ঈদে বাড়ি ফিরতে টিকিটের জন্য কোনো হাহাকার নেই, না বাস, না ট্রেন, না লঞ্চে। ঈদুল ফিতরের সেই অভাবনীয় সহজ-সরল ঈদযাত্রার এই দৃশ্য দেখা যাবে কি এবার?
একেবারে সাধারণ যে জবাব, সেটি হলো ‘না’। টিকিটের জন্য হাপিত্যেস আবার দেখা যাবে এবার। এর কারণ হলো, ঈদে বাইকে করে বাড়ি ফেরার পথ বন্ধ করেছে সরকার।
সরকারের যে নির্দেশ, তাতে এই কথাটি বলা নেই বটে, তবে বলা আছে, ঈদের আগে-পরে সাত দিন এক জেলা থেকে বাইকে অন্য জেলায় যাওয়া যাবে না। এতে কার্যত ঈদে শহর থেকে গ্রামমুখী বাইকের যাত্রার পথ বন্ধ।
গত ঈদে রাজধানীসহ বড় শহর থেকে লাখ লাখ মানুষ বাড়ি ফিরেছেন বাইকে করে। এতে বাসে যাত্রীর চাপ ছিল না। ট্রেন-বাসে দেখা যায়নি উপচে পড়া ভিড়। আর যাত্রীদের একটি বড় অংশ দুই চাকার দ্রুতগামী যানে বাড়ি যাওয়ার কারণে সড়কে সেভাবে অন্য বছরের মতো যানজটও দেখা যায়নি।
তবে এই বিষয়টি আবার পরিবহন ব্যবসায়ীদের ক্ষতির কারণ হয়েছিল। তারা খুব করে চাইছিল, এবার ঈদযাত্রায় বাইকের ব্যবহার যেন বন্ধ করা হয়। তাদের সে চাওয়া পূরণ হয়েছে। আর তাতে ভোগান্তির শঙ্কা বাড়ার পাশাপাশি তীব্র জনক্ষোভ তৈরি হয়েছে।
গত এক দশকে দেশে বাইকের ব্যাপক চল হওয়ার পর মহাসড়কে ব্যাপক মৃত্যুর ঘটনাও ঘটেছে। তবে ভোগান্তির যাত্রা এড়াতে এই ঝুঁকি নিতেও পিছপা হচ্ছে না হাজারো মানুষ।
ঢাকা থেকে উত্তরের জেলা কুড়িগ্রাম থেকে শুরু করে দক্ষিণের জেলা বরিশাল, বাইকে চড়ে যাত্রা করে এমন অনেকের খোঁজ পেয়েছে নিউজবাংলা। ময়মনসিংহ, নেত্রকোণা, জামালপুর, সিলেট, কক্সবাজার যেতেও দুই চাকার যানে চড়ার মানুষ ভূরিভূরি।
বাড়ি যাওয়ার টিকিট কোথায়
এবারও মোটর সাইকেলে করে ঈদযাত্রার মানসিক প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছিলেন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মী কুড়িগ্রামের তামজিদ হাসান তুরাগ। বাইকে যাবেন ভেবে বাসের টিকিটের জন্য চেষ্টাও করেননি। এখন তার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ার পরিস্থিতি।
তিনি নিউজবাংলাকে বলেন, ‘কুড়িগ্রামের নন এসি টিকিট ৮০০ টাকা হলেও ১২০০ থেকে ১৫০০ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হচ্ছে কালোবাজারে। টিকিট পাব কি পাব না; যার ফলে বাড়ি যাওয়ার আশা অনেকটা ফিকে হয়ে গেছে।’
বাইকাররা কেন বাইকে বাড়ি যাচ্ছেন সেই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে হবে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘গণপরিবহনে মানুষ আস্থা হারিয়েই বাইকে করে গ্রামের বাড়ি ছুটছেন। কার স্বার্থে কেন এই সিদ্ধান্ত তা আমার মাথায় আসছে না।’
কয়েক বছর ধরেই মোটরসাইকেলে চেপে ঈদ করতে জামালপুরের দেওয়ানগঞ্জ যান স্থপতি হাসানুর রহমান। এ বছরও একই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। তিনি নিউজবাংলাকে বলেন, ‘এটা একটা ননসেন্স সিদ্ধান্ত। ঢাকা সিটিতে অসংখ্য বাইকার। অনেকেই আবার রাইড শেয়ারিং করে জীবিকা নির্বাহ করছেন। বাইকে খুব সহজেই মুভমেন্ট করা যায়। যেটা গণপরিবহনে আট ঘণ্টার পথ, মানুষ সেটা পাঁচ ঘণ্টায় যাতায়াত করছেন, জীবন অনেক সহজ হয়ে গেছে৷ হুট করে এ রকম সিদ্ধান্ত নিলে কীভাবে হবে?’
