সিলেটের কিনব্রিজের নিচে নিজের রিকশায় গা এলিয়ে বিশ্রাম নিচ্ছিলেন চালক আলম মিয়া। ঘামে তার পুরো শরীর ভিজে গেছে।
বৃহস্পতিবার দুপুরে আলম বলেন, ‘সকালে রিকশা নিয়ে বেরিয়েছিলাম। এখন পর্যন্ত তিনটা ট্রিপও দিতে পারিনি। এই গরমে রিকশা চালানো অসম্ভব। আকাশ থেকে যেন আগুন ঝড়ছে।’
আলমের পাশে দাঁড়িয়েই সড়কের পাশের দোকান থেকে কিনে লেবুর শরবত খাচ্ছিলেন আব্দুল কাদির।
পেশায় ভ্যানচালক কাদির বলেন, ‘কদিন ধরেই খুব গরম। আজকে তো অসহ্য অবস্থা। একটু সময় ভ্যান চালালেই দম একেবারে আটকে আসে। আর সড়কে তো পা দেয়া যাচ্ছে না। পা পুড়ে যাচ্ছে।’
টানা বৃষ্টি আর দীর্ঘ বন্যায় এমনিতেই কাহিল অবস্থা সিলেটবাসীর। এবার গরমে ওষ্ঠাগত প্রাণ। কদিন থেকেই দাবদাহ চলছে সিলেটে। তাপমাত্রা ৩৫ ডিগ্রির নিচে নামছেই না। বৃহস্পতিবার বিকেলে তা ৩৭ ডিগ্রিতে গিয়ে ঠেকেছে। সকাল থেকেই শুরু হয় তীব্র রোদ। এতে বিপাকে পড়েছেন শ্রমিক শ্রেণির মানুষ।
তাপমাত্রা ৩৭ এর পাশাপাশি যুক্ত হয়েছে আর্দ্রতা। আবহাওয়াসংক্রান্ত সাইট অ্যাকুওয়েদার অনুযায়ী সিলেটের গড় আর্দ্রতা ৫৭ শতাংশ। একই পরিমাণ আর্দ্রতা ঘরের ভেতরের। যাকে এ সাইট বলছে বিপদজনক অবস্থা। যে কারণে সিলেটের তাপমাত্রা বৃহস্পতিবার বিকেল সাড়ে ৪টার পর থার্মোমিটারে ৩৭ দেখালেও প্রকৃতপক্ষে অনুভূত হচ্ছে ৪২ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মতো উষ্ণতা।
এই সাইটের তথ্য অনুযায়ী, একই সময় ঢাকার তাপমাত্রা থার্মোমিটারে ৩৫ দেখালেও প্রকৃতপক্ষে অনুভূত হচ্ছে ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের উষ্ণতা।
শেষ আষাঢ়ে আবহাওয়ার এই অগ্নিমূর্তিকে আরও অসহনীয় করে তুলেছে লোডশেডিং। গরমের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে লোডশেডিং।
আবহাওয়া অধিদপ্তর বলছে, বঙ্গোপসাগরে নিম্নচাপের প্রভাবে গরম বেড়েছে। প্রকৃতির এই রুদ্রমূর্তি শুক্রবার পর্যন্ত অব্যাহত থাকবে। শনিবার থেকে বৃষ্টি হতে পারে।
গরমের জ্বালায় অতিষ্ঠ হয়ে নগরের মিরাবাজার এলাকার ব্যবসায়ী রিপন চৌধুরী বলেন, ‘সিলেটে মাঝামাঝি বলে কিছু নেই। বৃষ্টি তো টানা বৃষ্টি। বন্যা তো ভয়ংকর বন্যা। আবার রোদ হলেও তা অসহনীয়। শরীর পুড়িয়ে দেয়ার মতো।’
তিনি বলেন, ‘একে তো তীব্র গরম তার ওপর কিছুক্ষণ পরপর বিদ্যুৎ চলে যায়। দিনে ৬-৭ ঘণ্টা বিদ্যুৎ থাকে না। ফলে ঘরে থাকাও দায় হয়ে উঠেছে।’
অবাধে বৃক্ষ নিধন, জলাশয় ভরাট ও পাহাড় টিলা কাটার কারণে প্রকৃতি এমন অস্বাভাবিক আচরণ করছে বলে মনে করেন পরিবেশবাদী সংগঠন ভূমিসন্তান বাংলাদেশের সমন্বয়ক আশরাফুল কবির।
তিনি বলেন, ‘প্রকৃতির ওপর আমরা নির্যাতন চালিয়েছি। এখন প্রকৃতি তার প্রতিশোধ নিচ্ছে।’
আশরাফুল বলেন, ‘এখন তো তীব্র রোদে একটু বিশ্রাম নেয়ার মতো গাছপালাও সড়কের পাশে নেই। উন্নয়নের নামে সব কেটে ফেলা হয়েছে।’
গত ৭ দিন ধরেই তীব্র গরম সিলেটে। বাতাসেরও দেখা নেই। গরমে অতিষ্ঠ মানুষজন একটু বৃষ্টি ও বাতাসের অপেক্ষায় ছটফট করছেন। সূর্য ডোবার পরও তাপমাত্রা কমছে না।
