চা শ্রমিকদের ধর্মঘট প্রত্যাহার হলেও এ কদিনেই দোকানে বাকির জালে জড়িয়েছেন মালতী। ঘরে তার খাবার নেই। হাতে কোনো টাকাও নেই। দোকান থেকে বাকি এনেই চলেছেন চার-পাঁচ দিন।
ধর্মঘটের দিনগুলোতে দোকানদারের কটু কথা রোজই শুনেছেন মালতী। তবু নিজের সিদ্ধান্তে অনড় ছিলেন তিনি। মজুরি না বাড়লে কাজে যাবেন না। চালিয়ে যাবেন ধর্মঘট। সিলেটের দলদলি চা বাগানের শ্রমিক তিনি।
মালতী দাস বলেন, ‘কাজ করেও তো বাঁচতে পারছি না। যে টাকা মজুরি পাই তা দিয়ে তো আর সংসার চলে না। কোনোমতে আধমরা হয়ে আছি। তার চেয়ে না খেয়েই থাকব। তবু মজুরি না বাড়লে কাজে যাব না।’
একই কথা বাগানের আরেক শ্রমিক বাবলি দাসেরও। বৃদ্ধা বাবলি দাস বলেন, ‘কী করে যে চললাম রে বাবা আমি জানি। রাতে কী খাব কিছুই জানি না। ঘরে কিচ্ছু নাই।’
তিনি বলেন, ‘ধুঁকে ধুঁকে মরার চেয়ে একবারে মরাই ভালো।’
বাবলি দাসের মেয়ে শিরিনা দাস সিলেট পলিটেকনিক্যাল ইনস্টিটিউট থেকে এ বছর ডিপ্লোমা করেছেন। নিজেদের কষ্টের জীবনের কথা বলতে গিয়ে শিরিনা বলেন, ‘আমার বাবাও এই বাগানের শ্রমিক ছিলেন। তিন বছর আগে তিনি মারা গেছেন। বাবা মারা যাওয়ার পর আর কোনোদিন আমাদের ঘরে মাংস রান্না হয়নি। মাংস কিনে আনার সামর্থ্য মায়ের নেই।’
শিরিনা আরও বলেন, ‘ভাত আলু ভর্তা আর ডাল খেয়েই আমরা দিনের পর দিন কাটাই। মাঝে মাঝে বাগান থেকে মা লতা ও কচুশাক কুড়িয়ে আনেন। মাছও খুব কম খাওয়া হয়।’
দৈনিক ৩০০ টাকা মজুরির দাবিতে ধর্মঘট পালন করছিলেন দেশের ১৬৬ চা বাগানের দেড় লক্ষাধিক শ্রমিক। ১৩ আগস্ট থেকে টানা ধর্মঘটের কারণে অচল হয়ে পড়ে চা বাগানগুলো। এতে চা উৎপাদন বন্ধ হওয়ার পাশপাশি সংকটে পড়েন শ্রমিকরাও। কাজ বন্ধ থাকায় তারা কোনো মজুরিও পাননি। আবার বেশির ভাগেরই নেই জমানো টাকা। ফলে শ্রমিকদের ঘরে ঘরে দেখা দিয়েছে খাদ্যসংকট।
দলদলি চা বাগানের ভেতরেই মুদি দোকান রাজু দাসের। দোকান প্রায় ফাঁকা। মালপত্র তেমন নেই।
রাজু বলেন, ‘বাকি দিতে দিতে আমার দোকান খালি হয়ে গেছে। টাকা না ওঠায় নতুন করে পণ্য তুলতেও পারছি না।’
রাজু জানান, শ্রমিকরা কাজ বন্ধ রাখায় এই কয়েক দিন তারা মজুরিও পাননি। তাই বাধ্য হয়েই বাকি দিতে হয়েছে। তিনি জানেন সবার হাত খালি। তাই বাকির জন্য তাগাদাও দিতে পারেননি।
সিলেটের খাদিম চা বাগানে ছাপড়ার মতো একটি ঘরে থাকেন পরেশ মুন্ডা। ঘরে কক্ষ মাত্র দুটি। একটি শোবার। অন্যটি রান্নাবান্নার। এই ঘরেই স্ত্রী আর দুই সন্তান নিয়ে থাকেন তিনি।
পরেশ বলেন, ‘চার পুরুষ ধরে এই বাগানে আছি। কিন্তু এখানকার কোনো ভূমির মালিকানা আমাদের নেই। উদ্বাস্তুর মতো থাকি। ঘর মেরামতেরও টাকা নেই। ১২০ টাকা মজুরিতে খেয়ে-পরেই বাঁচতে পারি না। ঘর বানাবো কী দিয়ে?’
