বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

যাদের জমিতে পদ্মা সেতু, চোখে তাদের আনন্দাশ্রু

  •    
  • ২৪ জুন, ২০২২ ২১:১৭

২০০৬ সালের শেষের দিকে কথা। বাবা লাল মিয়া হাওলাদার মোবাইল ফোনে বাবুলকে জানান তাদের জমি থেকে পাঁচ একর জায়গা পদ্মা সেতুর জন্য অধিগ্রহণের সিদ্ধান্ত হয়েছে। বাপ-দাদার ভিটেমাটি ছাড়ার শংকায় মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে বাবুলের। তবে নিজেকে সামলে নেন দিন কয়েকের মধ্যেই। বুঝতে পারেন তার মতো আরও অনেকের ত্যাগের মধ্যে দিয়েই দক্ষিণের কোটি কোটি মানুষের স্বপ্ন পূরণের দ্বার উন্মোচিত হচ্ছে।

আলোয় উদ্ভাসিত রাতের পদ্মা সেতু। প্রতিবিম্ব পদ্মার বুকে তৈরি করেছে অদ্ভুত মায়াবী পরিবেশ। নিজ ঘর ছেড়ে মৃদু পায়ে নদীর তীরে এসে দাঁড়ান ৪২ বছর বয়সী বাবুল হাওলাদার। দুই চোখ বেয়ে নামছে অশ্রুধারা।

বাংলাদেশের অহংকার হয়ে প্রমত্তা পদ্মাকে পরাস্ত করে দুই প্রান্তের সংযোগ ঘটিয়েছে যে সেতু, তার নাড়ির টান বাবুল হাওলাদারের। আরও অনেকের মতো তার পৈত্রিক জমি এই সেতুর জন্য করা হয়েছে অধিগ্রহণ। ফলে পদ্মা সেতু কেবল একটি স্টিল-কংক্রিটের কাঠামো নয়, বাবুলের কাছে এই সেতু যেন আপন সন্তানতুল্য।

জাজিরা প্রান্তের ১০১ নং নাওডোবা মৌজার ১০৪৯ নং খতিয়ানের ৪৩৪৯ নং দাগে পদ্মা সেতুর টোল প্লাজার আগে ভায়াডাক্টের সবশেষ পিলারের জায়গায় ছিল বাবুল হাওলাদারের বসতি। ৯.৮১ একর জমিতে বসতবাড়ির পাশাপাশি ছিল কৃষিজমি।

সেই জমিতে কৃষিকাজ করত বাবুলে পরিবার। পাশাপাশি ঢাকার শ্যামবাজারে হকারের কাজ করতেন বাবুল।

২০০৬ সালের শেষের দিকে কথা। বাবা লাল মিয়া হাওলাদার মোবাইল ফোনে বাবুলকে জানান তাদের জমি থেকে পাঁচ একর জায়গা পদ্মা সেতুর জন্য অধিগ্রহণের সিদ্ধান্ত হয়েছে। বাপ-দাদার ভিটেমাটি ছাড়ার শংকায় মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে বাবুলের।

তবে নিজেকে সামলে নেন দিন কয়েকের মধ্যেই, বুঝতে পারেন তার মতো আরও অনেকের ত্যাগের মধ্যে দিয়েই দক্ষিণের কোটি কোটি মানুষের স্বপ্ন পূরণের দ্বার উন্মোচিত হবে।

পদ্মা সেতুর জন্য বাবুল শেষ পর্যন্ত স্বতস্ফূর্তভাবেই জমি দিয়েছেন। ২০০৮ সালের ৩ জুলাই জমি অধিগ্রহণের নোটিশ পায় তার পরিবার। সব আইনি প্রক্রিয়া শেষে ২০১১ সালে ক্ষতিপূরণ বাবদ তারা পান ২১ লাখ ৬ হাজার ৪১৫ টাকা।

২০১৪ সালে অধিগ্রহণ করা জমির সব স্থাপনা উচ্ছেদ করে কর্তৃপক্ষ। পদ্মা সেতু ও সার্ভিস এরিয়া ২ এর মধ্যে থাকা অবশিষ্ট থাকা ৪.৮১ একর জমিতে নতুন বসতি গড়েন হাওলাদার পরিবারের মানুষ। তারপর কেটে গেছে আট বছর। বাবুলের চোখের সামনে ধীরে ধীরে পূর্ণতা পেয়েছে বিশ্বকে অবাক করে দেয়া বাংলাদেশের গর্বের গল্প।