আবহাওয়া অধিদপ্তর সিলেট অফিস সূত্রে জানা যায়, গত ৭ জুলাই থেকে সিলেটে তাপমাত্রা বাড়তে শুরু করে। ৭ জুলাই থেকে ৯ জুলাই প্রতিদিন সিলেটে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয় ৩৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস। ১০ জুলাই ৩৫ দশমিক ৩ ডিগ্রি, ১১ জুলাই ৩৫ দশমিক ৫ ডিগ্রি, ১২ জুলাই ৩৬ দশমিক ৪ ডিগ্রি , ১৩ জুলাই ৩৬ ডিগ্রি এবং ১৪ জুলাই বৃহস্পতিবার ৩৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়।
সিলেট নগরের সাগরদীঘির পার এলাকার বাসিন্দা সোহাগ আহমদ বলেন, ‘একদিকে রোদের তীব্রতা অন্যদিকে লোডশেডিং। ঘরে-বাইরে কোথাও একদণ্ড শান্তিতে বসার সুযোগ নেই। গরম বাড়ার সঙ্গেসঙ্গে লোডশেডিংও বেড়ে গেছে।’
তবে তীব্র রোদেরও উপকারিতা দেখছেন দক্ষিণ সুরমার বরইকান্দি এলাকার বাসিন্দা আজমল হোসেন। তিনি বলেন, ‘আমাদের সড়ক এখনো পানিতে তলিয়ে আছে। রোদের কারণে পানি দ্রুত কমছে। কিন্তু বৃষ্টি হলেই তো পানি আবার বেড়ে যাবে। ফলে আমরা আছি উভয়সংকটে।’
আবহাওয়াবিদ তরিফুল নেওয়াজ খান নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আবহাওয়ার বর্তমান পরিস্থিতি আপাতত খুব একটা পরিবর্তনের সম্ভাবনা নেই। রোববারের পর বৃষ্টিপাতের প্রবণতা ধীরে ধীরে বাড়বে।’এই আবহাওয়াবিদের দাবি, বর্ষাকাল মানে ছিটেফোঁটা হলেও বৃষ্টি হয়। কিন্তু তাতে তাপপ্রবাহে জর্জরিত মানুষের জন্য সুখবর নেই।তরিফুল নেওয়াজ খান বলেন, ‘এখন যদিও খুব সামান্য পরিমাণ বৃষ্টি হয়, এই বৃষ্টিতে কিন্তু যে তাপপ্রবাহ আছে, সেটার খুব একটা পরিবর্তন হবে না। বর্ষাকালে তাপমাত্রা নামার জন্য যে কন্টিন্যুয়াস বৃষ্টিটা দরকার, সেই বৃষ্টিটা হয়তো বা শিগগিরই হওয়ার সম্ভাবনা খুব কম।’আষাঢ়ের দিন ফুরিয়ে শ্রাবণ আসতে চলল। ভরা বর্ষা মৌসুমেও নেই বৃষ্টি। কেন এমন পরিস্থিতি তার ব্যাখ্যা পাওয়া গেলে তরিফুলের কথায়। এমন অবস্থাকে আবহাওয়াবিদরা বলে থাকেন মনসুন ট্র্যাপ বা মৌসুমি বায়ুর ফাঁদ।তিনি বলেন, ‘মৌসুমি বায়ুর যে লো প্রেসার এরিয়া ওড়িশা উপকূলের দিকে আছে। ওড়িশা উপকূলের দিকে থাকার কারণে ম্যাক্সিমাম জলীয় বাষ্পগুলো সেন্ট্রাল ইন্ডিয়ার দিকে চলে যাচ্ছে। ফলে দেখা যাচ্ছে, বৃষ্টিপাতের জন্য প্রচুর ময়েশ্চার আসতে হবে বে অফ বেঙ্গল থেকে, ফলে আমাদের এই অংশে বৃষ্টিপাত হওয়ার জন্য যে পরিমাণ ময়েশ্চার প্রয়োজন, সেই পরিমাণ ময়েশ্চারের জোগানটা আসছে বঙ্গোপসাগর থেকে।’তবে এই পরিস্থিতি আগামী কয়েক দিনের মধ্যে বদলে যাবে বলে আশা করছেন এই আবহাওয়াবিদ।তার দাবি, এটা যখন ধীরে ধীরে সেন্ট্রাল ইন্ডিয়া থেকে নর্দার্ন ইন্ডিয়ার দিকে সরে আসবে, বাংলাদেশের দিকে চলে আসবে, তখন প্রচুর ময়েশ্চার বাংলাদেশে আসবে। পরবর্তী সময়ে বৃষ্টিপাতের প্রবণতাটাও বাড়বে।
প্রকৃতির এই উত্তাপের ছাপ পড়েছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকেও। ফেসবুকে গরম নিয়ে হাপিত্যেশ করছেন এই অঞ্চলের বাসিন্দারা। অনেকেই আবার সুইমিং পুল, ঝরনা বা নদীতে গোসলের ছবি দিচ্ছেন ফেসবুকে।
দুপুরে নগরের মাছিমপুর এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, সুরমার জলে দাপাদাপি করছে একদল শিশু-কিশোর। তাদেরই একজন মাইদুল ইসলাম। সে বলে, পানিও গরম হয়ে গেছে। ডুব মেরে থাকলে কিছুটা ভালো লাগে।