চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় (চবি) ছাত্রলীগের পূর্ণাঙ্গ কমিটি নিয়ে উত্তপ্ত ক্যাম্পাস। অভিযোগ উঠেছে, ৩৭৬ সদস্যের বিশাল এই কমিটিতে হত্যা মামলার আসামি, চাঁদাবাজিতে অভিযুক্ত, অছাত্র, বিবাহিত, চাকরিজীবী এবং বিএনপি ও জামায়াত-সংশ্লিষ্ট অনেকে স্থান পেয়েছেন।
চবি শাখা ছাত্রলীগের একাংশের নেতাকর্মীরা এই কমিটির বিরোধিতায় ক্যাম্পাসে দুদিন ধরে অবরোধ ও বিক্ষোভ করেন।
চবি ছাত্রলীগের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় এই কমিটিতে স্থান পেয়েছেন ৩৭৬ জন। এর মধ্যে সহসভাপতি পদে আছেন ৬৯ জন। যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক পদে স্থান পেয়েছেন ১১জন।
হত্যা মামলার আসামি শীর্ষ পদে
পূর্ণাঙ্গ কমিটিতে ১ নম্বর যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক পদ পেয়েছেন রাজু মুন্সী। তিনি হিসাববিজ্ঞান বিভাগে ২০১১-১২ শিক্ষাবর্ষে ভর্তি হলেও এখনও পাস করতে পারেননি। ছাত্রত্ব না থাকলেও থাকেন আবাসিক হলে।
রাজু মুন্সী
কমিটিতে পদ পাওয়া এই নেতা ২০১৩ সালে ঘটে যাওয়া সিআরবি জোড়া খুন মামলার আসামি। এ ছাড়া চলতি বছরের ৪ এপ্রিল বিশ্ববিদ্যালয়ের নাট্যকলা বিভাগের এক শিক্ষককে মারধর ও হত্যার হুমকি দেন এই ছাত্রনেতা।
প্রদীপ চক্রবর্তী
সহসভাপতি পদ পাওয়া প্রদীপ চক্রবর্তী দুর্জয়ের নামেও আছে হত্যা মামলা। চবির আলোচিত ছাত্রলীগ কর্মী তাপস হত্যা মামলার আসামির তালিকায় তার নাম রয়েছে।
তাপস হত্যা মামলার আরেক আসামি এস এম জাহেদুল আউয়াল নতুন কমিটিতে সহসভাপতি পদ পেয়েছেন।
এস এম জাহেদুল আউয়াল
এ ছাড়া বিভিন্ন ঘটনায় মামলার আসামি হয়েছেন এমন অনেকেই কমিটিতে ওপরের সারির পদে আসীন হয়েছেন বলে নেতাকর্মীদের অভিযোগ।
রামদায় ধার দেয়া দুই কর্মী সহসভাপতি পদে
২০১৫ সালে ভর্তিচ্ছু শিক্ষার্থীদের শুভেচ্ছা জানানোকে কেন্দ্র করে শাখা ছাত্রলীগের সেই সময়ের সভাপতি আলমগীর টিপু ও সাধারণ সম্পাদক ফজলে রাব্বীর অনুসারী নেতা-কর্মীদের সৃষ্ট অস্থিরতার সময়ে দুই শিক্ষার্থী ব্যাপকভাবে আলোচনায় আসেন।
২ নভেম্বর অনুষ্ঠিত ভর্তি পরীক্ষার পরদিন একটি জাতীয় দৈনিকে একটি ছবি ছাপা হয়। সেখানে দেখা যায়, শাখা ছাত্রলীগের সেই সময়ের সভাপতি আলমগীর টিপুর দুই অনুসারী শাহজালাল হলের তৃতীয় তলার বারান্দায় রামদায় ধার দিচ্ছেন। তারা হলেন মিজানুর রহমান খান ওরফে শ্রাবণ মিজান ও মোফাজ্জল হায়দার ইবনে হোসাইন ওরফে টাইগার মোফা।
মিজানুর রহমান খান ওরফে শ্রাবণ মিজান ও মোফাজ্জল হায়দার ইবনে হোসাইন ওরফে টাইগার মোফা। (বাম থেকে)