পরেশ জানান, তার সন্তানরা স্কুলে যায়। কিন্তু টিফিনের জন্য তাদের হাতে কোনোদিন একটি টাকাও দিতে পারেননি। পূজা ছাড়া কখনও নতুন কাপড় কেনা হয় না তাদের। ছেঁড়া কাপড় সেলাই করে করে চলতে হয়।
একই বাগানের শ্রমিক সুবল ছত্রী বলেন, ‘বাজারে যাই সবার পরে। যাতে সবাই কেনার পর যা উচ্ছিষ্ট থাকে তা কম দামে কিনে আনতে পারি। পচা ছোট মাছ কিনি। ঘরের লোকেরা মনে করে আমি মাছ চিনি না। কিন্তু আসল ঘটনা শুধু আমিই জানি।’
এদিকে ১২০ টাকা মজুরিতেই চলতে হচ্ছে বলে শ্রমিকরা দাবি করলেও চা বাগান মালিকদের দাবি ভিন্ন। তাদের সংগঠন বাংলাদেশ টি অ্যাসোসিয়েশন (বিটিএ) গত ১৬ আগস্ট এক বিবৃতিতে দাবি করে, একজন শ্রমিক এখন দৈনিক প্রায় ৪০০ টাকার সমপরিমাণ সুবিধা পান। প্রত্যক্ষ সুবিধার মধ্যে দৈনিক নগদ মজুরি ছাড়াও ওভারটাইম, বার্ষিক ছুটি ভাতা, উৎসব ছুটি ভাতা, অসুস্থজনিত ছুটি ভাতা, ভবিষ্যৎ তহবিল ভাতা, কাজে উপস্থিতি ভাতা, ভবিষ্যৎ তহবিলের ওপর প্রশাসনিক ভাতার মাধ্যমে সর্বমোট গড়ে দৈনিক মজুরির প্রায় দ্বিগুণ নগদ অর্থ দেয়া হয়।
তাদের দাবি, শ্রমিকদের সামাজিক উন্নয়ন ও নাগরিক সুবিধা নিশ্চিত করার জন্য দৈনিক ১৭৫ টাকার বিভিন্ন ধরনের সুবিধা দেওয়া হচ্ছে।
বিটিএর বিবৃতিতে বলা হয়, খাদ্য সুরক্ষা নিশ্চিত করতে ভর্তুকির মাধ্যমে ২ টাকা কেজি দরে প্রত্যেক শ্রমিককে প্রতি মাসে ৪২ দশমিক ৪৬ কেজি চাল অথবা গম রেশন দেয়া হয়। এ ছাড়া তাদের চাষাবাদের জন্য জমি, মাতৃকালীন ভাতা, ঘর নির্মাণের জন্য জমি ও টাকা, চিকিৎসা এবং সন্তানদের শিক্ষার জন্যও টাকা দেয়া হয়।
তবে মালিকপক্ষের এমন দাবির সঙ্গে দ্বিমত করে দলদলি চা বাগানের পঞ্চায়েত সভাপতি মিন্টু দাস বলেন, ‘যে ১২০ টাকা মজুরি আমাদের দেয়া হয়, সেটিও আমরা পাই না। এর মধ্যে প্রতি মাসে শ্রমিক ইউনিয়নের চাঁদা বাবদ ১৫ টাকা, অবসরকালীন ফান্ড বাবদ ২০০ টাকা এবং পূজার চাঁদা বাবদ ৩০ টাকা কেটে নেয়া হয়। বাকি যে টাকা থাকে তা দিয়েই একজন শ্রমিককে সংসার চালাতে হয়।’
তিনি দাবি করেন, বাগান কর্তৃপক্ষ সপ্তাহে একজন শ্রমিককে সাড়ে তিন কেজি করে চাল বা আটা দেয়। বাকি সবকিছুই কিনতে হয়। আর প্রাথমিক বিদ্যালয় ছাড়া শিক্ষার জন্য আর কোনো টাকা দেয়া হয় না। চিকিৎসা সুবিধা আছে কেবল নামমাত্র। বেশির ভাগ বাগানেই কোনো চিকিৎসক নেই।
শ্রমিক ইউনিয়ন সূত্রে জানা যায়, শ্রমকিদের মজুরি সর্বশেষ ২০১৯ সালের ১ জানুয়ারি ১২০ টাকায় উন্নীত করেছিল মালিকপক্ষ। প্রতি দুই বছর অন্তর মজুরি বাড়ানোর কথা থাকলেও এরপর আর বাড়ানো হয়নি।
এ অবস্থায় চলতি বছর থেকে ৩০০ টাকা মজুরি দাবি করেন শ্রমিকরা। এ নিয়ে দফায় দফায় মালিকপক্ষের সঙ্গে বৈঠক হলেও কোনো সুরাহা হয়নি। এরপর ১৩ আগস্ট থেকে দাবি আদায়ে অনির্দিষ্টকালের ধর্মঘট শুরু করেন তারা। যদিও শনিবার মাত্র ২৫ টাকা মজুরি বাড়ানোর প্রস্তাবে ধর্মঘট প্রত্যাহার করে নিয়েছেন চা শ্রমিক ইউনিয়নের নেতারা।
এর আগে চা শ্রমিক ইউনিয়নের সিলেট ভ্যালির সভাপতি রাজু গোয়ালা বলেছিলেন, ‘দাবির পরিপ্রেক্ষিতে মালিকপক্ষ প্রথমে ১৪ টাকা মজুরি বাড়ানোর প্রস্তাব দেয়। আমরা তা প্রত্যাখ্যান করে আন্দোলন শুরু করি। এরপর তারা ২০ টাকা মজুরির প্রস্তাব দেয়। কিন্তু আমরা এতে সম্মত হইনি। এই বাজারে ১৪০ টাকা দিয়ে একজন শ্রমিকের জীবন চালানো সম্ভব না।’
ধর্মঘটকালীন পরিস্থিতি নিয়ে রাজু বলেছিলেন, ‘দীর্ঘদিন ধরে ধর্মঘট পালন করায় শ্রমিকরা মজুরি পাচ্ছে না। বাগানগুলোতে হাহাকার সৃষ্টি হয়েছে। ঘরে খাবার নেই। হাতে টাকা নেই। শ্রমিকদের মুখের দিকে তাকাতে পারি না।’