বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

অধ্যক্ষকে জুতার মালা: ওসি শওকতের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা

  •    
  • ৩ জুলাই, ২০২২ ১৪:০৪

ওসি শওকত কবীরকে নড়াইল থেকে সরিয়ে খুলনা আরআরএফ (রেঞ্জ রিজার্ভ ফোর্স)-এ সংযুক্ত করা হয়েছে বলে নিউজবাংলাকে রোববার নিশ্চিত করেছেন নড়াইল জেলা পুলিশ সুপার প্রবীর কুমার রায়।

নড়াইলের সদর উপজেলার মির্জাপুর ইউনাইটেড ডিগ্রি কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ স্বপন কুমার বিশ্বাসকে জুতার মালা পরিয়ে হেনস্তার ঘটনায় সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহাম্মদ শওকত কবীরকে অবশেষে প্রত্যাহার করা হয়েছে।

শওকত কবীরকে নড়াইল থেকে সরিয়ে খুলনা আরআরএফ (রেঞ্জ রিজার্ভ ফোর্স)-এ সংযুক্ত করা হয়েছে বলে নিউজবাংলাকে রোববার নিশ্চিত করেছেন নড়াইল জেলা পুলিশ সুপার প্রবীর কুমার রায়।

ঘটনার ১১ দিনের মাথায় ওসির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হলো।

এর আগে নিউজবাংলার অনুসন্ধানে দেখা গেছে, স্বপন কুমারকে জুতার মালা পরানোর সময় তার আশপাশে পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাসহ বাহিনীর অন্তত ১০ জন সদস্য উপস্থিত ছিলেন। ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষকে যেখানে দাঁড় করিয়ে জুতার মালা পরানো হয়, তার তিন-চার হাত দূরেই দৃশ্যত নির্বিকার ভঙ্গিতে দাঁড়িয়েছিলেন নড়াইল সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহাম্মদ শওকত কবীর।

আরও পড়ুন: অধ্যক্ষের গলায় জুতার মালা ওসির সামনেই

যে ছাত্রের ফেসবুক পোস্ট নিয়ে কলেজে উত্তেজনা, সেই ছাত্রের বিরুদ্ধে এক ব্যক্তির মামলার এজাহার নিয়েও উঠেছে প্রশ্ন। মামলার বাদী নিউজবাংলাকে বলেন, অভিযুক্ত ছাত্র রাহুল দেব রায় ফেসবুকে কী পোস্ট দিয়েছেন তা তিনি দেখেননি। ওসি শওকত কবীরের ‘অনুরোধে’ তিনি মামলার বাদী হয়েছেন, এমনকি এজাহারও লিখে দিয়েছে পুলিশ।

নড়াইলের মির্জাপুর ইউনাইটেড ডিগ্রি কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ স্বপন কুমার বিশ্বাসের গলায় জুতার মালা পরানোর ঘটনায় ক্ষোভ ছড়িয়েছে দেশব্যাপী। অলংকরণ: মামুন হোসাইন/নিউজবাংলা

ফেসবুকে ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) বহিষ্কৃত মুখপাত্র নূপুর শর্মার সমর্থনে কলেজের একাদশ শ্রেণির ছাত্র রাহুলের পোস্ট দেয়াকে কেন্দ্র করে গত ১৮ জুন দিনভর নড়াইল সদর উপজেলার মির্জাপুর ইউনাইটেড ডিগ্রি কলেজ ক্যাম্পাসে বিক্ষোভ, সহিংসতা চলে। গুজব ছড়িয়ে দেয়া হয় ওই শিক্ষার্থীর পক্ষ নিয়েছেন কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ স্বপন কুমার বিশ্বাস।

এরপর পুলিশ পাহারায় বিকেল ৪টার দিকে স্বপন কুমার বিশ্বাসকে ক্যাম্পাসের বাইরে নিয়ে যাওয়ার সময় তাকে দাঁড় করিয়ে গলায় জুতার মালা পরিয়ে দেয় একদল ব্যক্তি। শিক্ষক স্বপন কুমার হাত উঁচিয়ে ক্ষমা চাইতে থাকেন। পরে তাকে তুলে নেয়া হয় পুলিশের গাড়িতে।

