার রাখছে। আমি অবশ্য সেদিন ওইখানে ছিলাম না। তাই আমিও দেখি নাই।’
তবে মসজিদ কমিটির সহকারী সেক্রেটারি রুবেল আহমেদ নিউজবাংলাকে জানান, দানবাক্সটি তাদের উদ্যোগেই প্রায় দুই মাস আগে ঝোলানো হয়।
তিনি বলেন, “কোরবানি ঈদের দুই দিন আগে আমরা এটা লাগাইছিলাম। হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজনকে নিয়েই লাগাইছি। ওরা তো এটা নিয়ে কিছু বলে নাই।
“মন্দিরের কেয়ারটেকারকে (প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের) বলার পর দুই দিন সময় নিয়ে সে জানাইছে, ‘ঠিক আছে লাগাও।’ হিন্দুদের কেউ তো বাধা দেয় নাই। এই যে আমার সঙ্গেই আছেন হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদের সলঙ্গা থানার সাধারণ সম্পাদক পল্লব কুমার দাস। তার উপস্থিতিতেই ওই বক্স লাগানো হইছে।”
রুবেলের বক্তব্যকে সমর্থন করেছেন পল্লব কুমার দাস।
তিনি নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আমরা তো ওখানে বসে ছিলাম। ওরা দানবাক্সটা লাগাইছে। কেয়ারটেয়ার বলছে লাগাইতে পারে। আমরা তো আপত্তি করি নাই। ওইভাবে কারও সঙ্গে তো আমাদের হিংসা-টিংসা নাই।’
মন্দির সংশ্লিষ্টরা বলছেন, মন্দির রক্ষণাবেক্ষণে জড়িত প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের মোহাব্বত আলী সম্মতি দেয়ার পর মসজিদ কমিটি দানবাক্সটি মন্দিরের গেটে ঝোলায়।
পূজা উদযাপন কমিটির সভাপতি শংকর রায় নিউজবাংলাকে বলেন, ‘মসজিদ কমিটির সদস্য রুবেল আহমেদ দুইটা দানবক্স লাগায়। একটা মন্দিরের বাইরের গ্রিলে, আরেকটা একটু দূরে গাছের মধ্যে। ঈদের সময় এখানে তো প্রচুর লোক হয়, তাই দান পাওয়ার জন্য ওইখানে লাগাইছে।
‘মাস দুয়েক আগে এটা লাগাইছে। ভাইরাল হওয়ার পর প্রশাসনিকভাবে আলোড়ন হইছে, কিন্তু এলাকার লোকজনের কিন্তু এটা নিয়ে কিছু নেই। এখানে কিন্তু এটা নিয়ে কোনো উত্তপ্ত পরিস্থিতি নেই।’
তিনি বলেন, ‘এটা হিন্দু সম্প্রদায়ের মন্দির হলেও নিয়ন্ত্রণ করে বগুড়া আঞ্চলিক প্রত্নতত্ত্ব অফিস। এখানে একজন কেয়ারটেকার আছে, নাম মোহাব্বত আলী। মন্দিরটার সে-ই দেখাশোনা করে।
‘তার কাছে নাকি রুবেল অনুমতি চাইছে মন্দিরের গেটে দানবাক্সটা লাগানোর। তখন মোহাব্বত আলী সময় চাইছে ওই প্রত্নতত্ত্ব অফিস থেকে অনুমতি নেয়ার জন্য। তারপর অনুমতি নিয়ে লাগানো হইছে।’
এলাকায় হিন্দু-মুসলমান মিলেমিশে থাকে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘এখানে তো আমাদের মধ্যে কোনো দ্বন্দ্ব নেই। আমরা তো মিলেমিশে থাকি। যা হোক, পরে তো এটা সরায়ে ফেলা হইছে।’
অনুমতি দেয়ার তথ্য অস্বীকার মোহাব্বতের
নবরত্ন মন্দিরের গেটে মসজিদের দানবাক্স ঝোলাতে অনুমতি বা সম্মতি দেয়ার তথ্য এখন অস্বীকার করছেন প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের নিয়োজিত কর্মী মোহাব্বত আলী।
তিনি নিউজবাংলাকে বলেন, “এই দানবাক্স তো ওই মসজিদের লোকজন আর হিন্দুরা মিলেই লাগাইছে। আমি তো জানতাম না, এসে দেখি লাগানো। পরে আমি সরাইতে বললে ওরা বলে, ‘লাগাইছি তো কী হইছে?’ ওই হিন্দু লোকজনও আসছে। ওদের এক উকিল, সে আর কয়েকজন হিন্দু এসে বলতেছে, ‘আমাদের সামনেই লাগাইছে বাক্স, তো কী হইছে, আমাদের তো কোনো সমস্যা নাই।’”
তিনি দাবি করেন, দানবাক্সটি সরিয়ে ফেলতে ‘বারবার অনুরোধ’ করেও ব্যর্থ হয়েছেন।
মোহাব্বত নিউজবাংলাকে বলেন, “এটা সরাইতে বলছি, ওরা আজকে না কালকে করে এতদিনেও সরায় নাই। পরে সেদিন সলঙ্গা থানার ওসি এসে বলছে, ‘যারা লাগাইছে তাদের ডাকো।’ পরে আমি গিয়ে ওদের ডাকাইছি। ওসি সাহেব গিয়ে সরাইছে ওইটা।
