'খেতা ছিঁড়ার মাজার' ময়মনসিংহের তারাকান্দা উপজেলায় বেশ পরিচিত। মাজারটির অবস্থান উপজেলার রামপুর ইউনিয়নের টিকুরী এলাকায়।
প্রতি বছর একবার ওরশ জমে এ মাজারে। ২৮ বছরের ব্যবধানে ধীরে ধীরে মাজারটি দেশের বিভিন্ন জায়গার লোকদের মাঝেও পরিচিতি পেয়েছে।
ওরশ চলাকালীন দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ছুঁটে আসে ভক্তরা। কেউ আবার ফকির বেশে আসে।
তবে যে মাজারটির পরিচয় ছিল স্থানীয় পর্যায়ে, একটি বিশেষ কাণ্ডে সেটির নাম এখন ছড়িয়ে পড়েছে সারা দেশেই।
এই মাজারের খেতা শাহ নামে এক ফকির তার এক ভক্তের স্ত্রীকে নিয়ে পালিয়েছেন- থানায় এমন অভিযোগ করার পর মাজারটি নিয়ে তৈরি হয়েছে বাড়তি উৎসাহ।
সম্প্রতি ওই এলাকার মাজারে বসবাস করা ফজলুল হক তালুকদার ওরফে খেতা শাহ নামের সেই ফকির আশ্রয় নেয় শফিকুল ইসলাম নামের এক ভক্তের বাসায়। কয়েক দিন পর শফিকুলের স্ত্রীকে নিয়ে পালিয়ে যান খেতা শাহ।
সেই ঘটনার পর কে এই খেতা শাহ, কীভাবে তার এই নামকরণ, তা নিয়ে তৈরি হয়েছে জিজ্ঞাসা।
খেতা ছিঁড়ার মাজারে ফজলুল হক এসে হয়ে যান খেতা শাহ
ময়মনসিংহের আঞ্চলিক ভাষায় কাঁথাকে বলা হয় খেতা। টিকুরী এলাকায় সব সময় ছেঁড়া কাঁথা শরীরে জড়িয়ে রাখতেন। তিনি যা বলতেন তাই হতো- এমন বিশ্বাসে অনেক লোক তার ভক্ত হয়ে যান৷
বৃদ্ধ বয়সে মারা যান সেই ব্যক্তি। কিন্তু থেকে যান ভক্তরা। একপর্যায়ে নির্মাণ করা হয় মাজার। নামকরণ করা হয় 'খেতা ছিঁড়ার মাজার'। প্রতি বছর পালন করা হয় ওরস।
ময়মনসিংহের তারাকান্দার 'খেতা ছিঁড়ার মাজার'এবারও চার মাস আগে ওরস শুরু হয় ওই মাজারে। বরাবরের মতো এবারও হাজারো ভক্তসহ লোকজন আসে মনের বাসনা পূরণ করার আশায়।
পাগল বেশে ফজলুল হক তালুকদার নামের একজনও আসেন মাজারটিতে। বড় দাড়ি, লম্বা গোফ ও ছিঁড়া খেতা গায়ে জড়িয়ে সারাক্ষণ মাজারে বসে সময় কাটাতেন। কেউ নাম জিজ্ঞেস করলে মাজারের নামের সঙ্গে নাম মিলিয়ে নিজেকে ‘খেতা শাহ’ হিসেবে পরিচয় দেন৷
৬০ বছর বয়সী ফজলুলের বাড়ি নেত্রকোণার পূর্বধলা উপজেলার পাইলাটি গ্রামে। তিনি মৃত মনা তালুকদারের ছেলে।
নিজেকে আধ্যাত্মিক ফকির হিসেবে সবার কাছে পরিচিতি পেতে কথাও বলতেন খুব কম। এভাবে গ্রামের সাধারণ মানুষের বিশ্বাস অর্জন করেন তিনি।
তাকে বাবা ডেকে অনেকে মনের বাসনা পূরণ করতে দোয়া চেয়ে নিতেন। যারা তার কাছে আসতেন, তাদের অনেককে মাথায় হাত ভুলিয়ে ঝাড়ফুঁক দিতেন। এভাবে কয়েক দিনেই তার ভক্তের সংখ্যা বেড়ে যায়।
খেতা শাহ মাজারে আসার কয়েক দিন পরই মাজারের পাশে এক ব্যক্তির বাড়িতে আশ্রয় দেয়া হয়েছিল। কিন্তু সেই বাড়িতে তার ভালো লাগেনি৷ দুই মাস পর আবার মাজার ও আশপাশে সময় কাটাতে থাকেন তিনি।