মোবাইল ফোনে ধারণ করা এ ঘটনার ভিডিও ফুটেজ ছড়িয়ে পড়েছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। সেই ভিডিওতে দেখা যায়, স্বপন কুমার ও অভিযুক্ত ছাত্রসহ তিনজনকে কলেজের ভেতর থেকে বের করে আনার সময় ডান পাশে কলাপসিবল গেটের সামনে দাঁড়িয়ে আছেন নড়াইল সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহাম্মদ শওকত কবীর।

ভিডিওতে দেখা যায়, কলাপসিবল গেটের বাম পাশের আরেকটি গেট দিয়ে তিনজনকে বের করে আনা হচ্ছে। এ সময় পুলিশি পাহারার মধ্যেই কলেজের ভেতর থেকে এক তরুণ জুতার মালা হাতে বেরিয়ে আসেন। ওই তরুণের কোমরের এক পাশে আইডি কার্ড ঝুলছিল।

স্বপন কুমার ও অভিযুক্ত শিক্ষার্থীকে যে তিন যুবক জুতার মালা পরিয়ে দেন, তাদের একজনের কাছে আইডি কার্ডধারী তরুণটিই ভেতর থেকে আনা মালা ধরিয়ে দেন। মালা পরানোর আগে ওই তিন যুবকের দুজন ওসি শওকত কবীরের সামনে দিয়ে রেলিং টপকে শিক্ষকের সামনে যান। রেলিং টপকানোর সময়ে দুই যুবকের মধ্যে আকাশি রঙের টি শার্ট পরা যুবকের বাহুতে হাত দিতেও দেখা যায় ওসিকে।

রেলিং টপকানো আকাশি রঙের টি শার্ট পরা যুবকের বাহুতে হাত দিতেও দেখা যায় ওসিকে

এরপর তিন যুবক ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ ও ছাত্রকে জুতার মালা পরিয়ে দেন। এ সময়ে ওসিসহ অন্য পুলিশ সদস্যরা ছিলেন নিষ্ক্রিয়।

শিক্ষককে জুতার মালা পরানোর সময় পাশেই নড়াইল সদর থানার ওসি মোহাম্মদ শওকত কবীরের উপস্থিতি ভিডিওতে শনাক্ত করেছেন পৌর আওয়ামী লীগ সভাপতি ও সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি মলয় কুমার কুণ্ডু।

তিনি নিউজবাংলাকে বলেন ‘ওখানে ওসি ছিল, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার ছিল, অতিরিক্ত পুলিশ ছিল। ভিডিওতে দেখেছি, বোঝাই যাচ্ছে উনি ওসি। পুলিশ সে সময় পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে পারেনি।’

তবে এ ঘটনার সময় অন্যত্র ছিলেন বলে শুরু থেকে দাবি করছিলেন ওসি শওকত কবীর।

বিষয়টি নিয়ে গত ২৬ জুন একটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশ করে নিউজবাংলা। সেদিন ওসি বলেন, ‘ওই দিন পাবলিক খুব বেশি উত্তেজিত ছিল। তাদের কন্ট্রোলে নেয়া যাচ্ছিল না। আর আমার চোখে জুতার মালার মতো কোনো কিছু পড়েনি। তাকে যখন গাড়িতে তোলা হয়েছে তখন তার গলায় এ ধরনের কিছু ছিল না।’

আরও পড়ুন: পুলিশের সামনে শিক্ষকের গলায় জুতার মালা কীভাবে?