এই ছবি প্রকাশের পরপর ক্যাম্পাসে হইচই শুরু হলে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ওই দুই কর্মীকে সাময়িক বহিষ্কার করে। এ ছাড়া ২০১৬ সালের ১৭ জুলাই ঘোষিত পূর্ণাঙ্গ কমিটিতে তাদের কোনো পদে রাখা হয়নি।
বিতর্কিত সেই দুজন এবার চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের পূর্ণাঙ্গ কমিটিতে সহ-সভাপতি পদ পেয়েছেন। এ দুজনই বর্তমানে শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ইকবাল হোসেন টিপুর অনুসারী।
আজীবন বহিষ্কৃত হয়েও যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক
দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গ ও সংগঠনবহির্ভূত কাজে জড়িত থাকার দায়ে ২০১৬ সালে ছয়জনকে ছাত্রলীগ থেকে স্থায়ীভাবে বহিষ্কার করে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ।
তার হলেন বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সে সময়ের সহসভাপতি মো. রাকিব উদ্দিন, সাংগঠনিক সম্পাদক মোহাম্মদ আরমান, যুগ্ম সম্পাদক আবু তোরাব পরশ, আপ্যায়ন সম্পাদক মিজানুর রহমান, সদস্য সাইদুল ইসলাম সাঈদ ও আরিফুল হক টিপু।
আজীবন বহিষ্কার হয়েও বর্তমান কমিটিতে যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক পদ পেয়েছেন সাঈদুল ইসলাম সাঈদ। তিনি ইকবাল হোসেন টিপুর অনুসারী হিসেবে ক্যাম্পাসে পরিচিত।
সাঈদুল ইসলাম সাঈদ
কীভাবে তার নাম কমিটিতে এলো তা জানার জন্য ইকবাল হোসেন টিপুকে ফোন দেয়া হলেও তিনি রিসিভ করেননি।
ক্যাম্পাসে অবাঞ্ছিত নেতাও আছেন কমিটিতে
বিশ্ববিদ্যালয়ের বগিভিত্তিক গ্রুপ বিজয়ের নেতা মো. ইলিয়াস পূর্ণাঙ্গ কমিটিতে যুগ্ম সাধারণ সম্পদক পদ পেয়েছেন। তিনি আগের কমিটিতে সাংগঠনিক সম্পাদক পদে ছিলেন। নিজের কর্মীদের অনেককে পদবঞ্চিত করার অভিযোগে তাকে ‘মাদক কারবারি’ আখ্যা দিয়ে ক্যাম্পাসে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করেন বিজয়ের পদবঞ্চিত নেতাকর্মীরা। তাদের দেয়া পাঁচ দফা দাবির প্রথমটিই ছিল, মো. ইলিয়াসকে কমিটি থেকে বহিষ্কার করতে হবে। তাকে দুই মাস আগে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করা হয় বলে জানান বিজয় গ্রুপের আরেক পদবঞ্চিত নেতা দেলোয়ার হোসেন।
মো. ইলিয়াস
এ বিষয়ে মো. ইলিয়াস নিউজবাংলাকে বলেন, ‘তারা যদি আমাকে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করে তাহলে আমার কাছে পদ চায় কীভাবে? তাদের দায়িত্ব কি আমি নেব? আর আমি কীভাবে পদ দেব? আমি কি সাইনিং অথরিটি, নাকি কমিটি আমি গঠন করেছি?’