সংসারের উন্নতির আশায় ঘরে আশ্রয়
আধ্যাত্মিক ফকির ভেবে খেতা শাহের ভক্ত হয়ে যান শফিকুলও। সংসারের উন্নতি আর মনের বাসনা পূরণ হবে- এমন ধারণা থেকে দুই চাচার পরামর্শে নিয়ে আসেন বাড়িতে।
এই বাড়িতে খেতা শাহকে আশ্রয় দিয়েছিলেন শফিকুলখেতা শাহকে বাড়ির বারান্দায় আশ্রয় দেন শফিকুল৷ সেখানে রেখেই আপ্যায়ন শুরু করেন। স্ত্রীকেও বলতেন ঠিকঠাক সেবা করতে।
খেতা শাহ থাকেন জেনে সেই বাড়িতেও আসতে থাকে ভক্তরা। এলাকার লোকজন কাছে এলে যথাসম্ভব চুপ থেকে ঝাড়ফুঁক করে বিদায় করতেন তিনি।
স্থানীয়রা জানান, খেতা শাহ সব সময় ফিসফিস করে একাকী কী যেন জপতেন।
আফজাল মিয়া নামের একজন জানান, খেতা শাহকে কেউ পীর বাবা আবার কেউ ফকির বাবা বলে ডাকত। তার কাছে ঝাঁড়ফুকের জন্য গিয়ে অনেকেই বলত বাবার ফুঁ কাজে দিয়েছে। তিনি আধ্যাত্মিক ফকির। তার ভেতরে অনেককিছু আছে।
এভাবে তার প্রতি বিশ্বাস বেড়ে যায় গ্রামের বহু মানুষের।
তবে উপকৃত হয়েছেন, এমন উদাহরণ পাওয়া কঠিন। মরজিনা বেগম নামের এক প্রবীণ নারী নিউজবাংলাকে বলেন, ‘দীর্ঘদিন যাবৎ আমার মাথা ব্যথা ছিল। খেতা শাহ ওই বাড়িতে আসলে কয়েক দিন তার কাছে গিয়েছি। তিনি মাথায় হাত ভুলিয়ে ফুঁ দিয়ে দোয়া করে বলেন মাথাব্যথা ভালো হয়ে যাবে। কিন্তু ভালো হয়নি। এরপর থেকে সে ভণ্ড বুঝতে পেরে আর যাইনি।’
টের পান ছেলে, অন্ধবিশ্বাসে পাত্তা দেননি শফিকুলের
এক ছেলে ও দুই মেয়েসহ স্ত্রীকে নিয়ে সংসার ছিল শফিকুলের। বড় ছেলে স্থানীয় একটি স্কুলে পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ে। খেতার শাহর সঙ্গে মায়ের সম্পর্কের বিষয়ে বাবাকে বলেওছিল সে। কিন্তু শফিকুল বিশ্বাস করেননি।
ছেলেটি নিউজবাংলাকে বলে, তাদের বাড়িতে খেতা শাহ আসার পর থেকে তার সঙ্গে কোনো কথা বলতেন না। তার বাবা কাজে বের হলে তার মায়ের সঙ্গে নানা কথাবার্তা বলতেন। তিনি বলতেন, তারা অনেক সুখী হবে, তাদের টিনের ঘর ভবনে পরিণত হবে, তারা ধনী হয়ে যাবেন।
ছেলেটি কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলে, ‘আব্বারে অনেক কইছি। আব্বা আমার কথা বিশ্বাস করে না। এর লাইগ্যাই এমুন ঘটনা ঘটাইছে ভণ্ড খেতা শাহ।’
শফিকুলের বৃদ্ধ মা মরিয়ম খাতুন বলেন, খেতা শাহ যা বলেন তাই হয়, এমন ভয় থেকে তাকে কিছু বলতে পারেনি। এখন এই বলতে না পারাকে তাদের ভুল হিসেবে দেখছেন তারা।
তিনি জানান, পালানোর সময় খেতা শাহ তার গায়ের কিছু কাঁথা বারান্দায় রেখে একটি কাঁথা শরীরে জড়িয়ে নেন।
