বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

চা বাগানে চিকিৎসা মানেই ‘তিনবেলা প্যারাসিটামল’

  •    
  • ৩০ আগস্ট, ২০২২ ১৭:৪৬

বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়নের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক নৃপেন পাল বলেন, ‘মালিক যে বলে আমাদের সুবিধা দেয়, এখানে কয়টি বাগানের শ্রমিকরা চিকিৎসা পান? কয়টা বাগানে হাসপাতাল আছে? সেগুলোতেও প্যারাসিটামল ছাড়া কোন ওষুধ দেয়া হয়?’

অপর্যাপ্ত চিকিৎসা নিয়ে সামাজিক মাধ্যমে ‘তিনবেলা প্যারাসিটামল’ বলে যে ট্রলের প্রচার আছে, সেটি সত্যি সত্যি দেখা যায় চা বাগানগুলোতে।

বাগানমালিকরা শ্রমিকদের কম মজুরি দিতে বাড়তি যে সুযোগ-সুবিধা দেয়ার কথা বলেন, তার একটি হলো বিনা মূল্যের চিকিৎসা। তবে শ্রমিকরা বলছেন, সেখানে নামমাত্র সুবিধা পাওয়া যায়। যদিও মালিকদের দাবি, তারা সবই দেন।

চা শ্রমিকরা ১২০ টাকা থেকে বাড়িয়ে মজুরি ৩০০ টাকা করার দাবিতে টানা ১৯ দিন কর্মবিরতি করার পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মজুরি ১৭০ টাকা করার পর শ্রমিকরা সেই সিদ্ধান্ত মেনে নিয়ে কাজে ফিরেছেন।

সরকারপ্রধান দৈনিক মজুরি ৫০ টাকা বাড়ানোর পাশাপাশি অন্যান্য সুযোগ-সুবিধাও আনুপাতিক হারে বাড়ানোর নির্দেশ দিয়েছেন।

যখন তারা ১২০ টাকা মজুরি পেত, তখন মালিকপক্ষ দাবি করে আসছিল, রেশন, আবাসন, চিকিৎসা, শিক্ষাসহ নানা খাতে খরচ মিলিয়ে ৪০১ টাকা ব্যয় করা হয় একেকজন শ্রমিকের পেছনে।

এখন দাবি করা হচ্ছে মজুরি ৫০ টাকা বাড়ায় শ্রমিকের পেছনে ব্যয় বেড়ে হবে ৪৫০ থেকে ৫০০ টাকা।

আইন অনুযায়ী এসব সুবিধা কখনও মজুরির অংশ হতে পারে না। আবার নিউজবাংলা খোঁজ নিয়ে দেখেছে, আবাসন বলতে যে ঘর দেয়া হয়, তাতে মাসে ২৩০০ টাকা মজুরি দেখানো হলেও তাতে নেই আবাসনের পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধা। এসব ঘরের ভাড়া সাত থেকে আট শ টাকার বেশি হওয়ার সুযোগ নেই।

রেশন বলতে যে সুবিধার কথা বলা হয়, তাও পর্যাপ্ত নয়। কেবল চাল বা আটা দেয়া হয়। কোনো কোনো বাগানে টানা পাঁচ বছর আটা দেয়ার খবর পাওয়া গেছে।

আবার যাদের ধানের জমি ইজারা দেয়া হয়, তাদের রেশন দেয়া হয় না। অনিয়মিত শ্রমিকরাও এই রেশন পান না।

পোষ্যদের শিক্ষায় যে বরাদ্দ দেয়া হয়, তা বাগানমালিকদের হিসাবেই দিনে দেড় টাকা, অর্থাৎ মাসে ৪৫ টাকা। এবার জানা গেল, চিকিৎসায় একজনের পেছনে দিনে ব্যয় দেখানে হয় সাড়ে ৭ টাকা।

শ্রমিকদের সঙ্গে মালিকদের চুক্তি অনুযায়ী প্রতিটি বাগানে একটি করে হাসপাতাল থাকবে। সেখানে একজন এমবিবিএস চিকিৎসক থাকবেন।

