নড়াইলে মির্জাপুর ইউনাইটেড ডিগ্রি কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ স্বপন কুমার বিশ্বাসকে অপদস্থ করার ঘটনার প্রতিবাদ ও নিন্দা জানিয়েছে নিপীড়নের বিরুদ্ধে শাহবাগ নামে একটি সংগঠন।
সোমবার বিকেলে রাজধানীর শাহবাগ জাতীয় জাদুঘরের সামনে প্রতিবাদ সমাবেশ করে সংগঠনটি।
একজন শিক্ষককে অপদস্থ করার ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নেতাদের নীরবতা নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক কাবেরী গায়েন।
তিনি বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের একটা গরিমা আছে। আমরা স্কুল-কলেজের শিক্ষকদের আমাদের সমান স্ট্যাটাসের মনে করি না। কিন্তু খুব বেশিদিন নেই, আপনার গলায়ও জুতার মালা পরানো হবে। কাজেই আসুন, আমরা রুখে দাঁড়াই।’
সমাবেশের প্রতি সংহতি জানিয়ে এতে মাইনরিটি রাইটস ফোরাম বাংলাদেশ, বাংলাদেশ ছাত্র ঐক্য পরিষদ, বাংলাদেশ শিক্ষক ঐক্য পরিষদ, বাংলাদেশ কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির (বাকবিশিস) নেতৃবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন।
সমাবেশে কাবেরী গায়েন বলেন, ‘নড়াইলে এই ঘটনায় যদি আমার ভেতরে বেদনা কাজ না করে, তাহলে আমি শিক্ষক নই। আমাদের শিক্ষামন্ত্রী, শিক্ষা উপমন্ত্রী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি, বাংলাদেশ শিক্ষক ফেডারেশন তাদের কাজটা আসলে কী? এভাবে কি শিক্ষকরা একের পর এক অপমানিত হতেই থাকবেন? শিক্ষক লাঞ্ছনা এখন শিক্ষক হত্যায় উপনীত হয়েছে।’
এই অধ্যাপক ক্ষেদের সঙ্গে বলেন, ‘আসুন, আমরা উদযাপন করি। শিক্ষকের প্রতি এই নিপীড়ন এবং হত্যাযজ্ঞকে আমরা উৎসবে পরিণত করি।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এই অধ্যাপক বলেন, ‘সনাতন ধর্মাবলম্বী শিক্ষকরা এই দেশে আর বেশিদিন থাকতে পারবেন না। দশ বা বিশ বছর পর তাদের সংখ্যা এমনিতে কমে যাবে। কিন্তু এই কোমলমতি শিক্ষার্থী, যারা তাদের শিক্ষকদের মারছে, গলায় জুতার মালা পরিয়ে দিচ্ছে, তাদের হাতেই কিন্তু বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ। তখন সেটা কোন দেশ হবে, সেটা কি আমরা ভাবব? মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, শিক্ষামন্ত্রীসহ শিক্ষাসংশ্লিষ্ট সকল বডির কাছে আবেদন জানাই, শিক্ষা, শিক্ষক, শিক্ষার্থী এবং দেশকে রক্ষা করুন।’
ছাত্র ইউনিয়নের সাবেক সভাপতি শরীফুজ্জামান শরিফ বলেন, ‘এই ঘটনার জন্য আমি নড়াইলের ডিসি এবং এসপির দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি করছি। এই ঘটনা ধর্মীয় বা সাংস্কৃতিক কোনো ইস্যু নয়। এটি রাজনৈতিক ইস্যু। এই ইস্যুগুলো যত বেশি হয়, একটা অংশের ভোটের পারসেন্টেজ বাড়ে। বর্তমানে সরকারের গদিতে যারা বসে আছেন, তাদের আশ্রয় এবং প্রশ্রয়েই এই ঘটনাগুলো ঘটছে।’
শরিফ বলেন, ‘আমরা একসময় বলতাম, এই ঘটনাগুলোর জন্য সরকার দায়ী নয়। কিন্তু আমি এখন মনে করি, প্রতিটি ঘটনার জন্য সরকার দায়ী। সরকারের ইন্ধন এবং রাজনৈতিক ইক্যুয়েশনে প্রতিটি ঘটনা ঘটে। শাসক দলের কনসার্ন ছাড়া একটা ঘটনাও ঘটে না।
‘এখন বাংলাদেশের প্রতিটি প্রান্তে যে ঘটনাগুলো ঘটছে, এর পেছনে রাজনৈতিক ইক্যুয়েশন আছে। সামনে নির্বাচন। সীমানার এপার এবং ওপারে এই ঘটনাগুলোর ইমপ্যাক্ট আছে। সুতরাং নড়াইলের ঘটনায় শেষ, এটি আমি বিশ্বাস করি না।’