যাওয়ার সময় এগুলো ফেলে যান খেতা শাহশফিকুল ইসলাম নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আমার ছেলে ভণ্ডকে বিশ্বাস করেনি। তাকে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিতে বললেও অন্ধ বিশ্বাসের কারণে তা করিনি। আমার ছোট ছেলেমেয়েরা তার মায়ের জন্য সব সময় কান্নাকাটি করে। ঘটনায় নিজেই লজ্জিত হয়েছি। ভণ্ড খেতা শাহকে গ্রেপ্তারের দাবি জানাই।’
কেন এই ফকিরকে বিশ্বাস করেছিলেন, সেটিও জানান শফিকুল। বলেন ‘খেতা শাহর ব্যবহার ছিল মধুর। তিনি যা বলবেন তাই হবে বলে বিশ্বাস ছিল। এ জন্য সর্বোচ্চ যত্ন করে আমার বাসায় রেখেছি। তাকে কখনও নামাজ পড়তে দেখিনি, কিন্তু অন্ধ বিশ্বাসের কারণে অবিশ্বাস করিনি।’
তিনি বলেন, ‘আমি প্রতিদিন সকালে তারাকান্দার চারিয়া বাজারে একটি ওয়ার্কশপে কাজ করতে যাই। মাঝেমধ্যে সন্ধ্যায় বাড়িতে ফিরি। এ সুযোগেই স্ত্রীকে তার ভক্ত বানিয়েছে। এরপর আমার স্ত্রীর দিকে নজর দেয়।’
পালানোর পর ফোন বন্ধ
গত ২২ জুন দুপুর ১২টার দিকে শফিকুলের স্ত্রী বাবার বাড়ি ময়মনসিংহের ধোবাউড়ায় যাওয়ার কথা বলে খেতা শাহকে নিয়ে বের হন। এরপর দুজনই নিখোঁজ হন।
এ ঘটনায় খেতা শাহের নামে গত শুক্রবার সন্ধ্যায় থানায় লিখিত অভিযোগ দেন শফিকুল ইসলাম। রাত ১২টার দিকে তার অভিযোগ মামলা হিসেবে নথিবদ্ধ করা হয়।
খেতা শাহর বিরুদ্ধে অভিযোগ করা শফিকুলতারাকান্দা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আবুল খায়ের নিউজবাংলাকে বলেন, ‘মামলার পর থেকে খেতা শাহকে গ্রেপ্তার করে শফিকুলের স্ত্রীকে উদ্ধার করতে পুলিশের একাধিক টিম কাজ করছে। তবে ধারণা করছি, খেতা শাহ ওই নারীকে নিয়ে দেশের অন্য কোনো মাজারেও আশ্রয় নিতে পারে।
‘যদি মাজারে না যায়, তাহলে দীর্ঘদিন পালিয়ে থাকতে লম্বা চুল, দাড়ি ও গোফ ফেলে দেওয়াসহ শরীরে খেতা না জড়িয়ে পোশাক পরিবর্তন করতে পারে।’
এই পুলিশ কর্মকর্তা জানান, পালিয়ে যাওয়ার পর থেকে খেতা শাহর ব্যবহার করা মোবাইল নম্বরটি বন্ধ রয়েছে।
কী বলছেন খেতা শাহের ছেলে-পুত্রবধূ
খেতা শাহর ছেলে আলমগীর তালুকদার নিউজবাংলাকে বলেন, ‘বাবা বহু বছর যাবৎ বিভিন্ন মাজারে মাজারে ঘুরাফেরা করে। নারী সংক্রান্ত ঘটনায় কখনো জড়াতে দেখিনি। এখন কী কারণে এমন ঘটনা ঘটিয়েছে আমার জানা নেই। পুলিশ তদন্ত করলেই সব পরিষ্কার হবে।’
আলমগীরের স্ত্রী সুফিয়া আক্তার নিউজবাংলাকে বলেন, ‘২০১৩ সালে আমার বিয়ে হয়েছে। এরপর থেকে স্বামীকে নিয়ে ঢাকার গাজীপুরের শ্রীপুরে বসবাস করছি। এত বছরে শ্বশুরের সঙ্গে সরাসরি মাত্র পাঁচবার দেখা হয়েছে।’
খেতা শাহের ছেলের মতো তার পুত্রবধূও বলেন, ‘এমন ঘটনা ঘটাবে কল্পনাও করিনি। কারণ এর আগে কোনো নারীসংক্রান্ত ঘটনায় তিনি জড়াননি।’