বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থা আজ এক গভীর ও বহুমাত্রিক সংকটের মুখে দাঁড়িয়ে। একদিকে শিক্ষার গুণগত মান, দক্ষতা ও প্রাসঙ্গিকতা নিয়ে দীর্ঘদিনের বিতর্ক; অন্যদিকে শিক্ষক সমাজের আর্থিক নিরাপত্তা, সামাজিক মর্যাদা ও পেশাগত স্বাধীনতা ক্রমেই হুমকির মুখে পড়ছে। এমন এক সময়, যখন জাতির ভবিষ্যৎ নিয়ে প্রশ্ন উঠছে, তখন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান ও ভবিষ্যতের রাষ্ট্রনায়ক তারেক রহমান ২০২৫ সালের ৭ অক্টোবর শিক্ষক সমাবেশে যে ঐতিহাসিক বক্তব্য রেখেছেন, তা কেবল একটি রাজনৈতিক অঙ্গীকার নয়—বরং এটি বাংলাদেশের শিক্ষা, শিক্ষক সমাজ ও মানবিক রাষ্ট্র গঠনের এক দূরদৃষ্টিসম্পন্ন দার্শনিক নকশা।শিক্ষাকে রাষ্ট্র নির্মাণের প্রাণশক্তি হিসেবে দেখার আহ্বানতারেক রহমান তার বক্তব্যে শিক্ষা ব্যবস্থার মূল প্রশ্নটি সামনে এনেছেন—‘আমরা সবাই মিলে যদি শিক্ষক-শিক্ষার্থী এবং বিদ্যমান শিক্ষার গুণগত মান নিশ্চিত করতে না পারি, তবে ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে আন্তর্জাতিক মানের প্রতিযোগিতায় টিকিয়ে রাখা সম্ভব নয়।’এই এক বাক্যেই তিনি শিক্ষা ব্যবস্থার সারবস্তু তুলে ধরেছেন। তার কাছে শিক্ষা কোনো কাগুজে রুটিন নয়, বরং দক্ষ নাগরিক, জাতির মানসিক, নৈতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক অস্তিত্বের মেরুদণ্ড। তিনি স্পষ্ট করেছেন, শিক্ষাব্যবস্থার উন্নয়ন কেবল অবকাঠামোগত নয়; এটি এক দক্ষ, মানবিক, বুদ্ধিবৃত্তিক ও নৈতিক পুনর্জাগরণ।
তার চিন্তায় শিক্ষা হচ্ছে জাতীয় পরিচয়ের পুনর্নির্মাণের ভিত্তি। সেই শিক্ষা হবে এমন—যা একদিকে জ্ঞান ও প্রযুক্তিতে দক্ষতা অর্জনের সুযোগ দেবে, অন্যদিকে নাগরিকদের মধ্যে দায়িত্ববোধ, সততা, নৈতিকতা ও মানবিকতা বিকশিত করবে।পুঁথিনির্ভরতা থেকে মুক্তি: দক্ষতা ও ব্যবহারিক জ্ঞানের বিপ্লবতারেক রহমানের শিক্ষাদর্শনের একটি মৌলিক ভিত্তি হলো—পুঁথিনির্ভর শিক্ষা থেকে ব্যবহারিক ও কর্মমুখী শিক্ষায় রূপান্তর। তিনি দৃঢ় কণ্ঠে বলেন, ‘দেশের শিক্ষাব্যবস্থাকে পুঁথিনির্ভর না রেখে শিক্ষা কারিকুলামকে স্কুল পর্যায় থেকেই ব্যবহারিক ও কারিগরি নির্ভর শিক্ষাব্যবস্থায় রূপান্তর করার বিকল্প নেই।’এই বক্তব্য কেবল একটি শিক্ষানীতির প্রস্তাব নয়—এটি এক অর্থনৈতিক বাস্তবতা ও সামাজিক মুক্তির রূপরেখা। তিনি উপলব্ধি করেছেন যে, আজকের বিশ্বে শুধুমাত্র বইয়ের জ্ঞান যথেষ্ট নয়; দরকার বাস্তব দক্ষতা, উদ্ভাবন ও প্রযুক্তিগত জ্ঞান। তার এই চিন্তা এবং তার সার্থক বাস্তবায়ন চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের যুগে বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে আন্তর্জাতিক মানে প্রতিযোগিতার সক্ষমতা দেবে।