রাতের ঘনিয়ে আসা অন্ধকারে আলো ঝলমলে পদ্মা সেতুর দিকে তাকিয়ে সেই সব দিনের স্মৃতি তাড়িত হন বাবুল। নিউজবাংলাকে শোনান, প্রথম কয়েক দিনের টানাপড়েন আর এখনকার গর্ব-আনন্দের নানান কথা। পদ্মা সেতু নিয়ে প্রথম দিককার ষড়যন্ত্রে বাবুল হাওয়ালাদারও ভেঙে পড়েছিলেন। তবে কি তার মতো আরও অনেকের ত্যাগ আর দক্ষিণাঞ্চলের কোটি কোটি মানুষের স্বপ্ন বিফলে যাবে?

বাবুল বলছিলেন, 'জমি দেয়ার পর জানতে পারলাম সেতু নিয়া ষড়যন্ত্র হইতাছে। বিদেশিরা নাকি টাকা দিবো না। তহন ভাবছিলাম পদ্মা সেতু মনে অয় অইবো না। কিন্তু আইজ এই সেতু এভাবে দেইখা খুবই আনন্দ লাগতাছে।'

এই সেতু যেন বাবুলের নিজের সন্তান। কথা বলতে গিয়ে দুই চোখে ঝিলিক দিয়ে ওঠে গর্ব। বাবুল বলেন, 'আমাগো জমির উপর দিয়া পদ্মা সেতু হইছে। এর চেয়ে আনন্দের আর কী হইতে পারে। আামার জমি হারানোর সব কষ্ট দূর হইয়া গেছে।'

আবেগঘন কণ্ঠে তিনি বলেন, ‘এই সেতু আমাগো গর্বের, আমাগো অহংকারের। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী দেখাই দিছে আমরা বাঙ্গালিরা কাঙ্গাল না। গর্বে বুকটা ভইরা যায় যখন ভাবি দেশের কোটি কোটি মানুষের স্বাপ্ন সত্যি হইছে।'

বাবলের মতোই এমন অসংখ্য গল্পের নায়ক পদ্মা পাড়ের খেটে খাওয়া অসংখ্য মানুষ। পৈত্রিক জমি অধিগ্রহণের পর তাদের অনেকের আশ্রয় হয়েছে পুনর্বাসন কেন্দ্রে। পদ্মা সেতুর জাজিরা ও মাওয়া প্রান্তে গড়ে তোলা হয়েছে সাতটি পুর্নবাসন কেন্দ্র। আধুনিক সব সুযোগ সুবিধার এসব আবাসন প্রকল্পে ভালো আছেন পুনর্বাসিতরা।

প্রশস্ত সড়ক, ড্রেনেজ, পানি সরবরাহ, শিক্ষা, চিকিৎসাসহ সব ধরনের নাগরিক সুবিধা রয়েছে পুনর্বাসন কেন্দ্রের বাসিন্দাদের জন্য।

পদ্মা সেতু পুনর্বাসন কেন্দ্রের নির্বাহী প্রকৌশলী রজব আলী নিউজবাংলাকে বলেন, 'সেতু প্রকল্পের জন্য সম্পূর্ণ বা আংশিক জমি হারাতে হয়েছে ২০ হাজার ৭৫৫টি পরিবারকে। তাদের জমি কিংবা আবাসস্থলের ওপর গড়ে উঠেছে দেশের অন্যতম বড় এই অবকাঠামো।'

সেতুর জাজিরা ও মাওয়া প্রান্তে সাতটি পুর্নবাসন কেন্দ্রে ৩ হাজার ১১টি পরিবারের মাঝে বরাদ্দ দেয়া হয়েছে আড়াই, পাঁচ ও সাড়ে সাত শতাংশ করে জমির প্লট। পরিবারগুলোর শিশুদের জন্য বিশাল খেলার মাঠসহ শিক্ষার সব ধরনের সুবিধা সম্বলিত চারটি প্রাথমিক বিদ্যালয় রয়েছে।