সাবেক এই ছাত্রনেতা বলেন, ‘এই ঘটনায় শিক্ষকরা চুপ। কারণ তারা এখন দাসত্ব করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট অধিবেশনে জয় বাংলা না বলে জিন্দাবাদ বলা নিয়ে শিক্ষকদের মধ্যে কারবালার কাণ্ড ঘটে গেল। অথচ এই ঘটনা নিয়ে শিক্ষক সমিতি থেকে শুরু করে ফেডারেশন একটা কথাও বলল না। কারণ শিক্ষকদের বিরাট অংশ শিক্ষকতার চেয়ে আওয়ামী লীগের ওয়ার্ড পর্যায়ের কর্মী পরিচয় দিতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন। কারণ এর মাধ্যমে হল প্রভোস্ট, হাউস টিউটরসহ পদ পাওয়াসহ তার ইহজাগতিক অনেক সুবিধা আসবে।’
বিএনপিকে উদ্দেশ করে সাবেক এই নেতা বলেন, ‘ক্ষমতায় আসার জন্য যারা বসে আছেন, তাদের জিজ্ঞেস করা দরকার এসব ঘটনায় আপনাদের প্রতিক্রিয়া কী? পাহাড় ধসলে, ভারতে বৃষ্টি হলে আপনাদের প্রতিক্রিয়া দেখা যায়। কিন্তু সারা বাংলাদেশে টার্গেট করে স্কুল-কলেজের হিন্দু শিক্ষকদের যেভাবে লাঞ্ছিত করা হচ্ছে, এই বিষয়ে আপনারা নীরব কেন? আপনাদের রাজনৈতিক ভূমিকা কী?’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক রোবায়েত ফেরদৌস বলেন, ‘এটি কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। ধারাবাহিকভাবেই এসব ঘটে আসছে। যে পুলিশ রক্ষা করবে, তার সামনে নির্যাতনের ঘটনা ঘটছে। কারণ যিনি পুলিশের পোশাক পরে আছেন, তার ভেতরেও ধর্মান্ধতা। গান, চারুকলা, কবিতা, শিল্পসাহিত্য সব হারিয়ে যাচ্ছে। চূড়ান্ত সময়েও যদি আমাদের বোধদয় না হয়, তাহলে পরাজয়ের জায়গা আরও সম্প্রসারিত হবে।’
নিপীড়নবিরোধী শাহবাগের সংগঠক রবিন আহসান বলেন, ‘কলেজের অধ্যক্ষ স্বপন কুমার বিশ্বাস পুলিশকে ডেকেছেন নিজের নিরাপত্তার জন্য, কিন্তু সেই পুলিশের সামনে তাকে হেনস্তা, অপমানের শিকার হতে হয়েছে। সাভারে শিক্ষককে পিটিয়ে মেরে ফেলা হয়েছে। এই হতভাগ্য বাংলাদেশ আমি ৪৯ বছরে দেখিনি।’
গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. আব্দুর রাজ্জাক খান বলেন, ‘একাত্তরের মধ্য দিয়ে আমরা যে বাংলাদেশটা পেয়েছি, এখন আর সেই বাংলাদেশ নেই। বাংলাস্তান হয়ে গিয়েছে। পাকিস্তানের মতোই এটি সাম্প্রদায়িক মৌলবাদী রাষ্ট্রে পরিণত হয়ে গিয়েছে। মনে হয়েছে, এ মালা আমাকে পরানো হয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো শিক্ষক সমিতি, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক ফেডারেশন কোনো বিবৃতি দেয়নি। এতে বোঝা যায়, তারা এটি পাশ কাটাতে চায়। তারা দলান্ধ, তারা দলের বিরুদ্ধে কিছু করতে পারবে না, অ্যাকশন নিতে পারবেন না। আমি এই ঘটনার তীব্র নিন্দা এবং ধিক্কার জানাই। সেই সঙ্গে নড়াইলের ডিসি, এসপি এবং অফিসার ইনচার্জ, থানা এবং যে সমস্ত পুলিশ সদস্য সেখানে ছিলেন, তাদের বিচার বিভাগীয় তদন্তের মাধ্যমে শাস্তির দাবি জানাই।’
যুব ইউনিয়নের সভাপতি খান আসাদুজ্জামান মাসুমের সঞ্চালনায় সমাবেশে আরও বক্তব্য রাখেন বাংলাদেশ ছাত্র ঐক্য পরিষদের কেন্দ্রীয় কমিটির আহ্বায়ক কাজল কুমার দাস, বাংলাদেশ শিক্ষক ঐক্য পরিষদের সদস্য সচিব রনজিত দেব, ছাত্র ইউনিয়ন কেন্দ্রীয় সংসদের সভাপতি ফয়জুল্লাহ, যুব ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক হাবিব আদনান, বাংলাদেশ উদীচী শিল্পীগোষ্ঠীর সাধারণ সম্পাদক অমিদ রঞ্জন দে প্রমুখ।
সমাবেশে সভাপতিত্ব করেন নিপীড়নের বিরুদ্ধে শাহবাগ ও গণজাগরণ মঞ্চের সংগঠক আকরামুল হক।