পাচার হয়ে যাওয়া টাকা দেশে ফেরত আনতে প্রতিবেশী দেশ ভারত পারলে আমরা কেন পারব না- এমন প্রশ্ন তুলেছে হাইকোর্ট।
বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (বিএফআইইউ) প্রধান মাসুদ বিশ্বাসকে এ প্রশ্ন করে দেশের টাকা পাচার রোধ ও পাচারকৃত টাকা ফেরত আনতে একটি গবেষণা সেল তৈরির নির্দেশ দিয়েছে আদালত।
বিচারপতি মো. নজরুল ইসলাম তালুকদার ও বিচারপতি খিজির হায়াতের হাইকোর্ট বেঞ্চ বুধবার এ নির্দেশ দেয়।
বিএফআইইউ প্রধান মাসুদ বিশ্বাসকে উদ্দেশ করে আদালত বলে, এফআইইউ টু এফআইইউ চুক্তি হওয়া উচিত। কারণ ভারত দ্বিপাক্ষিক চুক্তি করে ৭৮৪ জনের টাকা ফেরত এনেছে। ভারত পারলে আমরা কেন পারব না? কী পদক্ষেপ নিচ্ছেন তা আমাদের জানান। গবেষণা সেল তৈরি করুন।
সুইজারল্যান্ডের রাষ্ট্রদূত ১০ আগস্ট রাজধানীতে এক অনুষ্ঠানে সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে জানান, সুইস ব্যাংকে অর্থ জমাকারীদের বিষয়ে সুইস সরকারের কাছে বাংলাদেশ সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য চায়নি।
তার বক্তব্য গণমাধ্যমে প্রকাশের পর তা নজরে নিয়ে ১১ আগস্ট স্বপ্রণোদিত হয়ে সরকার ও দুর্নীতি দমন কমিশনের দুদকের ব্যাখ্যা চেয়ে আদেশ দেয় আদালত।
আদালতের আদেশের পর বাংলাদেশ ব্যাংক ও বিএফআইইউর পক্ষ থেকে প্রতিবেদন দাখিল করা হয়। কিন্তু বিএফআইইউর অর্থ পাচারসংক্রান্ত তথ্যের প্রতিবেদন যথাযথ প্রক্রিয়া অনুসরণ না করে আদালতে দাখিল করায় ৩০ আগস্ট বিএফআইইউ প্রধান মো. মাসুদ বিশ্বাসকে তলব করে হাইকোর্ট।
আদালতের নির্দেশে বুধবার বেলা ১১টায় হাজির হন মাসুদ বিশ্বাস।
আদালতে হাজির হয়ে তিনি আদালতের কাছে দুঃখ প্রকাশ করে বলেন, ‘অসাবধানতাবশত এমনটি হয়েছে। আদালতে খসড়া প্রতিবেদন উপস্থাপন করা হয়েছে। আজ যথাযথ প্রক্রিয়া অনুসরণ করে প্রতিবেদন দাখিল করেছি। এমন ভুলের যাতে পুনরাবৃত্তি না হয়, সে জন্য অঙ্গীকার করছি।’
এ সময় বেঞ্চের জ্যেষ্ঠ বিচারক বলেন, ‘আদালতে আদেশ বাস্তবায়ন প্রতিবেদন পাঠানোর ক্ষেত্রে আরও সতর্ক হওয়া উচিত। এটা সচেতনভাবে অন্যায়। এর থেকে আমাদের সবারই বেরিয়ে আসা উচিত।
এ সময় বিএফআইইউ প্রধান নিঃশর্ত ক্ষমা চাইলে আদালত তাকে সতর্ক করে বলেন, ‘ঠিক আছে, ক্ষমা করলাম। ভবিষ্যতে এমন হলে কঠোর পদক্ষেপ নেব।’
বিএফআইইউ প্রতিবেদনে বিভিন্ন দেশের এফআইইউ ও এগমন্ট গ্রুপের কাছে ৬৭ জনের বিষয়ে তথ্য চাওয়ার বিষয়টি উল্লেখ রয়েছে। এই প্রতিবেদন দেখে বিএফআইইউ প্রধানের কাছে আদালত জানতে চায়, ৬৭ জনের নাম কীভাবে নির্ধারণ করা হয়েছে।
জবাবে মাসুদ বিশ্বাস বলেন, ‘মিডিয়িা এবং অন্যান্য এজেন্সি থেকে আমরা তথ্য সংগ্রহ করেছি।’
তখন বিচারক বলেন, ‘আপনার কাছে তো নির্ভুল তথ্য নেই। অনুমানের ভিত্তিতে আদালতে তথ্য দেয়া যাবে না। আমাদের মনে হয়েছে ৬৭ জনের নাম অনুমানের ভিত্তিতে নির্ধারণ করা হয়েছে।’
মাসুদ বিশ্বাস ফের বলেন, ‘বিভিন্ন ডেটা বিশ্লেষণ করে এই নামগুলো আমরা পেয়েছি।’
অর্থ পাচারকারীদের নাম ও টাকা ফেরত পাওয়ার জন্য বিএফআইইউ কোনো দেশের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় চুক্তি বা যোগাযোগ করেছে কি না- আদালতের এ প্রশ্নের কোনো জবাব দেননি মাসুদ বিশ্বাস।
অর্থ পাচার প্রতিরোধ-সংক্রান্ত ভারতের ‘রামজিৎ মালানি বনাম ইউনিয়ন অফ ইন্ডিয়া’ মামলার রায় পড়ার পরামর্শ দিয়ে বিএফআইইউ প্রধানের উদ্দেশে আদালত বলে, ‘কেবল চিঠি দেয়াই (বিভিন্ন দেশের এফআইইউ) যথেষ্ট নয়। আইনের মধ্যে যথাযথ প্রক্রিয়া ও আন্তর্জাতিক মান অনুসরণ না করলে ৫০ বছরেও পারবেন (অর্থ পাচার ও পাচারকারীদের তথ্য) না।’
মাসুদ বিশ্বাস বিএফআইইউর কার্যক্রম তুলে ধরে বলেন, ‘২০১৭ থেকে চলতি বছরের জুন পর্যন্ত দুদক, এনবিআর এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী অন্যান্য বাহিনীর কাছে এ পর্যন্ত আমরা ৯৮৩টি ইন্টেলিজেন্স প্রতিবেদন জমা দিয়েছি।’
এসব প্রতিবেদনের ওপর ভিত্তি করে এ পর্যন্ত কতটি মামলা হয়েছে জানতে চাইলে সে প্রশ্নের উত্তর দিতে পারেননি বিএফআইইউ প্রধান।
এ সময় বিচারক বলেন, ‘খালি চিঠি চালাচালি করলে হবে না। মনিটর করতে হবে। কাজ কিছু করেন। আমাদের দেখান। যেকোনো উপায়ে অর্থ পাচার কমাতে হবে।’
এরপর ২৬ অক্টোবর পরবর্তী আদেশের জন্য দিন ঠিক রেখে এ সময়ের মধ্যে মাসুদ বিশ্বাসকে প্রতিবেদন জমার নির্দেশ দেয় হাইকোর্ট।
আদালতে রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল এ কে এম আমিন উদ্দিন মানিক। দুর্নীতি দমন কমিশনের পক্ষে ছিলেন আইনজীবী মো. খুরশীদ আলম খান।