বাংলাদেশের প্রখ্যাত প্রকৌশলী জামিলুর রেজা চৌধুরী ছিলেন দেশের সবচেয়ে বড় যোগাযোগ অবকাঠামো পদ্মা সেতু প্রকল্পের পরামর্শক কমিটির প্রধান। ২০২০ সালের ২০ এপ্রিল ৭৭ বছর বয়সে মারা যান তিনি।
পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) চেয়ারম্যান অধ্যাপক শিবলী রুবাইয়াত-উল-ইসলামের সম্পর্কে ফুপা ছিলেন এই অগ্রগণ্য প্রকৌশলী।
পদ্মা সেতুর সঙ্গে জামিলুর রেজা চৌধুরীর সরাসরি সম্পৃক্ততার কারণে পারিবারিক বিভিন্ন আয়োজনে বা উৎসবে আলোচনার বড় অংশজুড়ে থাকত এটি।
শিবলী রুবাইয়াত-উল-ইসলাম কাছ থেকে দেখেছেন, পদ্মা সেতুকে নিয়ে জামিলুর রেজা চৌধুরীর আবেগ, উদ্দীপনা, চ্যালেঞ্জ, উদ্বেগ ও গর্ব। সেসব আলোচনার স্মৃতিচারণ করে নিউজবাংলার সঙ্গে কথা বলেছেন বিএসইসি চেয়ারম্যান।
শিবলী রুবাইয়াত বলেন, ‘পদ্মা সেতু দেশের জনগণের কাছে একটা গর্বের বিষয়। তাই এটি ছিল আমাদের যেকোনো আসরের আলোচনার বিষয়বস্তু।
‘পারিবারিকভাবে ড. জামিলুর রেজা ছিলেন বন্ধুবৎসল এবং খুব গল্প করতে পছন্দ করতেন। আমার শ্বশুর, উনি এবং আমরা আরও অনেকেই মাঝেমধ্যে সন্ধ্যায় গল্প করতাম বিভিন্ন বিষয় নিয়ে।
‘মাননীয় প্রধানমন্ত্রী দায়িত্ব নেয়ার পর থেকেই এ বিষয়টি চলে আসছিল। পদ্মা ব্রিজের তখন ডিজাইন, স্ট্রাকচারাল কাজ হচ্ছিল। আমরা খুব খবর রাখতাম, যেহেতু একটা বড় প্রজেক্ট। এটিকে বাংলাদেশের গেম চেঞ্জার বলে মনে করি।
‘দেশের এক-চতুর্থাংশ ভৌগোলিক অংশে বড় ধরনের পরিবর্তন আসতে যাচ্ছে। সেই সঙ্গে পদ্মা ব্রিজের কারণে আমাদের নর্থ বেঙ্গল এবং ওয়েস্টের অনেক ডিস্ট্রিক্টও উপকৃত হবে।’
শিবলী রুবাইয়াত বলেন, ‘আমার শ্বশুর যেহেতু ওই দিকেরই। ওনারও খুব আকর্ষণ ছিল। ড. জামিলুর রেজা চৌধুরীর শ্বশুরবাড়িও ওই দিকেই। যার জন্য খুলনা, রাজশাহী এসব ব্যাপারে ওনারও আগ্রহ ছিল। ওনার স্ত্রীর সঙ্গে কথা বলতেন। আমরা অনেকেই দুষ্টামি করতাম।’
পদ্মা সেতু নির্মাণের চ্যালেঞ্জের বিষয়ে স্মৃতিচারণ করে শিবলী রুবাইয়াত বলেন, ‘ওনার কাছে সেতুর স্ট্রাকচারাল চ্যালেঞ্জগুলোর কথা শুনেছি। উনি বলতেন, এত খরস্রোতা নদী, পানির যে ফ্লো এবং স্পিড তাতে এটার পিলারগুলো তৈরি করা হবে বড় চ্যালেঞ্জ।
‘ওনারা যখন ডিজাইনের কাজ করেন, তখন আমাদের বলেছিলেন, আসলে আমরা যেভাবে পিলার দেখি, পানির নিচে এভাবে থাকে না। পিলারগুলো তিনটা পায়ের মতো ওয়াটার বেডের নিচে অনেকটা জায়গায় বসে যায়।
