বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

রূপগঞ্জ ট্র্যাজেডির ১ বছর: এখনও কাঁদেন নিহতের স্বজনরা

  •    
  • ৮ জুলাই, ২০২২ ০৮:২০

২০২১ সালের ৮ জুলাই বিকেলে নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জের কর্ণগোপ এলাকায় সজীব গ্রুপের প্রতিষ্ঠান হাশেম ফুডস অ্যান্ড বেভারেজ কারখানায় আগুন লাগে। ফায়ার সার্ভিসের ১৮টি ইউনিট চেষ্টা চালিয়ে প্রায় ২৯ ঘণ্টা পর আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে। ছয়তলা ভবনের ওই কারখানায় লাগা আগুনে প্রাণ হারান ৫৪ জন।

ভবনের চারদিকে আগুন। প্রাণ বাঁচাতে ভেতরে আটকে শ্রমিকরা হয়তো চিৎকার করছিলেন। একদিকে আগুন, অন্যদিকে গেট বন্ধ। শেষ পর্যন্ত রক্ষা হয়নি ৫৪ প্রাণের।

নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জের হাশেম ফুড ট্র্যাজেডির এক বছর আজ।

২০২১ সালের ৮ জুলাই বিকেলে নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জের কর্ণগোপ এলাকায় সজীব গ্রুপের প্রতিষ্ঠান হাশেম ফুডস অ্যান্ড বেভারেজ কারখানায় আগুন লাগে। ফায়ার সার্ভিসের ১৮টি ইউনিট চেষ্টা চালিয়ে প্রায় ২৯ ঘণ্টা পর আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে।

ছয়তলা ভবনের ওই কারখানায় লাগা আগুনে প্রাণ হারান ৫৪ জন। ওই ঘটনায় পুলিশ কারখানার মালিকসহ আটজনের নামে মামলা করে।

মামলায় সজীব গ্রুপের চেয়ারম্যান আবুল হাশেমসহ আটজনকে গ্রেপ্তার করে চার দিনের রিমান্ডে নেয় পুলিশ। রিমান্ড শেষে আাদালত তাদের কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেয়।

পরে তারা জামিনে বের হন। আগুনের ঘটনায় জেলা প্রশাসন, ফায়ার সার্ভিস, কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তর পৃথক তিনটি তদন্ত কমিটি গঠন করে প্রতিবেদন প্রকাশ করে। এতেও কারখানার অব্যবস্থাপনাকে দায়ী করা হয়।

সেই ঘটনার স্মৃতি ভুলতে পারেননি নিহত ও আহতের স্বজনরা। ভয়াবহ ওই আগুনের কথা মনে পড়লে এখনও আঁতকে ওঠেন অনেকে। তাদের মধ্যে কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলেছে নিউজবাংলা।

হাশেম ফুডস অ্যান্ড বেভারেজ কারখানার বর্তমান অবস্থা

বুধবার কারখানায় গিয়ে দেখা যায়, আগুনে ক্ষতিগ্রস্ত ভবন সিলগালা অবস্থায় রয়েছে। তবে এখনও মোছেনি আগুনের কালো দাগ।

দেখে মনে হয় যেন সেই পোড়া দেয়ালে কান পাতলে শোনা যাবে নিহত শ্রমিকদের চিৎকার। কারখানার প্রধান ফটকে লাগানো হয়েছে ‘এখানে শিশু শ্রমিক নিষিদ্ধ’।

গত বছর কারখানার আগুনে যাদের মৃত্যু হয়েছে তাদের মধ্যে অনেকেই ছিল শিশু ও কিশোর। কারখানার পশ্চিম অংশের দেয়াল ধরে নেয়া হয়েছে ১০ ইঞ্চির পানির পাইপ। কারখানা চালু করা হয়েছে পাশের আরেকটি ভবনে। সেখানে শ্রমিকরা কাজ করছেন। তাদের মধ্যে অনেকেই সহকর্মীকে হারানোর কষ্ট ভুলতে পারেননি।

এখনও কাঁদেন নিহতদের স্বজন ও আহতরা

আগুনে পুড়ে নিহতের একজন মোহাম্মদ ইয়াসিন। তিনি এইচএসসি পরীক্ষার্থী ছিলেন। তার স্বপ্ন ছিল প্রকৌশলী হয়ে মায়ের মন জয় করবেন। তা আর হয়ে ওঠেনি।

করোনার কারণে ওই বছর পরীক্ষা পেছায়। বাবা হারানো সংসারে মাকে সাহায্য করতে সাময়িকভাবে কাজ নেন ওই কারখানায়। সেই আগুনে পুড়ে যায় ইয়াসিন ও তার মায়ের স্বপ্ন।

