নওগাঁর বদলগাছীতে বিলাসবাড়ী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আফতাব হোসেনকে দায়িত্ব বুঝিয়ে না দিয়ে বাধা প্রদান, বিদ্যালয়ের মালামাল চুরি, ঘুষ দাবিসহ নানা হেনস্তার অভিযোগ উঠেছে সহকারী শিক্ষক এ টি এম আব্দুল্লাহ ও তার ছোট ভাই দপ্তরি বুলবুল হোসেনের বিরুদ্ধে। এসব ঘটনার সুষ্ঠু সমাধান চেয়ে উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা বরাবর একটি লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন প্রধান শিক্ষক।
অভিযোগপত্রে উল্লেখ করা হয়, বিলাসবাড়ী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক এ টি এম আব্দুল্লাহ ২০১৯ সালের ২২ মার্চ পর্যন্ত ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষকের দায়িত্বে ছিলেন। কোনো বিদ্যালয়ে শূন্য পদে প্রধান শিক্ষক যোগ দিলে তাকে মালামাল, নথি, ফাইল, রেকর্ড ও তালাচাবিসহ সবকিছু বুঝিয়ে দেয়ার নিয়ম। কিন্তু এই নিয়মের ব্যত্যয় ঘটিয়েছেন এ টি এম আব্দুল্লাহ।
প্রধান শিক্ষক আফতাব হোসেন দাবি করেছেন, তিনি প্রধান শিক্ষক হিসেবে যোগদানের পরও সহকারী শিক্ষক আব্দুল্লাহ নিজের মতোই সবকিছু করছেন। শুধু তাই নয়, দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষককে নানাভাবে মানসিক অত্যাচারও করছেন। কোনোভাবেই তিনি বিদ্যালয়ের দায়িত্বভার ছাড়তে রাজি নন।
স্থানীয় অবিভাবক ও বিভিন্ন শিক্ষকের বরাতে প্রধান শিক্ষক জানান, সহকারী শিক্ষক আব্দুল্লাহর একটি সিন্ডিকেট রয়েছে। কোনো প্রধান শিক্ষক ওই বিদ্যালয়ে যোগ দিলে সিন্ডিকেটের কারণে সর্বোচ্চ ৬ মাস তিনি টিকতে পারেন। পরে বদলি হয়ে অন্যত্র চলে যান।
নতুন প্রধান শিক্ষক হিসেবে সর্বশেষ আফতাব হোসেন প্রায় পাঁচ মাস আগে স্কুলটিতে যোগ দিয়েছেন। কিন্তু এই ৫ মাসে সহকারী শিক্ষক আব্দুল্লাহর কাছ থেকে এক প্রকার যুদ্ধ করে একটি স্টক রেজিস্ট্রার, কিছু মালামাল ও নথিপত্র দায়সারাভাবে বুঝে পান। বিদ্যালয়ের গুরুত্বপূর্ণ নথিপত্র, ফাইলপত্র, রেকর্ডসহ আলমারির সব চাবি নিজের কাছে রেখে দিয়েছেন আব্দুল্লাহ।
বিদ্যালয়টি যে এলাকায় অবস্থিত সহাকারী শিক্ষক আব্দুল্লাহর বাড়িও একই এলাকায়। তার ছোট ভাই বিদ্যালয়ের দপ্তরি ও নৈশ প্রহরী। দুই ভাই মিলে প্রভাব বিস্তার করে বিদ্যালয়ের সম্পদ চুরি এবং ক্ষতিসাধনের অভিযোগও আছে। প্রধান শিক্ষকের কোনো নির্দেশের তোয়াক্কা করেন না তারা। গভীর রাত পর্যন্ত নৈশ প্রহরী বুলবুল তার বন্ধু ও পরিচিতদের নিয়ে বিদ্যালয়ের ভেতর আড্ডা দেন।
ইতোপূর্বে বন্যাদুর্গত মানুষদের জন্য বিদ্যালয়টির ছাদে সরকার আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণ করেছিল। যদিও সংস্কারের অভাবে পরে তা অকেজো হয়ে যায়। আশ্রয়কেন্দ্রটি নির্মাণের সময় ২০ মিলি, ১৫ মিলি, ১০ মিলি রড, স্টিলের ২০ ফুট পাইপ, প্লাস্টিকের ২০ ফুট পাইপসহ অন্যান্য উপকরণ ব্যবহার করা হয়। পরে আশ্রয়কেন্দ্রটি অকেজো হয়ে গেলে আগের প্রধান শিক্ষক ও বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটির সদস্যরা এসব মালামালের হিসাব সংরক্ষণ করে স্টোর করে রাখে।
এদিকে করোনা মহামারিতে স্কুল বন্ধ থাকার কারণে সহকারী শিক্ষক আব্দুল্লাহ ও দপ্তরি বুলবুল স্টোরে রাখা মালগুলো রাতের আঁধারে বিক্রি করে দেন।
