পদ্মা সেতুর উদ্বোধন এখন সময়ের অপেক্ষা। কতদূর দ্বিতীয় পদ্মা সেতু? সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের জানিয়েছেন, পাটুরিয়া-দৌলতদিয়ায় এই সেতুর সমীক্ষা শেষ। এখন সিদ্ধান্ত নেয়ার পালা।
তবে পদ্মা সেতু উদ্বোধনের তিন দিন আগে সংবাদ সম্মেলনে এসে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ইঙ্গিত দিলেন, এই মুহূর্তে আরও একটি মেগা প্রকল্প হাতে নিতে চান না তিনি।
সেদিনই আবার ঢাকায় জাপানের রাষ্ট্রদূত ইতো নাওকো জানিয়েছেন, তার দেশ দ্বিতীয় পদ্মা সেতুতে অর্থায়নে মুখিয়ে। পদ্মায় মাওয়া-জাজিরা প্রান্তে যে সেতু হয়েছে, তাতেও অর্থায়ন থাকার কথা ছিল জাপানের। কিন্তু বিশ্বব্যাংক দুর্নীতিচেষ্টার অভিযোগ তুলে এই সেতু থেকে সরে যাওয়ার পর সরে দাঁড়ায় জাপানের সহযোগিতা সংস্থা জাইকাও।
প্রধানমন্ত্রীর সংবাদ সস্মেলনের দিন জাপানের দূতও গণমাধ্যমের সামনে এসে বলেছেন, পদ্মা সেতুতে থাকতে না পেরে তার দেশ দুঃখিত। এখন দ্বিতীয় সেতুতে তারা দূরে থাকতে চায় না।
মাওয়া-জাজিরা প্রান্ত দিয়ে পদ্মার ওপর দিয়ে যে সেতু হয়েছে, তার সুফল ভোট করতে হলে কুষ্টিয়া অঞ্চলের মানুষদের একটু বাড়তি খরচ করতে হবে, ঘুরতেও হবে বেশ কিছু দূর। তাই তারা অপেক্ষায় কবে পাটুরিয়া-দৌলতদিয়ায় সেতু হবে।
এই রুটে আরও একটি সেতু কুষ্টিয়া অঞ্চলের জেলাগুলোর সঙ্গে ঢাকায় সড়কপথে যাত্রার সময় কমিয়ে দেবে অর্ধেক। কুষ্টিয়ার খাজানগর থেকে সহজে চাল পৌঁছে যাবে সারা দেশে। মুজিবনগর স্থলবন্দরের উদ্যোগ হবে আরও অর্থবহ।
কুষ্টিয়া, মেহেরপুর, চুয়াডাঙ্গা, ঝিনাইদহ ও রাজবাড়ী জেলা থেকে রাজধানীতে যেতে দৌলতদিয়া-পাটুরিয়ায় ফেরি পার হতে হয়। যানবাহনের চাপ থাকায় প্রায়ই ঘাটে আটকে থাকতে হয় ঘণ্টার পর ঘণ্টা।এ পথে ঢাকার সঙ্গে কুষ্টিয়ার দূরত্ব ১৭৫ কিলোমিটার। এ ছাড়া সিরাজগঞ্জ ঘুরে যমুনা সেতু দিয়েও যাতায়াত করে এ এলাকার যানবাহন। সে ক্ষেত্রে দূরত্ব প্রায় ২৭০ কিলোমিটার। এই রুটেও প্রায়ই যানজট লেগে থাকে।কুষ্টিয়া থেকে সড়কপথে যেদিক দিয়েই যাক, বাস-ট্রাকের ৬ থেকে ৭ ঘণ্টা সময় লেগে যায়। কোনো কোনো সময় তার চেয়েও বেশি সময় লাগে। আর মেহেরপুর চুয়াডাঙ্গা থেকে লাগে আরও এক ঘণ্টা বেশি।অন্যদিকে শরীয়তপুরের জাজিরা ও মুন্সীগঞ্জের মাওয়া হয়ে পদ্মা সেতু দিয়ে ঘুরে গেলে কুষ্টিয়া থেকে ঢাকার দূরত্ব হবে ২২৫ কিলোমিটার।