পুনর্বাসন কেন্দ্রের নির্বাহী প্রকৌশলী রজব আলী নিউজবাংলাকে বলেন, ‘পুনর্বাসন কেন্দ্রের বাসিন্দাদের প্রাথমিক চিকিৎসা দিতে পাঁচটি স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্র চলছে। প্রতিটি কেন্দ্রে দৃষ্টিনন্দন আধুনিক মসজিদ নির্মাণ করা হয়েছে। পুনর্বাসন কেন্দ্রের বাসিন্দাদের কর্মসংস্থানের জন্য বিভিন্ন ট্রেডে প্রশিক্ষণের সুযোগও রাখা হয়েছে। দৈনন্দিন কেনাকাটা ও ব্যবসা পরিচালনা এবং কর্মসংস্থানের জন্য বিশাল মার্কেট শেডও নির্মাণ করা হয়েছে।'

প্রতিটি পুনর্বাসন কেন্দ্রের দেখভালের জন্য ব্যবস্থাপনা কমিটি গঠন করা হয়েছে।

জাজিরা প্রান্তের পুর্নাবাসন কেন্দ্রগুলো সম্প্রতি ঘুরে দেখেছে নিউজবাংলা। কেন্দ্রের মূল গেট দিয়ে ঢুকলেই সবুজে ঘেরা আধুনিক পরিকল্পিত আবাসিক এলাকার দেখা মেলে। প্রতিটি বাড়ির পাশে ফলদ-বনজ গাছ বেড়ে উঠছে। ঘন সবুজের মধ্যে দিয়ে চলে গেছে প্রশস্ত পিচ ঢালা রাস্তা। এর পাশ ঘেঁষে গড়ে উঠেছে পাকা, আধাপাকা আর টিনশেড বাড়ি।

বসবাসকারীদের জন্য রয়েছে বিদ্যুৎ, সাপ্লাই পানি, ড্রেনেজ ব্যবস্থা। নাওডোবা পুনর্বাসন কেন্দ্রর ভেতরে বিকেল হতেই চোখে পড়ে ছোট একটি বাজারে বয়স্করা চা খেতে খেতে আড্ডা দিচ্ছেন। তাদের সঙ্গে নাস্তা করতে ভিড় জামিয়েছেন কর্মস্থল থেকে ফেরা মানুষ। তাদের কারও কারও দাবি, যাদের জমিতে পদ্মা সেতু করা হয়েছে তাদের জন্য বিশেষ কার্ড দেয়া হোক, যাতে তারা বিনা খরচে সেতু পার হতে পারেন।

নাওডোবা পুনর্বাসন কেন্দ্রের মো. আজাহারের বয়স ৬৫ বছর। তিনি নিউজবাংলাকে বলেন, ‘২০০৭ সালে প্রথম যখন আমাগো জমি অধিগ্রহণ করলো, তখন খুবই খারাপ লাগতেছিল। পরে যখন টাকাপয়সা দিলো এবং থাকার জন্য একটা প্লট দিলো তখন থেকে মন ভালো হয়ে গেছে। পদ্মা সেতু উদ্বোধন হইতাছে, দেশের অনেক উন্নতি হইবো। আমাগো সব কষ্ট দূর হইয়া গেছে।'পুনর্বাসন কেন্দ্রের ৩৮ বছর বয়সী মাকসুদা বেগম বলেন, ‘দ্যাশের একটা বড় কাজের লিগ্যা জমি ছাইড়া দিছি। সরকার আমাগো জমির লিগ্যা টাহাও দিছে। আবোর থাকোইন্যা ব্যবস্থাও কইরা দিছে। ঢাহা (ঢাকা) শহরের মতো পানি টিপ দিলেই পড়তে থাকে। কারেন আছে। হাসপাতালে গেলে ওষুদ-বড়ি দেয়। এহানের স্কুলে পোলাপাইনে লেহাপরা করাইতে পারি। এইহানে অনেক ভালোই আছি।'

পূর্ব নাওডোবা পুনর্বাসন কেন্দ্রের বাসিন্দা আলেয়া বেগম বলেন, ‘পোলাইনের পড়ালেখার জন্য সুন্দর বিদ্যালয় আছে। যারা কাজ শিখতে চায় তাদের জন্য গাড়ি চালানোর ট্রেনিং দিয়া আবার চাকরিও দিয়া দিছে। মেয়ে-ছেলেরা শিলাইয়ের (টেইলারিং) কাজ শিখছে। অহন তারা জামা কাপাড় বানাইয়া টাকা কামাই করতে পারে।'

এ বিভাগের আরো খবর