আরও অভিযোগ আছে, বিদ্যালয়টির ২০১৯ সালের আগের রেকর্ড, নথি ও ফাইলপত্র অফিস কক্ষের আলমারি থেকে চুরি করে নিজ বাড়িতে নিয়ে রেখেছেন আব্দুল্লাহ। প্রধান শিক্ষককে ফাঁসানো ও হেনস্তা করতেই তার এমন কাজ।
এ ছাড়া বিদ্যালয়ের জমির দলিল গোপন করে ও অন্যের কাছে টাকার বিনিময়ে জমি বন্ধক রেখেছেন বলেও অভিযোগ আব্দুল্লাহর বিরুদ্ধে। বর্তমানে কোনো কাগজপত্র না থাকায় বিদ্যালয়ের জমি বেদখল হয়ে যাওয়ারও ঝুঁকি তৈরি হয়েছে। কোনো প্রকার খারিজ করা যাচ্ছে না। শ্রেণিকক্ষের ৩২টি বেঞ্চ চুরি হয়েছে। পানির মটর, সিলিং ফ্যান, ইলেকট্রিক সুইচ, বাল্ব, তালাচাবি নষ্ট করা হয়েছে হয়রানি ও টাকা খরচ করানোর জন্য।
বিভিন্ন ইস্যু তৈরি করে এলাকার বখাটে ছেলেদের দিয়ে পাঠদানে বাধা সৃষ্টি করে প্রধান শিক্ষকসহ অন্য শিক্ষকদের মানসিক নির্যাতন ও হেনস্তা করা হচ্ছে। বর্তমানে উন্নয়নমূলক কাজের সব অর্থ যৌথ হিসাব নম্বরে (ব্যাংক অ্যাকাউন্টে) জমা আছে। টাকা উত্তোলনের অভাবে কাজ করা যাচ্ছে না। বিদ্যালয়ের সভাপতি ও সহসভাপতি চেকে স্বাক্ষরের জন্য ২০ হাজার টাকা ঘুষ দাবি করেছেন।
এমন পরিস্থিতিতে গত ১৭ জুলাই উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তার কাছে অভিযোগ জানালেও কোনো সুরাহা হয়নি।
বর্তমান প্রধান শিক্ষক আফতাব হোসেন বলেন, ‘দীর্ঘ ২০ বছর ধরে সহকারী শিক্ষক এ টি এম আব্দুল্লাহ এই স্কুলে কর্মরত। এখানে কোনো প্রধান শিক্ষককে তিনি টিকতে দেন না। এর আগেও বেশ কয়েকজন প্রধান শিক্ষক তার অত্যাচারে অন্যত্র বদলি হয়ে চলে গেছেন। কোনো প্রধান শিক্ষক না থাকলে সিনিয়র হিসেবে ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব নিয়ে বিদ্যালয়ের সম্পদ লুটপাট করাই তার উদ্দেশ্য।’
এ অবস্থায় সহকারী শিক্ষক আব্দুল্লাহর অনিয়ম ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে তদন্তের দাবি জানিয়েছেন আফতাব হোসেন।
এদিকে অভিযোগের বিষয়ে বিদ্যালয়ের দপ্তরি বুলবুল হোসেন বলেন, ‘আমার বিরুদ্ধে সব অভিযোগই মিথ্যা ও বানোয়াট। আমি বিদ্যালয়ের কোনো মালামাল চুরি করিনি। আমার ওপর অর্পিত দায়িত্ব সঠিকভাবে পালনের চেষ্টা করি।’
অভিযুক্ত সহকারী শিক্ষক এ টি এম আব্দুল্লাহ বলেন, ‘প্রধান শিক্ষকই নানাভাবে আমাদের হেনস্তা করছেন। প্রধান শিক্ষক হওয়ায় যা মন চায় তাই করছেন। আমাদের না জানিয়েই স্কুলের সব কাজে তিনি নিজেই সিদ্ধান্ত দেন। এসবের প্রতিবাদ করি বলেই আমাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছেন।’
বিদ্যালয়ের ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতি শাম্মী আকতার অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, ‘প্রধান শিক্ষকের কাছ থেকে চেকে সই করার জন্য আমি ও সহসভাপতি আসলাম হোসেন ঘুষ দাবি করেছি এটা সঠিক নয়। তিনিই (প্রধান শিক্ষক) স্কুলের নানা কাজে নিজেই একক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। তদন্ত হলে সব বেরিয়ে আসবে।’
এ বিষয়ে বদলগাছী উপজেলা সহকারী শিক্ষা কর্মকর্তা আব্দুর রউফ বলেন, ‘বিলাসবাড়ী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের বিষয়ে অভিযোগ পেয়েছি। আমরা তদন্ত করছি। স্কুলের পরিবেশ যেন বজায় থাকে সে ব্যাপারে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেয়া হবে।’