তবে প্রকৃত চিত্র কী, সেটি হবিগঞ্জের লস্করপুর চা বাগানের শ্রমিক রীতু তন্তুবাইয়ের কথাতেই উঠে আসে। নিউজবাংলাকে তিনি বলেন, ‘আমরা সারা দিন বাগানে পাতা তুলি। বিভিন্ন ধরনের পোকা-মাকড়ের আক্রমণের শিকার হই। কিন্তু হাসপাতালে কোনো চিকিৎসা পাই না। একটু অসুস্থ হলে উপজেলায় গিয়ে ফার্মেসি থেকে ওষুধ আনতে হয়। বেশি অসুস্থ হলে উপজেলা হাসপাতাল যেতে হয়।’

স্নাতক পাস করে চা শ্রমিকের সন্তান কাজল হাজরা বাগানের নারী শ্রমিকদের স্বাস্থ্য সচেতনা নিয়ে কাজ করেন। তিনি জানান, সংগতি না থাকায় বাগানের শ্রমিকরা এখনও কবিরাজের ওপরই নির্ভরশীল।

তিনি বলেন, ‘বাগানের লোকজনের অসুখ হলে এখনও কবিরাজের কাছে যায়। ঝাড়ফুঁকে বিশ্বাস করে তারা। কারণ, কম পয়সায় এসব সেবা পাওয়া যায়।’

বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়নের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক নৃপেন পাল বলেন, ‘মালিক যে বলে আমাদের সুবিধা দেয়, এখানে কয়টি বাগানের শ্রমিকরা চিকিৎসা পান? কয়টা বাগানে হাসপাতাল আছে? সেগুলোতেও প্যারাসিটামল ছাড়া কোন ওষুধ দেয়া হয়?’

তিনি বলেন, ‘প্রতিটা নারী শ্রমিক স্বাস্থ্যঝুঁকিতে রয়েছেন। বয়ঃসন্ধিকাল ও গর্ভকালে নানা ধরনের সমস্যায় ভোগেন কিশোরী ও নারীরা। তারা চিকিৎসা পান না। এমনকি দেশে এত এত এনজিও আছে, তারাও চা বাগানগুলোতে আসে না।’

হাসপাতাল নেই সরকারি বাগানেই

সরকারি প্রতিষ্ঠান ন্যাশনাল টি কোম্পানির নিয়ন্ত্রণাধীন সিলেটের লাক্কাতুরা ও দলদলি চা বাগান। কিন্তু এই দুই বাগানেই নেই কোনো চিকিৎসক।

এ নিয়ে আক্ষেপ করে চা শ্রমিক নেতা রিতেশ মোদী বলেন, ‘প্রত্যেক বাগানে শ্রমিকদের জন্য রেজিস্টার্ড চিকিৎসক আইন করেছে সরকার। অথচ সরকারি বাগানগুলোতেই চিকিৎসক নেই। সরকারই যদি তাদের আইন না মানে তাহলে বেসরকারিগুলো মানবে কী করে?’

সিলেটের তারাপুর চা বাগানেও নেই কোনো চিকিৎসক। একজন কম্পাউন্ডার দিয়ে এখানে শ্রমিকদের সর্বরোগের সেবা দেয়া হয়।

দেবোত্তর সম্পত্তি তারাপুর বাগান জেলা প্রশাসক গঠিত একটি ব্যবস্থাপনা কমিটির মাধ্যমে পরিচালিত হয়। বাগানে চিকিৎসক না থাকা প্রসঙ্গে এই কমিটির সদস্যসচিব ও সিলেট সিটি কাউন্সিলর শান্তনু দত্ত সন্তু বলেন, ‘আমাদেরটি একেবারে ছোট বাগান। তাছাড়া এমনিতেই লোকসান গুনতে হচ্ছে। ফলে সার্বক্ষণিক ডাক্তার রাখা আমাদের জন্য কঠিন।

‘তাছাড়া আমাদের বাগানটি শহরের মধ্যেই অবস্থিত। কাছাকাছি কয়েকটি হাসপাতাল আছে। বড় কোনো অসুখ হলে আমরা শ্রমিকদের সেখানেই পাঠাই এবং খরচ দেয়ার চেষ্টা করি।’

‘কেবল প্যারাসিটামলে কি সব অসুখ সারে?’