‘ওইগুলো যখন বসায়, তখন ওনারা বলছিলেন যে আমরা তিনটা খুঁটির ওপরে এই পিলারটা করব। হঠাৎ একটা সময় বললেন যে এটা তিনটাতে করা যাচ্ছে না। পানির যে গতি-প্রকৃতি এবং নদীশাসন, সবকিছু হিসাব করে দেখা গেছে, আমাদের এখন পুরোটা অথবা কিছু কিছু জায়গায় চারটি খুঁটি দিয়ে তার ওপর পিলার করতে হবে।’
আরও কিছু চ্যালেঞ্জের কথা উল্লেখ করে শিবলী বলেন, ‘চারটি খুঁটির ওপর পিলার বসাতে গিয়েও আরেক চ্যালেঞ্জে পড়েছিলেন ওনারা। পোলগুলো বসাতে গিয়ে দেখেন যে নদীর নিচে শক্ত মাটি যেটাকে রিভার বেড বলে সেটা ওনারা সহজে পাচ্ছেন না। অর্থাৎ যতটুকু গভীরতায় গিয়ে ওনারা পাইলিংয়ের কাজ করবেন, দেখা গেছে তার থেকেও অনেক নিচে যেতে হচ্ছে। শক্ত মাটি পাওয়া যাচ্ছে না।’
বিএসইসি চেয়ারম্যান বলেন, ‘বারবারই বিভিন্ন চ্যালেঞ্জের কারণে পদ্মা সেতুর স্ট্রাকচারাল ডিজাইন চেঞ্জ করতে হচ্ছিল। মাঝে মাঝে আমরা দেখতাম, ওনারা অনলাইনে পৃথিবীর যেগুলো কঠিন সেতু রয়েছে, সেগুলো নিয়ে কথাবার্তা বলতেন। আমি এগুলো বুঝতাম না। আমার শ্বশুর ও ওনার মধ্যে খুব আলোচনা হতো এসব বিষয়ে।’
তিনি বলেন, ‘আমেরিকায় একটা ব্রিজ আছে, সেটা খুব বড় এবং সমুদ্রের মাঝখান দিয়ে দুইটা স্টেটকে জোড়া লাগিয়েছে। একসময় দেখলাম, ওইটা সমুদ্রের নিচে কীভাবে, কী করা হয়েছে, ওইগুলো নিয়ে ওনারা আলোচনা করতেন।’
‘ওনাকে যখন যমুনা ব্রিজের ডিজাইন করতে দেখেছি বা রিসেন্টলি কর্ণফুলী টানেল বা বড় বড় যে প্রজেক্ট উনি করতেন, সেখানে ওনার মধ্যে আমরা এই জিনিসগুলো নিয়ে অতটা আগ্রহ দেখতে পাইনি, যতটা পদ্মা সেতুর বিষয়ে ছিল।’
বিশ্বব্যাংক পদ্মা সেতুর অর্থায়ন থেকে সরে গেলেও ড. জামিলুর রেজা চৌধুরী বিচলিত হননি বলে জানান অধ্যাপক শিবলী রুবাইয়াত-উল-ইসলাম।
তিনি বলেন, ‘বিশ্বব্যাংক যখন পদ্মা সেতুর অর্থায়ন থেকে সরে যায়, তখন ওনাকে ভয় পেতে দেখিনি। উনি অবশ্য ফাইন্যান্সিয়াল বিষয় নিয়ে অতটা চিন্তিত হতেন না। তবে ওনাকে চিন্তিত হতে এ জন্যই দেখিনি, কারণ আমার মনে হয়, মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে ওনার যোগাযোগ হতো। হয়তো বুঝতে পেরেছিলেন, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী কিছু না কিছু একটা করেই ফেলবেন। উনি ওনার কাজ করে গেছেন। কাজ হচ্ছিল, পরিবর্তন হচ্ছিল, আবার চেঞ্জ করছিলেন।’