কুষ্টিয়ার শ্যামলী পরিবহনের ব্যবস্থাপক মো. মানিক নিউজবাংলাকে বলেন, ‘একে তো ঘুরে যেতে হবে, তার ওপর টোল বেশি। যমুনা সেতুতে বাসের টোল যেখানে ১ হাজার ৬০০ টাকা, সেখানে পদ্মা সেতুতে ধরা হয়েছে ২ হাজার ৪০০ টাকা। তাই পাটুরিয়া-দৌলতদিয়ায় দ্বিতীয় পদ্মা সেতু নির্মাণ করা গেলে সবচেয়ে ভালো হয় এ এলাকার মানুষের জন্য। তখন তিন থেকে সাড়ে তিন ঘণ্টায় পৌঁছে যাওয়া যাবে ঢাকায়।’
কুষ্টিয়া বাস-মিনিবাস মালিক গ্রুপের সাধারণ সম্পাদক হাসান আবুল ফজল সেলিম বলেন, ‘পদ্মা সেতু নিঃসন্দেহে দেশের জন্য একটি মাইলফলক। তবে কুষ্টিয়া, মেহেরপুর, চুয়াডাঙ্গা, ঝিনাইদহ ও রাজবাড়ীর মানুষ আমরা দ্বিতীয় পদ্মা সেতুর দাবি জানাচ্ছি। আমার আশা, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এটাও করে দিয়ে যাবেন। এটি হলে দেশের প্রথম রাজধানী মুজিবনগরের সঙ্গে ঢাকার যোগাযোগ সহজ হবে। এ এলাকার উন্নয়ন হবে।’
কুষ্টিয়া নাগরিক কমিটির সাধারণ সম্পাদক সেলিম তোহা বলেন, ‘২৫ জুন পদ্মা সেতু উদ্বোধন হবে। এটা বাংলাদেশের স্বনির্ভরতার একটি প্রমাণ। কুষ্টিয়া-অঞ্চলের মানুষের দাবি দৌলতদিয়া-পাটুরিয়ায় দ্বিতীয় পদ্মা সেতুর।’
তিনি বলেন, ‘কৃষি-শিল্পে কুষ্টিয়া এগিয়ে যাচ্ছে। দেশের মানুষের প্রধান খাদ্য চাল। সরু চালের সবচেয়ে বড় মোকাম কুষ্টিয়ার খাজানগরে। এখান থেকে সারা দেশে চাল সরবরাহ হয়। এই দ্বিতীয় পদ্মা সেতু হলে চাল কম দামে পাওয়া যাবে ঢাকায়।
‘মেহেরপুর জেলার মুজিবগরে সরকার স্থলবন্দর নির্মাণের কাজ প্রায় শেষ করে এনেছে। এ ছাড়া কুষ্টিয়া জেলার দৌলতপুর উপজেলার প্রাগপুরেও একটি স্থলবন্দর নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। দ্বিতীয় পদ্মা সেতু হলে এই বন্দর দুটোর সঙ্গে সারা দেশের যোগাযোগ সহজ হবে। তখন বন্দর দুটি করা আরও যুক্তিযুক্ত হবে।’
বাংলাদেশ অটো রাইচ মিল ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের কুষ্টিয়া জেলার সাধারণ সম্পাদক মফিজুল ইসলাম বলেন, ‘মাওয়ায় পদ্মা সেতু হওয়ায় দক্ষিণ-পশ্চিমের মানুষের ব্যাপক উন্নতি হবে। কিন্তু কুষ্টিয়ার খাজানগর থেকে চালের ট্রাক ওদিক দিয়ে পাঠিয়ে আমাদের লাভ হবে না। রাস্তা বেশি হওয়ায় একদিকে তেল খরচ যেমন বেশি হবে, তেমনি সেতুতে টোলও বেশি। এতে চালের দামে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। কিন্তু দৌলতদিয়া-পাটুরিয়ায় দ্বিতীয় পদ্মা সেতু হলে খুব সহজে দ্রুততম সময়ের মধ্যে খাজানগর থেকে চাল ঢাকায় পাঠানো যাবে।’