শিক্ষক: সমাজের নৈতিক বাতিঘর ও জাতির আত্মাতারেক রহমান শিক্ষক সমাজকে কেবল পেশাজীবী হিসেবে নয়, বরং জাতির নৈতিক দিকনির্দেশক হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। তার কথায়—‘পারিবারিক গণ্ডি পার হওয়ার পর পরই প্রতিটি শিক্ষার্থীর দেখা হয় একজন শিক্ষকের সাথে। প্রতিটি শিক্ষার্থীর সামনে শিক্ষকই হচ্ছেন আদর্শ রোল মডেল। প্রতিটি শিক্ষককে শিক্ষার্থীর প্রয়োজন ও প্রিয়জন হয়ে উঠতে হবে।’এই উক্তি শিক্ষকের সামাজিক ভূমিকার সর্বোচ্চ মূল্যায়ন। তিনি স্বীকার করেন যে, শিক্ষক কেবল পাঠদানকারী নন; তিনি জাতির চিন্তা, মনন ও চরিত্র গঠনের স্থপতি।তবে বাস্তবতার নিরিখে তিনি সততার সঙ্গে উচ্চারণ করেন-‘শিক্ষকরাই যদি সংসার ও সম্মান নিয়ে প্রতিনিয়ত টানাপড়েনে থাকেন, তবে তাদের পক্ষে শিক্ষার্থীদের সামনে রোল মডেল হয়ে ওঠা সম্ভব নয়।’এটি কোনো রাজনৈতিক বক্তৃতা নয়, বরং রাষ্ট্রের দায়িত্ববোধের এক নৈতিক উচ্চারণ—যেখানে তিনি শিক্ষকদের মর্যাদা ও আর্থিক নিরাপত্তাকে জাতীয় পুনর্জাগরণের অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে দেখেছেন।
আর্থিক নিরাপত্তা ও সামাজিক মর্যাদার রাষ্ট্রীয় নিশ্চয়তাতারেক রহমান বিশ্বাস করেন, শিক্ষক সমাজকে আর্থিকভাবে সুরক্ষিত ও সামাজিকভাবে মর্যাদাবান না করলে শিক্ষাক্ষেত্রে স্থায়ী উন্নয়ন সম্ভব নয়। তার বক্তব্যে স্পষ্টভাবে উঠে আসে—‘শিক্ষকতা পেশা কখনোই উপায়হীন বিকল্প কিংবা একটি সাধারণ চাকরি হতে পারে না।’তিনি এমন এক রাষ্ট্র কাঠামোর রূপরেখা দিয়েছেন, যেখানে সর্বোচ্চ মেধাবী তরুণরা শিক্ষকতাকে তাদের প্রথম পেশাগত পছন্দ হিসেবে গ্রহণ করতে উৎসাহী হয়। এজন্য তিনি ঘোষণা দেন—বিএনপি ক্ষমতায় গেলে শিক্ষকদের চাকরির স্থায়িত্ব, জাতীয়করণ এবং আর্থিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে একটি উচ্চ পর্যায়ের কমিশন গঠন করা হবে।তিনি আরও বলেন, রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠান ও সামাজিক পরিসরে শিক্ষকদের মর্যাদা বৃদ্ধির জন্য প্রয়োজন হলে Warrant of Precedence পুনর্মূল্যায়ন করা হবে—যাতে শিক্ষকদের সম্মান জাতির সেরা আসনে প্রতিষ্ঠিত হয়। তার এই প্রস্তাব কেবল প্রশাসনিক পদক্ষেপ নয়, বরং রাষ্ট্রের আত্মসম্মান পুনরুদ্ধারের এক অমোঘ ঘোষণা।
শিক্ষা সংস্কার: নতুন প্রজন্মের জন্য নতুন দিগন্ততারেক রহমানের শিক্ষা দর্শনের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ হলো শিক্ষা কাঠামোর যুগোপযোগী সংস্কার। তিনি বলেন—‘প্রচলিত শিক্ষা কারিকুলামকে ব্যবহারিক ও কারিগরি শিক্ষা প্রধান করে ঢেলে সাজানোর লক্ষ্যে অগ্রাধিকারভিত্তিতে শিক্ষা সংস্কার কমিশন গঠন করা হবে।’এই পরিকল্পনার মধ্যে নিহিত আছে এক জাতীয় পুনর্গঠনের স্বপ্ন। তিনি শিক্ষা সংস্কারকে কেবল নীতিগত প্রতিশ্রুতি হিসেবে নয়, বরং রাষ্ট্রের মানবসম্পদ বিকাশের মৌলিক কৌশল হিসেবে দেখেন।এই শিক্ষা হবে এমন, যা নাগরিককে শুধুমাত্র চাকরির প্রার্থী নয়, বরং নেতৃত্বদানকারী, উদ্ভাবনমুখী ও মূল্যবোধসম্পন্ন মানুষে পরিণত করবে।