ভিডিওতে তাকে দেখা গেছে, এমন তথ্য জানিয়ে গত বুধবার এ বিষয়ে ওসির বক্তব্য আবার জানতে চায় নিউজবাংলা। এ সময়ও তিনি দাবি করেন, অধ্যক্ষকে জুতার মালা পরানোর সময় তিনি আশপাশে ছিলেন না।

ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ স্বপন কুমার বিশ্বাসকে জুতার মালা পরানোর সময় ডান পাশে কলাপসিবল গেটের সামনে দাঁড়িয়ে নড়াইল সদর থানার ওসি মোহাম্মদ শওকত কবীর

মোহাম্মদ শওকত কবীর নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আমি মেইন গেটের দিকে ছিলাম। ক্রাউড কন্ট্রোল করছিলাম। রুমের ভেতরে ও ওপরে আমাদের অফিসার এবং ফোর্স ছিল। বের করে নিয়ে আসার পরে তিন-চারজন ওরা যে এইটা করবে, বা ওখানে থাকবে এ রকম কিছু ইনটেনশন ছিল না।’

এরপর তার হোয়াটসঅ্যাপ নম্বরে ভিডিও থেকে নেয়া স্ক্রিনশট পাঠানো হলে বক্তব্যে পরিবর্তন আনেন। অবস্থানের বিষয়ে কোনো মন্তব্য না করে তিনি বলেন, ‘আমি জুতার মালা পরাতে দেখিনি।’

ঘটনার বর্ণনায় শওকত কবীর বলেন, ‘আমাদের জুনিয়র অফিসাররা বেসিক্যালি পেছন সাইটটায় ছিল, ওনাদের নিয়ে আসার সময়। কোনো ইনটেনশন ছিল না। রাহুলকে (অভিযুক্ত ছাত্র) দিলে পরে আমরা এক্সকিউজ করতে পারি, কিন্তু প্রিন্সিপালকে কোনো দোষ ছাড়াই এটা দিছে। একটা ঘটনা ঘটে গেছে।

‘এখানটাতে এত মানুষ, কোনো ক্যাজুয়ালিটি ছাড়া ওনাকে (স্বপন কুমার) বের করে নিয়ে আসাই আমাদের প্রধান টার্গেট ছিল। কেউ প্রেডিক্ট করতে পারেনি, এমনটি ঘটবে।’

ছাত্রের বিরুদ্ধে মামলার এজাহারেও ‘অনিয়ম’

যে ছাত্রের ফেসবুক পোস্ট নিয়ে কলেজে উত্তেজনা, সেই ছাত্রের বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মামলার বাদী বলছেন, অভিযুক্ত ছাত্র রাহুল দেব রায় ফেসবুকে কী পোস্ট দিয়েছেন তা তিনি দেখেননি। ওসি শওকত কবীরের ‘অনুরোধে’ তিনি মামলার বাদী হয়েছেন, এমনকি এজাহারও লিখে দিয়েছে পুলিশ। তিনি শুধু সই করেছেন। ঘটনার পরদিন ১৯ জুন ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মামলাটি হলেও ২০ জুন পুলিশ বাদীর বাড়ি গিয়ে এজাহার ‘সংশোধন’ করে আবার তার সই নিয়েছেন।

আরও পড়ুন: শিক্ষককে জুতার মালা: ছাত্রের বিরুদ্ধে এজাহারের ‘লেখক’ পুলিশ

রাহুল দেব রায়ের বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মামলার বাদী মির্জাপুর হাজিবাড়ী দাখিল মাদ্রাসার সহকারী মৌলভী শিক্ষক মো. ফারুক হোসেন।

তিনি নিউজবাংলাকে বলেন, ‘ঘটনার পরের দিন দুপুরের দিকে ওসি সাহেব আমারে ফোন দিছেন যে, মামলার একজন বাদী হতে হবি, একজন বাদী বের করেন। কয়েকজনের সঙ্গে আলোচনা করলাম, কেউ যাতি রাজি না।

‘আমি (ওসিকে) বললাম, মাগরিবের পরে আলোচনা করে কিডা যাবে আমি জানাচ্ছি আপনাদের। সে বলল, না, দেরি হয়ে যাবে, ২৪ ঘণ্টার মধ্যে দিতে হবে। তাহলে একটা কাজ করেন, আপনি নিজেই বাদী হন। আমরা গাড়িতে করে আপনাকে নিয়ে যাচ্ছি, আবার দিয়ে যাব।’