লাক্কাতুড়া বাগানেরই শ্রমিক পদ্মা গোয়ালা বলেন, ‘বাগানে একটি মেডিক্যাল সেন্টার আছে। সেখানে যেকোনো অসুখ নিয়ে গেলেই কেবল প্যারাসিটামল দেয়া হয়। আর কোনো ওষুধ মেলে না। কেবল প্যারাসিটামলে কি সব অসুখ সারে?’

তিনি আরও বলেন, ‘হাসপাতালে গেলে সারা দিন বসিয়ে রাখে। সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত বসে থাকার পর একটামাত্র ওষুধ দেয়। এতে অসুখও কমে না। ওইদিন কাজেও যেতে পারি না।’

বাগানে পাতা তোলার কাজ করায় নানা ধরনের পোকামাকড় আর জীবাণুর আক্রমণ মোকাবিলা করে চলতে হয় চা শ্রমিকদের। তীব্র রোদে পুড়ে আর বৃষ্টিতে ভিজে কাজ করা তাদের নিয়মিত ব্যাপার। এসব কারণে চা শ্রমিকদের প্রায় সবাই চর্ম রোগে ভোগেন। পিঠ, কোমর আর পায়ে ব্যথা রোগীর সংখ্যাও অনেক। অথচ বাগানের হাসপাতালগুলোতে মেলে না এসব রোগের চিকিৎসা।

হবিগঞ্জের বেগমখান চা বাগানে ছোট একটি ঘরে চিকিৎসা দেয়া হয় রোগীদের। সেখানে নেই কোনো চিকিৎসক। এক চিকিৎসকের সহকারী সেখানে বসে থাকেন। তাই রোগী আসে না।

পূজা সাঁওতাল নামে এক শ্রমিক বলেন, ‘এখানে আসলেও প্যারাসিটামল ছাড়া কিছু পাওয়া যায় না। তাই এখানে কেউ চিকিৎসা নিতে আসে না। জ্বরটর হইলে এখান থেকে ওষুধ নেয়া হয়। বড় কিছু হলে আমরা চান্দপুর চা বাগান থেকেই ওষুধ নেই।’

চা শ্রমিকদের শিক্ষা ও চিকিৎসা নিয়ে কাজ করা বেসরকারি সংস্থা এথনিক কমিউনিটি ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশনের (একডো) নির্বাহী পরিচালক লক্ষ্মীকান্ত সিংহ বলেন, ‘চা বাগানে চিকিৎসাসেবা বলতে প্যারাসিটামল আর স্যালাইন। এ ছাড়া আর কোনো ওষুধ নেই। চিকিৎসা সরঞ্জাম নেই, রোগ নির্ণয়ের যন্ত্রপাতিও নেই।’

তিনি বলেন, ‘বনে জঙ্গলে কাজ করার কারণে শ্রমিকরা চর্মরোগে বেশি ভোগেন। কিন্তু তারা বাগানের চিকিৎসাকেন্দ্রে গেলে একবার মলম লাগিয়েই ফিরিয়ে দেয়া হয়। একবারের মলমে কি চর্মরোগ সারে?’

জরায়ু ক্যানসারের ছড়াছড়ি

২০১৮ সালে মৌলভীবাজারের চা বাগানগুলোর নারী শ্রমিকদের নিয়ে একটি জরিপ চালায় সেন্টার ফর ইনজুরি প্রিভেনশন ও রিচার্স বাংলাদেশ (সিআইপিআরবি) নামের একটি প্রতিষ্ঠান। এতে দেখা যায়, চা বাগানের প্রায় ১৫ শতাংশ নারী রয়েছেন জরায়ু ক্যানসার ঝুঁকিতে।

জাতিসংঘ জনসংখ্যা তহবিলের অর্থায়নে ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সহযোগিতায় ‘সার্ভে টু ক্যানসার’ প্রকল্পের আওতায় চা বাগানগুলোতে এই জরিপ চালানো হয়।

অল্প বয়সে বিয়ে, অধিক ও অপরিচ্ছন্ন পরিবেশে সন্তান জন্মদান, অনিরাপদ যৌন মিলনসহ বিভিন্ন কারণে নারী শ্রমিকরা জরায়ু ক্যানসারে আক্রান্ত হচ্ছেন বলে জানায় জরিপকারী প্রতিষ্ঠানটি। অসেচতনতা ও দারিদ্র্যের কারণে শুরুতেই চিকিৎসা না পাওয়ায় এই ঝুঁকি আরও বাড়ছে বলে মনে করেন তারা।

সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ক্যানসার বিশেষজ্ঞ সরদার বনিউল আলম বলেন, ‘আমাদের হাসপাতালেও অনেক চা শ্রমিক নারী জরায়ু ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসা নেন। চা শ্রমিক নারীরাই এই রোগে বেশি আক্রান্ত হচ্ছেন। অল্প বয়সে বিয়ে, বেশি সন্তান নেয়া, অপরিষ্কার-অপরিচ্ছন্নতা ও অনিরপাদ যৌন মিলনের কারণে জরায়ুমুখে ক্যানসারের সূত্রপাত হয়।’

তিনি বলেন, ‘শুরুতেই চিকিৎসা পেলে তাদের বেশির ভাগের সমস্যাই ক্যানসার পর্যন্ত গড়াত না। তবে বাগানে তেমন চিকিৎসা পান না এবং নারী স্বাস্থ্য ও প্রজনন স্বাস্থ্য নিয়ে সচেতনতাও তাদের নেই। ফলে অনেকের জীবনই ঝুঁকিতে পড়ে।’

ডাক্তারের কাছে যানই না তারা

সিলেটের দলদলি বাগানের শ্রমিক ছিলেন রমনী ভূমিজ। বয়সের কারণে এখন কাজে যেতে পারেন না। আছেন অবসরে। ভুগছেন বয়সজনিত নানা অসুখে। ডাক্তার দেখাতে পারেন না।

তিনি বলেন, ‘নিয়মিত শ্রমিকরাই বাগানের চিকিৎসা সেবা পান না। আর আমি কোথা থেকে পাব? আমারে তো ডাক্তার দেখবেই না।’

চা বাগানের চিকিৎসা আসলে কতটা পাওয়া যায়, তার উদাহরণ হতে পারেন নমিতা লোহাও। সিলেটের সরকারি লাক্কাতুরা বাগানে কাজ করেন তিনি।

নমিতা সাত মাসের অন্তঃসত্ত্বা। কিন্তু এখন পর্যন্ত তিনি কোনো চিকিৎসকের শরণাপন্ন হননি।

কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘বাগানে তো এসবের কোনো চিকিৎসা হয় না। কেবল জ্বর, মাথাব্যথার চিকিৎসা মেলে। বাইরে ডাক্তার দেখানোর মতো টাকাও নেই। তাই ডাক্তার দেখাতে পারিনি।’

এর আগেও দুটি সন্তান হয়েছে নমিতার। দুবারই প্রসব হয়েছে ঘরে। তাও প্রশিক্ষিত ধাত্রীর সহায়তা ছাড়াই।

ভালো ছবিও আছে, তবে খুবই কম

চাঁন্দপুর বাগানে বেশ বড় একটি ভবন রয়েছে হাসপাতাল হিসেবে ব্যবহারের জন্য। ভেতরে রয়েছে অনেকগুলো শয্যাও। রোগ পরীক্ষার জন্য আছে নানা যন্ত্রপাতিও।

একজন চিকিৎসকসহ ৮ সদস্যের একটি মেডিক্যাল টিম রয়েছে হাসপাতালটির। এখানে প্রসূতি সেবাসহ বিভিন্ন রোগের চিকিৎসা ও ওষুধ বিনা মূল্যে দেয়া হয়।

এই হাসপাতাল ছাড়াও আমু, সুরমা ও তেলিয়াপাড়া বাগানেও প্রাথমিক চিকিৎসার ব্যবস্থা কিছুটা ভালো। তবে পরিস্থিতি সামগ্রিক চিত্রের তুলনায় একে ব্যতিক্রমই বলা যায়।

বাংলাদেশ চা শ্রমিক নারী সংগঠনের সভাপতি খায়রুন আক্তার বলেন, ‘হবিগঞ্জের অধিকাংশ হাসপাতালেই চিকিৎসার অবস্থা নাজুক। প্যারাসিটামল দিয়েই সব রোগের চিকিৎসা হয় হাসপাতালগুলোতে। শুধু আমাদের বাগানের হাসপাতালেই ভালো চিকিৎসা পাওয়া যায়।’

এ বিভাগের আরো খবর