নিজের অভিজ্ঞতা টেনে তিনি বলেন, ‘আমি তিন-চার বছর ধরে ট্রেনের টিকিটের জন্য লাইনে দাঁড়াই না। বাইক বন্ধ করার সিদ্ধান্ত আসল কেন, এ ধরনের সিদ্ধান্ত কে নিল? কী স্টাডি করে নিল? আই ডোন্ট নো?’
দুইজনের সিঙ্গেল ফ্যামিলি তারা বাইক নিয়ে চলে যেতেন। এখন তাদের টিকিটের জন্য দৌড়াতে হবে।
বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মী অপূর্ব রায়ের বাড়ি ময়মনসিংহ। বাইকই পছন্দ তার। তিনি নিউজবাংলাকে বলেন, ‘এটা একটা অযৌক্তিক সিদ্ধান্ত। ঈদের টাইমে এমনিতেই যানবাহনে রাশ থাকে। গতবারের ঈদে অনেকেই বাইকে স্বাচ্ছন্দ্যে চলে যেতে পেরেছে।’
তিনি বলেন, ‘আমি রোড ট্যাক্স থেকে শুরু করে সবকিছু দিই৷ আমি কেন আমার বাহন নিয়ে চলাচল করতে পারব না। বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটি যখন আমাকে লাইসেন্স দিছে, তখন তো কোথাও বলে দেয়া হয় নাই, তুমি এখানে চালাতে পারবা, ওখানে পারবা না। হুটহাট করে এভাবে জানিয়ে দিলেই তো হয় না। অবশ্যই সরকারের এটা নিয়ে আবার ভাবা উচিত।’
মোহাম্মদপুরের বাসিন্দা সাকিব আব্দুল্লাহর বাড়ি নেত্রকোণায়। টিকিটের ঝামেলা এড়াতে তিনিও বাইকে ভরসা করেন ঈদে। নিউজবাংলাকে দেয়া তার প্রতিক্রিয়া এমন, ‘এই সিদ্ধান্ত সম্পূর্ণ অযৌক্তিক। মহাসড়কে দুর্ঘটনার জন্য শুধু মোটরসাইকেল একা দায়ী নয়।’
এবার পদ্মা সেতু হয়ে বাড়ি যাবেন বলে বাড়তি উচ্ছ্বাস ছিল বরিশালের কাজী গালিবের। আশা ছিল, সেতুতে বাইকে যে নিষেধাজ্ঞা দেয়া হয়েছে, সেটি ঈদে অন্তত উঠে যাবে। কিন্তু যেটি হয়েছে, সেটি তার আকাঙ্ক্ষার পুরো বিপরীত। তিনি বলেন, ‘এটা একটা ভুল সিদ্ধান্ত। সব দুর্ঘটনা যে বাইকাররা করছে, তা তো না। বাইকে গতি নিয়ন্ত্রণ করতে চাইলে সরকার স্পিড মিটার বসাতে পারত।’
দুই বিশেষজ্ঞের দুই মত
পরিবহন বিশেষজ্ঞ এম শামসুল হক মনে করছেন, সরকার একটা সাহসী সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তিনি বলেন, ‘দুই চাকার যান মহাসড়কে অনিরাপদ। তাই সরকারের উচিত গণপরিবহনের সংখ্যা বাড়ানো।’