আগুনে পুড়ে মৃত্যু হওয়া মোহাম্মদ ইয়াসিনের মা নাজমা বেগম

ছেলেহারা মা নাজমা বেগম বলেন, ‘আমার যে ক্ষয়ক্ষতি হইছে, আমি এর বিচার চাই। আমি কত আশা করছি, কত কষ্ট কইরা আমার সন্তানরে মানুষ করছি। পরীক্ষার ফরমও ফিলাপ করছিল, কিন্তু আর দিতে পারল না। আমি সরকারের কাছে সুষ্ঠু বিচার চাই।’

ওই কারখানার চারতলায় কাজ করতেন আমেনা বেগম। ছেলেকে নিয়ে থাকতেন কর্ণগোপ এলাকায়।

আমেনার মৃত্যুর পর তার ছয় বছরের ছেলে রাফিনকে দেখভাল করছেন শ্বশুর হারুন মিয়া। তিনি বলেন, ‘আগুনের খবর শুনে গেছিলাম সেখানে। অনেক খুঁজছি, কিন্তু আমেনারে পাই নাই। পরে খবর পাইয়া আমেনার বাফে আইছে। রক্ত দিয়া ডিএনএ টেস্ট করছে। এরপর ফোন পাইছি ওর লাশ শনাক্ত হইছে। পরে এখানে দাফন করছি।

‘আমেনার ছেলেডা ওর মারে খালি বিছরায়। আমি ওরে বলি তর মা বিদেশ গেছি। তুই বড় হইলে আইব।’

ভয়াবহ সেই আগুনের শিখা থেকে বাঁচতে ভবনের দ্বিতীয় তলা থেকে লাফ দিয়েছিলেন আবু বক্কর সিদ্দিক। কমরের হাড় ভেঙে কয়েক মাস হাসপাতালে ছিলেন।

আগুন থেকে বেঁচে ফেরা আবু বক্কর সিদ্দিক

ভয়াবহ সেই স্মৃতি মনে পড়লে এখনও কেঁদে ওঠেন সিদ্দিক। তিনি বলেন, ‘৮ জুলাইয়ের কথা মনে পড়লে কষ্ট লাগে। আমার সাথের লোকগুলি মারা গেছে। ঘটনার পর আমি কয়েক মাস ঘুমাইতে পারি নাই। খালি মনে হইত আগুনের কথা।

‘সুস্থ হয়ে ফেরার পর কাজের জন্য কয়েক জায়গায় ঘুরেছি, কিন্তু কাজ পাই নাই। পরে শুনলাম কারখানার অন্য ভবনের শাখা খুলছে তাই সেখানে আবার গেছি। কারখানায় এখনও অনেক শ্রমিক কাম করে। তবে আগের মতো নাই। এখন আগুন লাগলে কী করতে হইব সেগুলো আমাগো শিখাইছে। আহারে আগে যদি কারখানায় এমন ব্যবস্থা করত তাইলে এতগুলো মানুষ মরত না।’

যা বলছে সিআইডি

আগুনে ৫৪ জনের মৃত্যুর ঘটনায় পুলিশের করা মামলা সিআইডির কাছে হস্তান্তর করা হয় ১৭ জুলাই। সিআইডি আলামত সংগ্রহ, সাক্ষ্যগ্রহণসহ ১০টি বিষয়ে গুরুত্ব দিয়ে মামলার তদন্ত কাজ করে। তবে এক বছরেও সংস্থাটি তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিতে পারেনি।

সিআইডির বিশেষ পুলিশ সুপার (অতিরিক্ত ডিআইজি পদে পদোন্নতি পাওয়া) দেলোয়ার হোসেন বলেন, ‘মামলার তদন্তের শুরু থেকে আমরা একটি টিম গঠন করে দিয়েছিলাম। তদন্তকারী টিম তদন্ত করেছে গভীরভাবে। তদন্তের শেষ পর্যায়ে চলে এসেছি।’

তদন্ত শেষ হতে সময় লাগার কারণ সম্পর্কে সিআইডির এ কর্মকর্তা বলেন, ‘অনেক বিষয় দেখার ছিল। কিছু তদন্ত রিপোর্ট দেখা, ডিএনএ রিপোর্টসহ মরদেহগুলো স্বজনদের কাছে পৌঁছে দেয়া, সব মিলিয়ে মামলা জটিল ছিল। এ জন্য তদন্তে একটু সময় লেগেছে। মামলার বর্তমান অবস্থা হলো, তদন্ত একেবারে শেষের দিকে।’