“এটা লাগানোর জন্য আমার অফিসও অনুমতি দেবে না, আমিও দিতে পারব না। আমি তো অফিসকে জানাই নাই। জানালে তো আমাকে গালি দিবে। ওইটা তো আমার সম্পত্তি না, রাষ্ট্রীয় সম্পত্তি, আমি তো অনুমতি দেয়ার কেউ না।”
বিষয়টি নিয়ে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মকর্তা নিউজবাংলাকে বলেন, ‘প্রত্নতাত্ত্বিক সাইটে এ ধরনের কিছু লাগানোর কোনো নিয়মই নেই। ওখানে মোহাব্বত আলী নামে আমাদের একজন দেখাশোনা করে। সে দিন হিসেবে কাজ করে ওখানে। সে তো যেকোনো কিছু হলে আমাদের জানায়। এটা কেন জানালো না, তা বুঝলাম না।’
সলঙ্গা থানার ওসি আব্দুল কাদের জিলানী নিউজবাংলাকে বলেন, “ফেসবুকে ছবিটি দেখামাত্র আমি মন্দিরের পাহাড়াদারকে কল দেই। সে বলল, ‘আমি দেখে জানাচ্ছি।’ এর মধ্যে আমি নিজেই সেখানে গেছি।
“গিয়ে দেখছি, ওটা ওখানে নেই। মানে ছবিতে দেখা গেছে যে মন্দিরের বাইরে গ্রিলে লাগানো, সেখানে সেটা নেই। হয়তো কেউ সরিয় ফেলছে।”
উল্লাপাড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) উজ্জল হোসেন নিউজবাংলাকে বলেন, ‘নবরত্ন মন্দিরের গ্রিলে মসজিদের দানবাক্স লাগানোর খবর পেয়ে আমি ঘটনাস্থলে গিয়েছিলাম, তবে গ্রিলে কোনো বক্স পাইনি। তার আগেই নাকি সেটা খুলে নেয়া হয়েছে।’
ঝুমনকে নিয়ে ফের উদ্বেগে পরিবার
ঝুমন দাস ফের কারাগারে যাওয়ায় আবারও উদ্বেগে পড়েছে পরিবার। ছেলেকে ফাঁসানো হয়েছে দাবি করে ঝুমনের মা নীভা রানী দাস নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আমার ছেলে নির্দোষ। হে জেল থেকে বের হওয়ার পর অনেক নম্র ভদ্রভাবেই চলাফেরা করেছে। মানুষের ইচ্ছায় ইউপি নির্বাচনও করছিল। কিন্তু হে ফেসবুকও কার লেখা পোস্ট বলে ছাড়ি দিসে যার লাগি পুলিশ নিজে মামলা দিয়া আমার ছেলেটারে ধরিয়া নিসেগি। আমি আমার ছেলের নিঃশর্ত মুক্তি চাই।’
ঝুমনের জামিনের আবেদন আগামী ২০ সেপ্টেম্বর আবারও আদালতে উঠতে পারে বলে তিনি জানান।
ঝুমনের স্ত্রী সুইটি রানী দাস নিউজবাংলাকে বলেন, ‘উনি বাড়ি ফেরার পর থেকে মানুষের সহযোগিতায় একটি ছোট দোকান খুলেছিলেন। আর ক্ষেত খামারে কাজ করে দিন কাটিয়েছেন। তিনি এমন কোনো পোস্ট করেননি যা উসকানিমূলক বা ধর্মীয় অনূভুতিতে আঘাত লাগে। আমাদের একটা সন্তান আছে। আমরা এসব থেকে মুক্তি চাই।’
ঝুমন দাসের ব্যাপারে সুনামগঞ্জ জেলা উদীচীর সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ‘দীর্ঘদিন কারাভোগের পর গণদাবির মুখে জামিনে মুক্ত হলেও ঝুমনের সুনামগঞ্জের বাইরে যাওয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা ছিল। তার চলাফেরাও নানাভাবে নিয়ন্ত্রিত ছিল। তারেপরও ফেসবুকে পোস্ট দেয়াকে কেন্দ্র করে ঝুমন দাসকে আবারও ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
‘কারণ সিরাজগঞ্জের একটি মন্দিরের গেটে মসজিদের দানবাক্স ঝোলানোর নিন্দা জানিয়েছিলেন ঝুমন। মন্দিরের গেটে মসজিদের দানবাক্স লাগানোর মতো সাম্প্রদায়িক উসকানিমূলক কাজ করায় জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নিয়ে, উল্টো এ কাজের সমালোচনা যে করলেন তাকেই গ্রেপ্তার করল পুলিশ। এটি অত্যন্ত আশ্চর্যজনক এবং নিন্দনীয় কাজ বলে মনে করছে উদীচী।’
ঝুমনের ব্যাপারে শাল্লা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আমিনুল ইসলাম নিউজবাংলাকে বলেন, ‘ঝুমনের এই স্ট্যাটাস শেয়ারের পর এলাকায় উত্তেজনা বিরাজ করলে পুলিশ মোতায়েন করা হয়। পরে তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করলে সে স্বীকার করে সে নিজ ইচ্ছায় এই কাজ করেছে। তখন এলাকায় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হামলার উত্তেজনা সৃষ্টির দায়ে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলায় তাকে আমরা গ্রেপ্তার করি।’