তিনি বলেন, ‘আমি একদিন খেয়াল করেছিলাম, উনি একটা স্প্যানিশ ইনভেস্টমেন্ট গ্রুপের সঙ্গে মিটিং করছেন। তার কারণ ছিল, ওরা পদ্মা ব্রিজে ফাইন্যান্স করতে আসতে চাচ্ছিল বা এ রকম কিছু। তখন আমি বুঝতে পেরেছিলাম, তিনি ফাইন্যান্সের ব্যাপারে কাজ করছেন, মানে নিশ্চয় ফাইন্যান্সের কোনো ইস্যু আছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘যখন বিশ্বব্যাংক ব্যাক আউট করল, তখনও উনি কোনোভাবে ভয় পাননি। যখন এ রকম বিভিন্ন ঘটনা ঘটছে, তখনও ওনাদের কাজ চলছে এবং কাজ করছেন ওনারা। ওনার কাজে, আলোচনায় একটা স্মিত হাসি ছিল, তাতে বোঝা যেত তারা কনফিডেন্ট।
‘তিনি বিশ্বাস করতেন, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী যেকোনোভাবে ফাইন্যান্স জোগাড় করে এটা করবেন। তিনি সেটা অনুধাবন করতে পেরেছিলেন, যার কারণে তিনি ওনার কাজ এক বিন্দু থামাননি।
‘মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর প্রতি ওনার অগাধ বিশ্বাস ছিল। উনি পারবেন ভেবেই ভয় পাননি, বিচলিত হননি।
‘উনিও বিদেশে ওনার সার্কেলের মাধ্যমে ফান্ডের চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু সেটার আর দরকার হয়নি।’
পদ্মা সেতুকে নিয়ে জামিলুর রেজার ব্যক্তিগত আবেগ সম্পর্কে শিবলী রুবাইয়াত বলেন, ‘ওনার আবেগটা ছিল সাংঘাতিক। উনি প্রায়ই ওখানে তো যেতেন, কাউকে না কাউকে সঙ্গে নিয়ে যেতেন। ওনার নাতি এলো ম্যানচেস্টার থেকে, তখন উনি স্পিডবোট নিয়ে নাতি-জামাইসহ পুরা এলাকা ঘুরিয়ে দেখিয়েছেন। ওনার স্ত্রীকে নিয়ে পদ্মা সেতু নির্মাণের সময় প্রায় যেতেন। ওনার স্ত্রী পড়ে গিয়ে আহতই হয়েছেন সেখানে। ওনার আবেগ থেকেই পরিবারের সবাইকে নিয়ে গিয়ে দেখাতেন, সেখানে কী হচ্ছে। উনি গর্ববোধ করতেন, এ জন্য দেখাতেন। বলতেন, দেখ, বাংলাদেশে কী হচ্ছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘পদ্মা সেতু খুবই বড় একটা বিষয় ছিল ওনার জীবনে। প্রত্যেকটা আলোচনা, দাওয়াত, মিলাদ, জন্মদিন যা-ই হোক, পারিবারিক উৎসবে আলোচনা হতো পদ্মা সেতু নিয়ে। পারব কি না, সম্ভব কি না এটার সম্ভাব্যতা নিয়ে আলোচনা হতো।
‘উনি কথা না তুললেও আমরা ওনাকে বিভিন্ন প্রশ্ন জিজ্ঞেস করতাম। আমাদেরও উৎসাহ ছিল অনেক। এ জন্য উনি মাঝে মাঝে ওঠাতেন, না হলে আমরা ওঠাতাম। ফলে যেকোনো পারিবারিক অনুষ্ঠান বা এক জায়গায় হলে আলোচনার একটা জায়গায় রাজনৈতিক এবং দেশের বড় বড় স্থাপত্য নিয়ে আলোচনা হতো।’