শিক্ষকরাই তৈরি করবে দক্ষ জনশক্তির আগামীর বাংলাদেশবিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান বিশ্বাস করেন এদেশের প্রতিটি মানুষকে একজন দক্ষ নাগরিকে রূপান্তর করার মাধ্যমে বাংলাদেশকে একটি শক্তিশালী অর্থনীতির রাষ্ট্রে পরিণত করা সম্ভব। সেক্ষেত্রে শিক্ষকগণ শুধুমাত্র তাত্ত্বিক জ্ঞান নয়, বরং প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার বাইরে ব্যবহারিক ও কর্মমুখী প্রশিক্ষণের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের হাতে-কলমে বিভিন্ন কাজ শিখতে উদ্ভুদ্ধ করবেন। পাশাপাশি একাধিক ভাষা শিক্ষার মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের নিজ অবস্থানকে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে উপস্থাপন করার প্রয়াসকে সার্থক করতে শিক্ষকদের সর্বোচ্চ সহযোগিতা করতে হবে। একটি দেশের সার্বিক উন্নয়ন ও অগ্রগতির জন্য দক্ষ জনশক্তির বিকল্প নেই। শিক্ষা ব্যবস্থার মূল চালিকাশক্তি হিসেবে শিক্ষকগণ এ দক্ষ জনশক্তি তৈরিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। একজন শিক্ষক কেবল পাঠদানই করেন না, বরং শিক্ষার্থীদের জ্ঞান, দক্ষতা, নৈতিকতা ও মূল্যবোধ গঠনে সহায়ক ভূমিকা পালন করেন, যা পরবর্তীতে তাদের কর্মজীবনে দক্ষ ও সৎ নাগরিক হিসেবে গড়ে তোলে। এই দক্ষ নাগরিক ও শক্তিশালী অর্থনীতির বাংলাদেশ গড়ার মূল কারিগর হবেন এদশের সকল শিক্ষকরা।
শিক্ষক মর্যাদা ও রাষ্ট্রীয় ভাবমূর্তি: এক অবিচ্ছেদ্য সম্পর্কতারেক রহমানের প্রজ্ঞাপূর্ণ পর্যবেক্ষণ—‘রাষ্ট্র ও সমাজে শিক্ষকদের মর্যাদার সঙ্গে রাষ্ট্রের মর্যাদা ও ভাবমূর্তি জড়িত।’তিনি ব্যাখ্যা করেন, যখন শিক্ষক অবমূল্যায়িত হন, তখন জাতি আত্মিকভাবে দরিদ্র হয়ে পড়ে। আর যখন শিক্ষক সমাজে সম্মানিত হন, তখন জাতির নৈতিক পুনর্জাগরণ ঘটে।এই উপলব্ধি প্রমাণ করে—তিনি শিক্ষা ও শিক্ষকতাকে কেবল উন্নয়নের উপকরণ নয়, বরং জাতীয় আত্মার প্রতিফলন হিসেবে বিবেচনা করেন।
তারেক রহমানের শিক্ষা দর্শনের দার্শনিক সারবত্তাতারেক রহমানের বক্তব্যে যে দর্শন প্রতিফলিত হয়েছে তা মূলত মানবকেন্দ্রিক রাষ্ট্রচিন্তা। তার রাষ্ট্রদর্শনে শিক্ষা কেবল অর্থনৈতিক অগ্রগতির হাতিয়ার নয়; এটি ন্যায়, মানবতা ও নৈতিকতার ভিত্তিতে রাষ্ট্র পুনর্গঠনের চালিকাশক্তি।তিনি এমন একটি বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখেন—যেখানে প্রতিটি শিক্ষক জাতির বিবেক, প্রতিটি শিক্ষার্থী সম্ভাবনার প্রতীক, এবং প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নৈতিক জাগরণের কেন্দ্র।তারেক রহমানের শিক্ষক সমাবেশে প্রদত্ত ভাষণটি বাংলাদেশের শিক্ষা আন্দোলনের ইতিহাসে এক নতুন অধ্যায় রচনা করেছে। এটি কেবল বক্তৃতা নয়, বরং এক রাজনৈতিক দার্শনিক দলিল, যেখানে শিক্ষা, শিক্ষক ও রাষ্ট্র একে অপরের পরিপূরক হয়ে দাঁড়িয়েছে।তার বার্তাটি ছিল গভীর, স্পষ্ট ও প্রজ্ঞাপূর্ণ—‘যেখানে শিক্ষক সম্মানিত, সেখানেই রাষ্ট্র মর্যাদাবান।’এই এক বাক্যে তিনি রাষ্ট্রচিন্তার মূল সূত্রটি নির্ধারণ করেছেন। তার নেতৃত্বে যদি বাংলাদেশ ভবিষ্যতে অগ্রযাত্রা শুরু করে, তবে সেই রাষ্ট্র হবে এমন এক বাংলাদেশ—‘যেখানে জ্ঞান, দক্ষতা ও মূল্যবোধে সমৃদ্ধ মানবিক রাষ্ট্রই হবে জাতির নতুন পরিচয়।’