নড়াইলে লাঞ্ছনার শিকার ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ স্বপন কুমার বিশ্বাস কাল বুধবার কলেজে ফিরবেন। তাকে ফুলের মালা দিয়ে বরণ করতে প্রস্তুতি শেষ করেছে কলেজ কর্তৃপক্ষ।
নড়াইল-১ আসনের সংসদ সদস্য বিএম কবিরুল হক মুক্তি, পরিচালনা পর্ষদের সভাপতি অচিন কুমার চক্রবর্তী, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি বিশেষ প্রতিনিধি দল এবং নড়াইল জেলা আওয়ামী লীগের নেতারা তাকে কর্মস্থল মির্জাপুর ইউনাইটেড ডিগ্রি কলেজে নিয়ে যাবেন।
এ প্রসঙ্গে স্বপন কুমার বিশ্বাস নিউজবাংলাকে বলেন, ‘দেরিতে হলেও কলেজে যেতে পারছি, তার জন্য আমি আনন্দিত। নানা হুমকির কারণে পরিবার পরিজন ছেড়ে পালিয়ে আত্মগোপনে অনেক কষ্টে দিনাতিপাত করতে হয়েছে। এ সময় চোখের জলই ছিল একমাত্র সঙ্গী।
‘ভাবতেও পারিনি আমার সঙ্গে এমনটি হবে। কতিপয় ব্যক্তি ষড়যন্ত্রমূলকভাবে আমাকে ফাঁসিয়ে হীনস্বার্থ চরিতার্থ করতে চেয়েছিল। তারা মিথ্যা গুজব রটিয়ে আমাকে হেনস্তা করেছে, যা শুধু কলেজ এলাকা নয়, দেশবাসী বুঝতে পেরেছে।’
ফেসবুকে ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) বহিষ্কৃত মুখপাত্র নূপুর শর্মাকে সমর্থন করে এক হিন্দু শিক্ষার্থী ফেসবুকে পোস্ট দিয়েছেন- এমন অভিযোগ তুলে কলেজে গত ১৮ জুন পুলিশের সামনেই শিক্ষক স্বপন কুমার বিশ্বাসকে অপদস্থ করা হয়।
গুজব ছড়িয়ে দেয়া হয় ওই শিক্ষার্থীর পক্ষ নিয়েছেন স্বপন কুমার। মির্জাপুর ইউনাইটেড ডিগ্রি কলেজে এ নিয়ে দিনভর চলে উত্তেজনা।
এরপর পুলিশ পাহারায় স্বপন কুমার বিশ্বাসকে ক্যাম্পাসের বাইরে নিয়ে যাওয়ার সময় তাকে দাঁড় করিয়ে গলায় জুতার মালা পরিয়ে দেয় একদল ব্যক্তি।
শিক্ষক স্বপন কুমার হাত উঁচিয়ে ক্ষমা চাইতে থাকেন। পরে তাকে তুলে নেয়া হয় পুলিশের গাড়িতে।
মোবাইল ফোনে ধারণ করা এ ঘটনার ভিডিও ফুটেজ ছড়িয়ে পড়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। দেশজুড়ে তৈরি হয় তীব্র ক্ষোভ।
অন্য কার সঙ্গে আগামীতে যেন এ ধরনের ঘটনা না ঘটে সেই আহ্বান জানান স্বপন কুমার বিশ্বাস। বলেন, ‘আমার সঙ্গে যা করা হয়েছে, এমন ঘটনা যেন কোনো শিক্ষক বা সম্মানীয় ব্যক্তির সঙ্গে না হয়। এভাবে যেন দুষ্টুচক্র আর কাউকে অপদস্থ করতে না পারে। আমাকে শুধু জুতার মালা দেয়া হয়নি, মারধর করা হয়েছে। আমার মোটরসাইকেলসহ ৩টি বাহন পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে। এখন দীর্ঘ ৫ কিলোমিটার হেটে আমাকে নিয়মিত কলেজে যাতায়াত করতে হবে।’