ইলিয়াস আরও বলেন, ‘ক্ষোভের বশে অনেকে অনেক কিছুই বলতে পারে। ২০১০ সাল থেকে আমি রাজনীতি করছি, গ্রুপ চালাচ্ছি। আমার নামে মাদক বিষয়ে অভিযোগ থাকলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বসে আছে কেন? আমি যদি কোনো অপরাধ করে থাকি, কোনো মামলা বা অভিযোগ যদি থাকে তাহলে আমার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হোক।’
এক ভাই ছাত্রদলে, অন্য ভাই ছাত্রলীগে
পূর্ণাঙ্গ কমিটিতে সহসভাপতি পদ পাওয়া আবু বক্কর তোহা শাখা ছাত্রদলের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মো. ইয়াসিনের আপন ভাই। এর সত্যতা তোহা নিজেও স্বীকার করেছেন। তবে তার ভাইয়ের সঙ্গে পরিবারের কোনো যোগাযোগ নেই বলে তিনি দাবি করেন।
আবু বক্কর তোহা
কমিটিতে চাকরিজীবীর নাম
বর্তমান কমিটিতে কয়েকজন চাকরিজীবীও স্থান পেয়েছেন। পূর্ণাঙ্গ কমিটিতে উপনাট্য ও বিতর্ক বিষয় সম্পাদক পদ পেয়েছেন অনুপম রুদ্র। তিনি চবি ল্যাবরেটরি স্কুল অ্যান্ড কলেজে দেড় বছর ধরে শিক্ষকতা করছেন।
এ ছাড়া সহসভাপতি পদ পাওয়া এস এম জাহিদুল আউয়াল চট্টগ্রাম ভেটেরিনারি অ্যান্ড অ্যানিমেল সায়েন্স বিশ্ববিদ্যালয়ে (সিভাসু) প্রশাসনিক কর্মকর্তা হিসেবে কর্মরত।
অনুপম রুদ্র
নিজের অজান্তেই কমিটিতে পদ
নিজের অজান্তেই কমিটিতে সহসভাপতি পদ পেয়ে বসে আছেন বিজন চৌধুরী নামে একজন। ২০১৩-১৪ সেশনের এই ছাত্র দ্বিতীয় বর্ষ পর্যন্ত পড়ে আর লেখাপড়া চালিয়ে যাননি। তিনি বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সাবেক কর্মী হিসেবে নিজেকে দাবি করলেও কমিটিতে তার নাম আছে তা তিনি নিজেই জানতেন না।
বিজন চৌধুরী
বিজন বলেন, ‘আমি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বগিভিত্তিক রাজনীতির বিজয় গ্রুপের একজন কর্মী ছিলাম। তবে অপরাজনীতির শিকার হয়ে আমি ক্যাম্পাসে ছাত্রলীগের রাজনীতি অনেক আগেই ছেড়ে দেই।’
মানা হয়নি গঠনতন্ত্র ও জ্যেষ্ঠতার ক্রম
ছাত্রলীগের গঠনতন্ত্রের প্রথম ভাগের ৬ নম্বর ধারার (সাংগঠনিক কাঠামো) ‘জ’ নম্বরে বলা আছে, ‘পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়সমূহ সাংগঠনিক জেলা হিসেবে গণ্য হবে।’
একই ভাগের ধারা ১০ থেকে জানা যায়, ১৫১ সদস্যবিশিষ্ট জেলা শাখায় সহসভাপতি হতে পারবেন ২১ জন। যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক হতে পারবেন ৯ জন। সাংগঠনিক সম্পাদকও হতে পারবেন ৯ জন। কিন্তু চবি ছাত্রলীগের কমিটিতে সহসভাপতির পদ পেয়েছেন ৬৯ জন। আর যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও সাংগঠনিক সম্পাদক পেয়েছেন ১১ জন করে।
কমিটি গঠনে জ্যেষ্ঠতার ক্রম মানা হয়নি- খোদ পদ পাওয়া নেতারাই এমন অভিযোগ করেছেন। চবির ইতিহাসে সবচেয়ে বড় এই কমিটিকে তারা ‘বিশৃঙ্খল’ হিসেবে উল্লেখ করেছেন।