দেলোয়ার বলেন, ‘আমাদের তদন্তগুলো পর্যালোচনা করছি। পর্যালোচনায় তদন্তের কোথাও কোনো ভুল আছে কি না সেগুলো দেখা হচ্ছে। আমরা যেকোনো সময় আদালতে প্রতিবেদন দাখিল করব।

‘আমাদের তদন্ত প্রতিবেদনে সবকিছু বলা হবে। কী কারণে সেখানে আগুন লাগল, কাদের গাফিলতি, কারা আগুনের ঘটনার জন্য দায়ী, সবকিছু সাক্ষ্য-প্রমাণসহ আমরা আদালতে উপস্থাপন করব।’

সিআইডির এসপি বলেন, ‘আমরা সবকিছু সূক্ষ্মভাবে তদন্ত করেছি। প্রতিটি বিষয় আমরা অনুসন্ধান করেছি। ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের পরামর্শ নিয়েছি। ঘটনার সঙ্গে যারা জড়িত, আমাদের তদন্তে যারা বেরিয়ে এসেছে, তারা বিচারের মুখোমুখি হবে।’

মামলার তদন্ত কর্মকর্তা সিআইডির পুলিশ পরিদর্শক আতাউর রহমান নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আমরা তিন পর্বে মরদেহ হস্তান্তর করেছি। প্রথম হস্তান্তর করা হয় তিন নারীর মরদেহ। এরপর ডিএনএ রিপোর্ট পেয়ে ৪৮ জনের দেহাবশেষ হস্তান্তর করি। সবশেষ কারখানায় তল্লাশি চালিয়ে আরও তিনজনের মরদেহের অংশ উদ্ধার করে সেগুলো ডিএনএন পরীক্ষা করে তাদের পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়।’

কারখানা কর্তৃপক্ষের দাবি

হাশেম ফুডের অ্যাসিস্ট্যান্ট জেনারেল ম্যানেজার (প্রশাসনিক বিভাগ) ক্যাপ্টেন (অব.) মামুনুর রশিদ নিউজবাংলাকে বলেন, ‘যে ভবনে আগুন লেগেছে সেটি পরিত্যক্ত অবস্থায় আছে। আমরা সরকারের নির্দেশনা অনুসারে ভবনকে পরিত্যক্ত অবস্থায় রেখে দিয়েছি। তবে অন্য যে ভবন রয়েছে, সেখানে আমরা সাময়িকভাবে কাজ শুরু করেছি।’

তিনি বলেন, ‘আগুনের যে ভয়াবহতা তা সবাই দেখেছে। এ নিয়ে কিছু বলার নেই। তবে আমরা বর্তমানে শ্রমিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করেছি। তাদের জন্য ফায়ার সার্ভিসের কাছ থেকে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেছি। আগুন কীভাবে নেভানো যায়, কীভাবে প্রতিহত করা যায়, সেসব বিষয়ে তাদের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি করেছি। পাশাপাশি আমরা কারখানার ভেতর প্রচুর সেফটি রিলেডেট যত ধরনের ইকুয়েভমেন্ট আছে সবকিছুর ব্যবস্থা করেছি।’

দোষীদের শাস্তি দাবি

আগুনে নিহতদের স্বজনদের ১ কোটি টাকা করে ক্ষতিপূরণ দেয়ার নির্দেশনা চেয়ে হাইকোর্টে রিট করেছিল আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) পাশাপাশি বেশ কয়েকটি সংগঠন। আবেদনে অন্তর্বর্তীকালীন ক্ষতিপূরণ হিসেবে নিহতদের পরিবারকে ১০ লাখ এবং আহতদের ৫ লাখ টাকাসহ চিকিৎসা নিশ্চিত করতে বলা হয়।

তবে শুধু ক্ষতিপূরণই যেন শেষ না হয়, যারা ঘটনার জন্য দায়ী তাদের শাস্তি দাবি করেছেন সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) নারায়ণগঞ্জের নেতারা।

সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক ধীমান সাহা জুয়েল বলেন, ‘এমন ঘটনা যাতে অন্য আর কোনো প্রতিষ্ঠানে না ঘটে, এ জন্য সংশ্লিষ্ট সবাইকে কঠোর হতে হবে। আমরা এমন মৃত্যু আর চাই না। আগুনের ভয়াবহতা থেকে শ্রমিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার দায়িত্ব সবার।

‘ঘটনার পর পরই আমাদের নাগরিক জোটের কমিটি অনুসন্ধানসহ সুপারিশ দিয়েছিলাম। তা আর বাস্তবায়ন হয়নি।’

সুজনের সাধারণ সম্পাদক বলেন, ‘যারা হাশেম ফুডের ঘটনার জন্য দায়ী, আমরা তাদের শাস্তি দাবি করছি।’

এ বিভাগের আরো খবর