তবে শামসুলের মতোই আরেক পরিবহন বিশেষজ্ঞ মো. হাদিউজ্জামান বলছেন, সরকারের সিদ্ধান্ত সময়োচিত হয়নি। তিনি বলেন, এই সিদ্ধান্তটা আরও দুই মাস আগে জানানো উচিত ছিল। তিনি বলেন, এই সুযোগে আনফিট বাস মহাসড়কে নেমে দুর্ঘটনার শঙ্কা বাড়াবে।
এই দুই বিশেষজ্ঞই বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক যারা প্রতিষ্ঠানটির অ্যাকসিডেন্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউটের সঙ্গে সম্পৃক্ত।
এদের মধ্যে হাদিউজ্জামান বর্তমান পরিচালক আর শামসুল হক সাবেক।
হাদিউজ্জামান বলেন, ‘ঈদযাত্রায় প্রায় ১৫ লাখ মোটরসাইকেল ঢাকা ছাড়বে। প্রতিটিতে দুইজন যাত্রী হলে ৩০ লাখ মানুষ ঢাকা ছাড়ত এসব বাহনে৷ এতগুলো মানুষের বিকল্প বাহন কী হবে?’
যাত্রীর চাপ বেশি থাকলে মহাসড়কে স্বল্প যাত্রার বাস ভিড় করতে পারে বলে মনে করছেন এই বিশেষজ্ঞ। এসব গাড়ির ফিটনেস নিয়ে সংশয় আছে তার। বলেন, ‘এসব বাস মহাসড়কে নেমে পড়লে দুর্ঘটনা বাড়তে পারে। যার ফলে বাইক বন্ধের এই সিদ্ধান্তের মূল উদ্দেশ্য ব্যাহত হবে।’
বাইক নিয়ে সরকারের নীতিমালা পরস্পরবিরোধী বলেও সমালোচনা করেন অধ্যাপক হাদি। বলেন, ‘আমাদের উচিত ছিল মোটরসাইকেল নিয়ন্ত্রণ ও গণপরিবহন সমৃদ্ধ করা। আমরা তা করি নাই। যার ফলে মোটরসাইকেলের ওপর নির্ভরশীলতা বাড়ছে। মোটরসাইকেলের নিবন্ধন ফি কমানো হয়েছে, উৎপাদনকে উৎসাহিত করেছি, কিন্তু বাইকের জন্য সার্ভিস লেন করিনি।’
প্রতিটি মহাসড়কের পাশে সার্ভিস লেন করা এখন জরুরি হয়ে পড়েছে বলেও মনে করেন তিনি। বলেন, ‘আলাদা লেন করলে দুর্ঘটনা কম হবে।’
অধ্যাপক সামছুল হক অবশ্য সরকারের সিদ্ধান্তকে শতভাগ সমর্থন করছেন। তিনি নিউজবাংলাকে বলেন, ‘দুই চাকার যান মহাসড়কে আনফিট অনিরাপদ। প্রত্যাশা এক জিনিস আর রেসপনসিবিলিটি অন্য জিনিস। তাই সরকার সাহসী একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছে।’
গতবারের ঈদযাত্রায় গণপরিবহনের বদলে বাইক যাত্রাকে ইতিবাচক হিসেবে দেখছেন না তিনি। বলেন, ‘মানুষ ব্যক্তিগত সিস্টেমে চলে গেল। উপজেলা শহরে গণপরিবহনের সংখ্য কম। সেখানেও মোটরসাইকেল ও ইজিবাইক মাত্র। অথচ আমাদের উচিত ছিল গণপরিবহন পপুলার করা।’
এই পরিবহন বিশেষজ্ঞ বলেন, ‘আমরা ইমোশনাল হয়ে কাজ করি৷ সরকারের উচিত হবে গণপরিহনের সংখ্যা বৃদ্ধি করা।’