নতুন কমিটিতে সহসভাপতি পদ পাওয়া রকিবুল হাসান দিনার বলেন, ‘এই কমিটি নিয়ে আমরা পুরোপুরি অসন্তুষ্ট। বিশৃঙ্খল একটি কমিটি হয়েছে। সিনিয়র-জুনিয়রের কোনো ক্রম নেই। ক্যাম্পাস ও রাজনীতি ছেড়ে দেয়া অনেকেই কমিটিতে স্থান পেয়েছেন। কমিটি নিয়ে প্রত্যাশার বিন্দু পরিমাণও পূরণ হয়নি। এর দায়ভার চবি ছাত্রলীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের।’
সহসভাপতি প্রদীপ চক্রবর্তী দুর্জয় বলেন, ‘চবি ছাত্রলীগের ইতিহাসে সবচেয়ে জঘন্য কমিটি এটি। এই কমিটিতে চাকরিজীবী, বিবাহিত, রাজনীতি ছেড়ে চলে যাওয়া ও রাজনীতি না করা অনেকেই পদ পেয়েছেন। কমিটিতে সিনিয়রকে জুনিয়র পোস্ট আর জুনিয়রকে সিনিয়র পোস্ট দেয়া হয়েছে। গঠনতন্ত্র মানা হয়নি। কোনো শৃঙখলাও নেই। বিশাল হলেও এটাকে পকেট কমিটি বলা যায়।’
তিনি অভিযোগ করেন, সভাপতি ও সেক্রেটারি তাদের অনুসারীদের বেশি পদ দিয়েছেন। ফলে তার অনুসারীরা বঞ্চিত হয়েছেন।
তার বিরুদ্ধেও যে মামলা আছে তা স্বীকার করে প্রদীপ বলেন, ‘শুধু তাপস হত্যা নয়; ২০১৪ সালে আমানত হলের শিবির সেক্রেটারি মামুন হত্যা মামলায় আসামির তালিকায়ও তার নাম রয়েছে।
ভাইরাল ২ পাতা, সত্যতা নিশ্চিত করা যাচ্ছে না
এদিকে কমিটি ঘোষণার পর আরও দুই পাতা ফেসবুকে ভাইরাল হয়েছে। তাতে আরও ৫০ জনের নাম সহসভাপতি পদে আছে। তবে এই দুটি পেজের সত্যতা ও কত সদস্যের কমিটি সেটি নিশ্চিত করে বলছেন না দায়িত্বশীল কেউই।
যারা পদ দিলেন, তারাই এড়াচ্ছেন সাংবাদিকদের
কমিটি নিয়ে বিতর্ক ও অভিযোগের বিষয়ে জানতে শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ইকবাল হোসেন টিপুকে বেশ কয়েকবার ফোন দেয়া হলেও প্রতিবারই তিনি লাইন কেটে দেন।
সভাপতি রেজাউল হক রুবেলের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি প্রশ্ন শুনে লাইন কেটে দেন। ফলে তার মন্তব্যও পাওয়া যায়নি।
অন্যদিকে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদককে একাধিকবার কল দেয়া হলে তারা ফোন ধরেননি।
চবি ছাত্রলীগের কমিটি গঠনে সাংগঠনিক দায়িত্বপ্রাপ্ত কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের প্রশিক্ষণ বিষয়ক সম্পাদক হায়দার মোহাম্মদ জিতু নিউজবাংলাকে বলেন, ‘যে বিষয়গুলো সামনে আসছে সেগুলোর তথ্য-প্রমাণসহ কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের দপ্তর সেলে জমা দিলে আমরা তদন্তসাপেক্ষে ব্যবস্থা নেব।’
কারা জমা দেবেন- এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘যারা অভিযোগ করছেন, যারা অভিযোগ করতে চান তারা জমা দেবেন। প্রয়োজনে নাম গোপন রেখেও দপ্তর সেলে অভিযোগ জমা দিতে পারেন।’
অপর এক প্রশ্নের জবাবে জিতু বলেন, ‘কমিটির সদস্যসংখ্যা নিয়ে অনেক জটিলতা আছে। এই বিষয়গুলো নিয়ে আমরা আজ বা কাল বসব। এরপর সবিস্তারে বলব।’
গঠনতন্ত্র মানা হয়েছে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘কীভাবে কী হলো, বিষয়গুলো কীভাবে সুরাহা করা যায়, তা নিয়ে আমরা কথা বলছি। আমরা পরে জানাব।’