ফারুক হোসেন বলেন, ‘পরে ওসি সাহেবের গাড়িতে করে গেলাম নড়াইল। নড়াইল গেলে ওসি সাহেব সব লিখেটিখে সব কমপ্লিট করার পর আমি বললাম যে, আমার তো আবার মিটিং আছে, একটু তাড়াতাড়ি যাতি হবে।

‘তখন কলো (বলল), ঠিক আছে, কমপ্লেইন নিয়ে আমি এসপির কাছে যাব। ওখানে ডিআইজির সঙ্গে ফোন করে এডা আলোচনা করে আপনার স্বাক্ষর নেব। আপনার একটু দেরি করে যাতি হবে। তখন আমি ওখানে মাগরিবের নামাজ পড়লাম।’

এর পরের ঘটনার বিবরণ দিয়ে ফারুক হোসেন নিউজবাংলাকে বলেন, ‘ওসি সাহেব এরপর যাইয়ে এসপির সঙ্গে আলোচনা করে। ওইটা দেখাদেখি করার পর আমার কাছ থেকে একটা স্বাক্ষর নিল কেসে। যা লেখার উনারা লিখেছেন, আমি কিছু লেখিনি। আমি বলিওনি।

‘আমাক পড়ে শোনাল যে, এই ঘটনা। দেখলাম ওখানে যা হইছে, তাই। আমি যতদূর জানি সব সঠিক। সেইভাবে আমি স্বাক্ষর করি আসলাম।’

মামলা হয়ে যাওয়ার পর এজাহারের কপি পরিবর্তনের অভিযোগও উঠেছে পুলিশের বিরুদ্ধে। ফারুক হোসেন নিউজবাংলাকে জানান, পরদিন পুলিশ তার বাসায় এসে জানায় এজাহারে কিছু সংশোধন করা হয়েছে। এরপর সেই ‘সংশোধিত’ কপিতে আগের দিনের তারিখেই ফারুক হোসেনের সই নেয়া হয়।

শিক্ষার্থী রাহুল দেব রায়ের বিরুদ্ধে মামলার এজাহারের মূল ও সংশোধিত কপি

এজাহারের প্রথম দিনের এবং পরদিনের দুটি কপিই পেয়েছে নিউজবাংলা। ফারুক হোসেনকে পুলিশ বলেছিল এজাহারের নতুন কপিতে কিছু বানান সংশোধন করা হয়েছে। তবে নিউজবাংলা দেখেছে, দুটি কপির মধ্যে ‘উক্ত সময়ে পুলিশ আইন শৃংখলা রক্ষার্থে ০৬ রাউন্ড গ্যাস গান ফায়ার করে‘- এই বাক্যটির হেরফের রয়েছে। একটি কপিতে বাক্যটি থাকলেও আরেকটিতে নেই।

মির্জাপুর ইউনাইটেড ডিগ্রি কলেজে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষকে লাঞ্ছিত করার ঘটনার সময় পাশেই ওসি মোহাম্মদ শওকত কবীরের উপস্থিতি দেখা গেলেও তাকে জেলা প্রশাসনের গঠিত তদন্ত কমিটির সদস্য করা হয়। এ কমিটির আহ্বায়ক নড়াইলের অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট (এডিএম) জুবায়ের হোসেন চৌধুরী। এ ছাড়া জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা এস এম ছায়েদুর রহমান তদন্ত কমিটির সদস্য ছিলেন।

শনিবার রাতে তারা জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ হাবিবুর রহমানের কাছে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেন। এর পরদিনই ওসি মোহাম্মদ শওকত কবীরকে প্রত্যাহারের বিষয়টি নিশ্চিত করেন জেলা পুলিশ সুপার।

এ বিভাগের আরো খবর