নিজের আর্থিক দৈন্যতার কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, ‘এই মুহূর্তে আরেকটি মোটরসাইকেল কেনার মতো সঙ্গতি আমার নেই। যা বেতন পাই তা দিয়ে ৩ মেয়ের লেখাপড়াসহ যাবতীয় খরচ চালানো দুষ্কর। চরম বিপদের দিনে আমার মোটরসাইকেল পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে। কাছে খুব সামান্য টাকা ছিল তা দিয়ে বড় মেয়েকে অনার্সে ভর্তি করিয়েছি। আমার করুণ পরিনতির জন্য যারা দায়ী, তাদের বিচার আমি সৃষ্টিকর্তার কাছেই অর্পণ করলাম।’
অধ্যক্ষ স্বপন কুমার বিশ্বাসকে জুতার মালা পরানোর পর বন্ধ কলেজ গত ২৪ জুলাই খুলেছে। দীর্ঘ ১মাস ৫দিন পর কলেজ খোলা হয়। তবে শিক্ষক-কর্মচারীরা ওই দিন কলেজ খোলার ব্যাপারে আগে থেকে কিছুই জানতেন না।
অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট জোবায়ের হোসেন চৌধুরী কলেজে গিয়ে শিক্ষক-কর্মচারীদের ডেকে নেন। এরপর শিক্ষক-কর্মচারীদের নিয়মিত কলেজে আসতে অনুরোধ জানান।
কিছুদিন দ্বাদশ শ্রেণির শ্রেণিপাঠ কার্যক্রম চলানোর পর প্রথম বর্ষের ক্লাস চালু করা হয়। তবে অধিকাংশ শিক্ষকের চোখেমুখে আতঙ্কের ছাপ রয়েছে। মোটরসাইকেল নিয়ে আসতেও ভয় পাচ্ছেন শিক্ষকরা।
মির্জাপুর ইউনাইটেড ডিগ্রি কলেজের সভাপতি অ্যাডভোকেট অচিন কুমার চক্রবর্তী জানান, ‘গত ১৩ জুলাই বিকেলে কলেজের পরিচালনা পর্ষদের সভায় ২০ জুলাই কলেজ খোলার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল। পরে জেলা প্রশাসনের নির্দেশ সে সিদ্ধান্ত বাতিল হয়। পরে রোববার (২৪ জুলাই) কলেজ খোলা হয়েছে। নানা প্রতিবন্ধিকতার পর আমরা অধ্যক্ষকে কলেজে ফেরাতে পারছি। তিনি বুধবার কলেজে যাবেন।’
কলেজে হামলা ও শিক্ষক হেনস্তার ঘটনায় ২৭ জুন নড়াইল সদর থানায় মামলা করেন পুলিশের উপপরিদর্শক ও মির্জাপুর ফাঁড়ির ইনচার্জ শেখ মোরছালিন।
দণ্ডবিধির ৩৪, ১৪৩, ৪৪৭, ৪৪৮, ৩২৩, ৩৪১, ৩৩২, ৩৫৩, ৩৫৫, ৪৩৬, ৪২৭, ৫০০ ধারায় করা এ মামলায় অজ্ঞাতপরিচয় ১৭০ থেকে ১৮০ জনকে আসামি করা হয়। মামলায় এ পর্যন্ত ৬ জনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ।
পুলিশ সুপার প্রবীর কুমার রায় নিউজবাংলাকে বলেন, ‘এলাকায় এবং কলেজে অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে। অধ্যক্ষ স্বপন কুমার বিশ্বাসের বাড়িতেও সার্বক্ষণিক মোতায়েন আছে পুলিশ। আসামিদের গ্রেপ্তারে অভিযান অব্যহত রয়েছে। অপরাধীদের ভিডিও ফুটেজ রয়েছে। যাচাই বাছাই করেই আসামি গ্রেপ্তার করা হচ্ছে। কোনো নিরীহ কাউকে হয়রানি করা হবে না।’