মেহেরপুর-২ আসনের সংসদ সদস্য সাহিদুজ্জামান খোকনও চান সরকার দ্রুত দ্বিতীয় পদ্মা সেতুর উদ্যোগ নিক। তিনি বলেন, ‘দৌলতদিয়া-পাটুরিয়া ঘাটে দ্বিতীয় পদ্মা সেতু নির্মিত হলে এই অঞ্চলের ছয়টি জেলার মানুষের ঢাকা যাতায়াতকারীদের ভোগান্তি অর্ধেক কমে যাবে। বিশেষ করে যারা ঢাকায় চাকরি করেন, তারা ইচ্ছে করলে ট্রেনে সকালে গিয়ে অফিস করতে পারবেন।’
তিনি বলেন, ‘বতর্মানে মেহেরপুর থেকে ঢাকা যেতে আট ঘণ্টা সময় লাগে। দ্বিতীয় পদ্মা সেতু হলে অর্ধেক সময় লাগবে। এ জেলার মানুষ তখন ঢাকায় কোনো কাজ থাকলে দিনেই শেষ করে চলে আসতে পারবেন। অর্থনৈতিকভাবেও ব্যাপক উন্নতি ঘটবে। বিশেষ করে কৃষিনির্ভর মেহেরপুর জেলার অনেক কাঁচামাল কম সময়ে ঢাকায় পৌঁছে যাবে। এতে করে কৃষক ও ব্যবসায়ীরা লাভবান হবেন।’
মেহেরপুর জেলা পরিষদের প্রশাসক ও জেলা বাস মালিক সমিতির সভাপতি গোলাম রসুল বলেন, ‘দ্বিতীয় পদ্মা সেতু হলে কৃষিপণ্য দ্রুত সময়ে ঢাকায় পৌঁছালে কৃষকের খরচ কমে যাবে। তারা পণ্যের ন্যায্যমূল্য পাবেন। এই সেতু হলে এলাকায় ভারী কলকারখানা গড়ে উঠবে। এ অঞ্চলে ব্যবসা বাণিজ্যের ব্যাপক প্রসার ঘটবে।’
কুষ্টিয়া জাসদের সভাপতি গোলাম মহসিন বলেন, ‘পদ্মা সেতু যেটি উদ্বোধন হতে যাচ্ছে সেটি আমাদের জন্য অহংকারের। আমরা প্রধানমন্ত্রীর ওপর খুশি। কিন্তু কুষ্টিয়া এলাকার মানুষের উপকার হতো যদি দৌলতদিয়া-পাটুরিয়ায় সেতু হতো।
‘মাওয়ায় সেতু করার সিদ্ধান্তের আগেই দৌলতদিয়ায় সেতু করার দাবি ছিল আমাদের। দ্বিতীয় পদ্মা সেতুর সমীক্ষা হয়েছে। সরকার অনেক চ্যালেঞ্জ নিচ্ছে। এটিও যদি করে দেয়, তাহলে খুবই ভালো হয়।’
পদ্মায় আরেকটি সেতু বা টানেল যেটিই হোক, শেখ হাসিনাই সেটি করবেন বলে আশা করেন কুষ্টিয়া সদর আসনের সংসদ সদস্য ও আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুবউল আলম হানিফ।
তিনি বলেন, ‘পদ্মার পানি প্রবাহের গতি স্বাভাবিক রাখতে সেতুর চেয়ে টানেল করা ভালো। আমরা চাই ব্রিজ-টানেল যা-ই হোক, একটি সংযোগ সৃষ্টি হোক। এটা এই এলাকার মানুষের দীর্ঘদিনের দাবি। সরকারও এ দাবি পূরণে কাজ করছে।’